চট্টগ্রামের মানুষ প্রতিবছর প্রবল ভারী আর অতি বর্ষণের ফলে কয়েকবার জলাবদ্ধতার কারণে পানিবন্দী হয়ে পড়ে। শুধু নিম্নাঞ্চল নয় নগরের অনেক উঁচু জায়াগাতেও পানি উঠে ঘর, দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ বিভিন্নস্থানে প্রবেশ করে, রাস্তাঘাট হাটুপানিতে ডুবে জন-দুর্ভোগ, দুর্দশা ও  ভোগান্তি বৃদ্ধি করে। চট্টগ্রামের জল্বদ্ধতা নিরসনের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৫ হাজার ৬ শত কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদনের পর চট্টগ্রামবাসীর আশা ভরসা আর প্রত্যাশা ছিল এ বছর চট্টগ্রামবাসীকে আর হাঁটু বা কোমড়পানির নীচে তলিয়ে যেতে হবে না। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, “শেষ হয়েছে ‘চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক মেগা প্রকল্পের মেয়াদ। এ বছর থেকে চট্টগ্রামবাসী চিরতরে জলাবদ্ধতার অভিশাপ হতে মুক্ত থাকার কথা। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও বাকি রয়ে গেছে অর্ধেক কাজ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে খালের রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, খাল পরিষ্কার, ড্রেন পরিষ্কার ও বড় করা, নতুন ড্রেন স্থাপন করাসহ বেশ কিছু কাজ করা হলেও সরু ড্রেন এবং খালের বিভিন্ন পয়েন্টে ময়লার স্তুপ জমে যাওয়া জলাবদ্ধতা থেকে এবারও মুক্তি মিলবে না নগরবাসীর”। {সূত্রঃ দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ জুলাই’২০}। চট্টগ্রামের দুঃখ হচ্ছে চাক্তাই খাল, সবসময় চাক্তাই খালের অবস্থা খুবই শোচনীয় থাকে। নগরীর বেশীরভাগ ময়লা আবর্জনা বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিনই চাক্তাই খালে এসে পড়ে। পাশাপাশি শাখা খালগুলোও ময়লা আবর্জনা জমে অনেকটা ভরাট হয়ে পড়ে। এবারের বর্ষায় ভারী এবং প্রবল বৃষ্টিপাত হলে ময়লার স্তূপের কারণে নগরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে যার প্রতিফলন গত ১৯ জুলাই’২০ তারিখের বৃষ্টিতে দেখা গেছে। জানা যায় জলাবদ্ধতা পরিহারের জন্য ম্যানুয়ালি শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে।

পূর্বে যা আশঙ্কা করা হয়েছিল বাস্তবে হয়েছেও তাই, গত ১৯ জুলাই’২০ রোববার ভোররাত থেকে চট্টগ্রামে মাঝারি থেকে ভারি বর্ষণ শুরু হয়। থেমে থেমে দুপুর পর্যন্ত মেঘলা আকাশ থেকে কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি কখনো মুষলধারে বৃষ্টি নামে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে ৩নং স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ভারী বৃষ্টিপাতের সঙ্গে জোয়ারের পানি মিলে চট্টগ্রাম নগরীর নিচু এলাকাগুলো হাঁটুপানিতে ডুবে যায়। “বিশেষ করে যেসব এলাকার নালা, ড্রেন ইতোমধ্যে পরিষ্কার করা হয়নি কিংবা জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে এমন বেশিরভাগ নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। গত রোববার (১৯ জুলাই’২০) সকাল আটটা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত নগরীর বহদ্দারহাট, চকবাজার, প্রবর্তক মোড়, মুরাদপুর, বাকলিয়া, চন্দনপুরা ডিসি রোড, রাহাত্তারপুল, পূর্ব বাকলিয়া, আগ্রাবাদ, গোসাইলডাঙ্গা মা ও শিশু হাসপাতাল, হালিশহর, মধ্যম হালিশহর, পাথরঘাটা, আছদগঞ্জ শুটকি পট্টি, রশিদ বিল্ডিং এলাকায় জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী”। {সূত্রঃ দৈনিক আজাদী, ১৯ জুলাই’২০}। আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, ১৯ জুলাই’২০ রোববার সকাল ৬টা থেকে জোয়ার শুরু হয়। আর দুপুর ১২টায় শুরু হয় ভাটা। জোয়ার ও ভাটার মধ্যে শেষ সময় পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। একদিকে বৃষ্টির পানি ও অন্যদিকে জোয়ারের পানি মিলে জলমগ্ন হয়ে পড়ে নগরীর অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকাগুলো। পানি ঢুকে পড়ে বাসাবাড়ি, অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও বিভিন্ন দোকানে। এতে করে দুর্ভোগ পোহাতে হয় নানা কাজে ঘর থেকে বের হওয়া মানুষজনকে। জলজটের মধ্যে জনবহুল ব্যস্ত মোড়গুলোতে যানজটে জনভোগান্তির মাত্রা বেড়ে যায়। বেলা ১১টায় আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের নিচ তলায় হাঁটু পানি উঠে।
এদিকে আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে- চট্টগ্রামের অধিকাংশ জায়গায় আজ অস্থায়ী দমকা বাতাস কিংবা ঝড়ো হাওয়ার সাথে থেমে থেমে মাঝারি থেকে ভারি ধরনের বৃষ্টি কিংবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। আর জোয়ারের সাথে ভারি বর্ষণে হাঁটুপানিতে ডুবেছে নগরীর নিচু এলাকাগুলো। আরেক সূত্র থেকে জানা যায়, চকবাজার এলাকার ‘অলিগলির ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা হলেও খালটি এখনো আবর্জনায় পূর্ণ। এতে বৃষ্টির পানি সহজে নামতে না পেরে চকবাজার এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। চকবাজার হতে রাহাত্তার পুল যাওয়ার বাকলিয়া এলাকার রাস্তাটির অনেক স্থানে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। এখানে অনেক দোকানে সকালে পানি ঢুকে গেছে।’সকাল থেকে আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। আগ্রাবাদ হোটেলের সামনে থেকে কমার্স কলেজ রোড, বিজ্ঞান যাদুঘরের সামনে হাঁটু পানি জমে। জলাবদ্ধতার কারণে সকালে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন অফিসমুখী লোকজন। পানিতে সিএনজি অটোরিকশার ইঞ্জিনে পানি ঢুকে অনেক গাড়ি বিকল হয়ে যায়। ব্যাটারি চালিত অনেক রিকশাও ওই এলাকায় বিকল হয়ে যানজট তৈরি করে বলে জানা যায়।

“সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মতে, প্রকল্পের ড্রেন সংস্কার, ড্রেন বড় করা, সিলট্যাপ স্থাপন, রেগুলেটর স্থাপন, রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ কাজ চলমান আছে। বৃষ্টি হলে পানি জমে এমন ২২টি স্থান নির্ধারণ করে পানি যাতে দ্রুত খালে চলে যেতে পারে সেজন্য ৫২ দশমিক ৮৮ কিলোমিটার ড্রেন বড় করা, ড্রেনের প্রশস্ততা ও গভীরতা বাড়ানোর কাজ চলছে। এরমধ্যে ৩৬ কিলোমিটার কাজ শেষ হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের সাথে সমন্বয় করে ২৪০ দশমিক ১১ কিলোমিটার ড্রেন পরিষ্কার করা হচ্ছে। ১০ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার নতুন ড্রেন তৈরি করা হয়েছে। একশ জন শ্রমিকের সমন্বয়ে চারটি টিম করে নিয়মিত খাল পরিষ্কার করা হচ্ছে। ৪টি রেসপন্স টিম তদারকিতে আছে। ৫টি খালের মুখে রেগুলেটর স্থাপনের কাজ চলমান আছে। প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ শাহ আলী বলেন, সার্বিকভাবে আমাদের কাজের অগ্রগতি প্রায় ৫২শতাংশ। করোনা, ভূমি অধিগ্রহণ সমস্যাসহ নানা কারণে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। এজন্য দুইবছরের সময় বৃদ্ধির জন্য আবেদন করা হয়েছে”। {সূত্রঃ দৈনিক পূর্বদেশ, ১৩ জুলাই’২০}।

এদিকে আরেক তথ্য থেকে জানা যায়, জলাবদ্ধতা থেকে নগরবাসীকে মুক্ত করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর কাজ শুরু করলেও পরিকল্পনামাফিক কাজে চালাতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। প্রকল্পভুক্ত ৩৬টি খালে কার্যক্রম শুরুর পর পদে পদে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে সংস্থাটিকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বাধা ছিলো-সরু খাল ও খালের পাশে রাস্তা না থাকা। খালের ময়লা অপসারণ কাজ চলমান থাকায় অনেক জায়গায় প্রযুক্তিগত সুবিধা কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। এতে পরিষ্কার করা অনেক খালের বিভিন্ন পয়েন্টে থেকে গেছে ময়লার স্তুপ। কোনও কোনও জায়গায় ময়লা জমে বাঁধ সৃষ্টি হয়েছে। আবার অনেক খালের মধ্যে ময়লার পরিমাণ এতই বেশি, প্রতিদিন পরিষ্কার করার পরও সেখানে ময়লার স্তুপ জমছে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ শাহ আলী বলেন, আমরা খালগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করেছি। যান্ত্রিকভাবে অনেক খালের বিভিন্ন অংশে ঢুকে কাজ করা সম্ভব হয়নি। সেখানে ম্যানুয়ালি শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করা হচ্ছে।  তিনি বলেন, আমাদের ড্রেনগুলোর একটি বড় সমস্যা হচ্ছে উপরের দিকে বড় এবং নিচের দিকে ছোট। এজন্য পানি জমে যায়। কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ না থাকায় আমরা সেখানে কাজ করতে পারছি না। ফলে বৃষ্টিপাত হলে উপরের অংশে পানি না জমলেও নিচের সরু অংশে এসে পানি বাধার মুখে পড়ে। তবে পানি চলাচলের পথটা আমরা পরিষ্কার করে দিয়েছি।

নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গৃহীত ৫ হাজার ৬শ ১৬ কোটি ৪৯ লক্ষ ৯০ হাজার টাকায় ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক মেগা প্রকল্পটি সঠিক সময়ে শেষ না হওয়ায় বর্ষাকালে বাকী সময়টুকু চট্টগ্রামবাসীকে আরো কতবার পানির ডুবতে হবে তা ভবিতব্যের হাতে তোলা রইল। আমাদের দেশের অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, প্রকল্প প্রণয়নের পর তা বাস্তবায়নের জন্য সুষ্টু, যথোপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণে ধীরগতি, প্রকল্পের কাজ দ্রুত এবং সুনির্দিষ্ট সময়ে শেষ করার ব্যাপারে সজাগ সতর্ক না থাকা। পরিকল্পনা অনুযায়ী অহেতুক সময় নষ্ট করে যথাসময়ে কাজে হাত না দেয়া। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সমন্বয়হীনতার অভাব প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। পাশাপাশি দেশ জনগণ এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার চরম অভাব রয়েছে। রয়েছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং সঠিকভাবে কাজ না করার বিভিন্ন অভিযোগ। ফলশ্রুতিতে যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ার প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি জনসাধারণের ভোগান্তি দুর্দশা দুর্ভোগ বৃদ্ধি পায়। তবে মেগা প্রকল্পের ব্যাপারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সংযুক্ত করায় চট্টগ্রামবাসী খুবই সন্তুষ্ট কেননা এতে কাজেরে গুণগতমান সঠিক থাকবে এবং অপচয় রোধ হবে, যথাসময়ে কাজ শেষ হবে।  তবে এক্ষেত্রে সিডিএ এবং চসিকের মধ্যে অনেক দ্বন্ধ সৃষ্টি হওয়ার ফলে মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে দেরীতে। পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সঙ্গে চুক্তিও অনেক বিলম্বে স্বাক্ষরিত হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে এ বছরও চট্টগ্রামবাসী জলাবদ্ধতার অভিশাপ, দুর্ভোগ, ভোগান্তি, দুর্দশা নিয়ে মারাত্মকভাবে শঙ্কিত।

0 Shares

২৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ