বছর শুরুতে বলতে চাই

রিমি রুম্মান ৫ জানুয়ারি ২০২০, রবিবার, ০১:৩৯:০২অপরাহ্ন সমসাময়িক ১৩ মন্তব্য

পরিবারটি বাংলাদেশ থেকে এসেছিল খুব বেশিদিন হয়নি তখনো। বেড়াতে এসে তারা থেকে গিয়েছিল এদেশে। টুরিস্ট ভিসায় পরিবারটি আমেরিকায় এসেছিল যদিও, কিন্তু পরবর্তীতে সন্তানদের উন্নত শিক্ষা এবং সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবে এদেশে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বাবা-মা দুই ভাইবোনকে এলিমেন্টারি (প্রাইমারি) স্কুলে ভর্তিও করিয়ে দিয়েছিলেন। নতুন নতুন ভিনদেশের স্কুলে যাওয়া তাদের। তীব্র উচ্ছাস আর ভালো লাগা নিয়ে রোজ দুই ভাইবোন স্কুলে যেত। খুব সহজেই নিউইয়র্ক শহরকে ভালোবেসে ফেলেছিল তাঁরা।  বছরের শেষ দিনগুলো এদেশে উইন্টার ভেকেশন থাকে। স্কুল বন্ধের ঠিক আগে দিয়ে স্কুলে বড় পরিসরে আনন্দমুখর পরিবেশে খ্রিসমাস পার্টি হয়। সেই বিকেলে দুই ভাইবোন গিয়েছিল বাড়ি থেকে কাছাকাছি দূরত্বে অবস্থিত নিজেদের স্কুল পার্টিতে। শীতের বিকাল মানেই এদেশে শহর জুড়ে রাত্রি নামা। শহুরে আঁধারে হলুদ বাতি জ্বলে উঠা। আলো-আঁধারিতে প্রশস্ত সড়কের কিনারে দাঁড়িয়েছিল তাঁরা রাস্তা পার হবে বলে। পথচারি পারাপারের বাতি জ্বলে উঠলে রাস্তা পার হবার সময় বিশাল বড় এক লরি বাঁয়ে মোড় নিতে গিয়ে ছেলেটিকে চাপা দিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই সে নিহত হয়। বোনের চোখের সামনেই প্রাণপ্রিয় ছোটভাইয়ের নির্মম মৃত্যু ঘটে! পরবর্তিতে ড্রাইভার পুলিশের কাছে স্বীকার করেছিলেন, কালো জ্যাকেট পরিহিত ছেলেটিকে আধো আলোয় সে দেখতে পায়নি। ছেলেটির বয়স তখন  আট কিংবা নয় ছিল। বেঁচে থাকলে এখন সম্ভবত সে হাইস্কুলে যেতো। ঠিক আমার বড় সন্তানের মতো।
আরেকবার এক খাঁ খাঁ ভর দুপুরের কথা। স্কুল ছুটি হয়েছে সবে। বড় সড়কের দুইপাশের ফুটপাত ধরে স্কুলের ছোট ছোট শিশুরা বাবা-মায়ের সাথে বাড়ির দিকে ফিরছিল। মায়ের সাথে বাড়ির পথে হাঁটছিল ৭/৮ বছরের নাম না জানা সেই শিশুটিও, যে শিশুটি রাস্তার অপরদিক থেকে খালামনির ডাক শুনে দৌড়ে ছুটে গিয়েছিল সিগন্যাল বাতির তোয়াক্কা না করে। ওমনি দ্রুতবেগে ছুটে আসা ভ্যানগাড়ির নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। চোখের সামনে এমন ঘটনার আকস্মিকতায় মা জ্ঞান হারায়। বেশ কয় বছর আগে এই শহরে ঘটে যাওয়া আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে খুব। মেয়েটি সুইট সিক্সটিন উপলক্ষে বাবা-মায়ের কাছে একটি সেলফোন আবদার করেছিল। বিশেষ এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে আর মেয়ের আবদার মেটাতে বাবা-মা কিনে দিয়েছিলেন শখের সেলফোন। দু’দিন বাদে স্কুল থেকে ফেরার পথে সাবওয়েতে ট্রেনের জন্যে অপেক্ষার সময়টাতে ফোনে কিছু দেখছিল মেয়েটি। আচমকা হাত ফসকে ফোনটি পড়ে যায় রেললাইনের উপর। বহু প্রতীক্ষিত শখের ফোনটি তুলতে মেয়েটি ঝাঁপিয়ে পড়ে রেললাইনের উপর। কিন্তু খুবই দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঝড়ের বেগে ছুটে আসা ট্রেন মর্মান্তিকভাবে মাত্র ষোল বছরের মেয়েটিকে পিষে দিয়ে যায়! জীবন দেখার আগেই একটি জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে! ঠিক একইভাবে ম্যানহাঁটনের রাস্তায় রাস্তা পার হবার সময় এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছিল দুর্ঘটনায়। সে রাস্তা পার হবার পর লক্ষ্য করলো তাঁর ফোনটি হাতে নেই। পিছনে তাকিয়ে দেখে মাঝরাস্তায় পড়ে আছে দামী ফোনটি। সে দৌড়ে ফিরে গেলো সেটি তুলে নিতে। কিন্তু হায়, ততক্ষণে সবুজ বাতি জ্বলে উঠায় দূর থেকে ছুটে আসা দ্রুতগামী একটি গাড়ি তাঁকে চাপা দিয়ে যায়।
এমন সংবাদগুলো শোনা যায় প্রতিনিয়ত। আমাদের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। নিজের সন্তানের কথা ভেবে আতংকিত হই। সচেতন হয়ে উঠি। সন্তানের বিষয়ে সব বাবা-মায়ের মন বোধ করি দুর্বল থাকে। কেননা, বিগত বছরগুলোতে অজানা আশংকায় আমি আমার সন্তানদের আর কখনোই কালো জ্যাকেট কিনে দেইনি। উজ্জ্বল রং এর জ্যাকেট কিনি, যেন রাস্তা পারাপারের সময় ড্রাইভারের নজরে পড়ে। তাঁদের সাথে প্রতিটি দুর্ঘটনার বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। চলতি পথে অমনোযোগিতার বিষয়ে সতর্ক করি। রাস্তার অপরপাশ থেকে কেউ ডাকলেই যেন ছুটে না যায়। কিংবা কখনো কোথাও ফোন পড়ে গেলে, কিছু হারিয়ে গেলে যেন হারানোর ব্যাথায় ব্যাথিত না হয়। জীবনের চেয়ে এইসব জিনিষের মুল্য তো আর কোনভাবেই বেশি নয়! যদিও জীবন যতক্ষণ আছে বিপদ ততক্ষণ থাকবেই। তবুও প্রত্যাশা, নতুন বছর সকলের জন্যে আনন্দমুখর হয়ে উঠুক।

0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ