পরিবারটি বাংলাদেশ থেকে এসেছিল খুব বেশিদিন হয়নি তখনো। বেড়াতে এসে তারা থেকে গিয়েছিল এদেশে। টুরিস্ট ভিসায় পরিবারটি আমেরিকায় এসেছিল যদিও, কিন্তু পরবর্তীতে সন্তানদের উন্নত শিক্ষা এবং সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবে এদেশে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বাবা-মা দুই ভাইবোনকে এলিমেন্টারি (প্রাইমারি) স্কুলে ভর্তিও করিয়ে দিয়েছিলেন। নতুন নতুন ভিনদেশের স্কুলে যাওয়া তাদের। তীব্র উচ্ছাস আর ভালো লাগা নিয়ে রোজ দুই ভাইবোন স্কুলে যেত। খুব সহজেই নিউইয়র্ক শহরকে ভালোবেসে ফেলেছিল তাঁরা। বছরের শেষ দিনগুলো এদেশে উইন্টার ভেকেশন থাকে। স্কুল বন্ধের ঠিক আগে দিয়ে স্কুলে বড় পরিসরে আনন্দমুখর পরিবেশে খ্রিসমাস পার্টি হয়। সেই বিকেলে দুই ভাইবোন গিয়েছিল বাড়ি থেকে কাছাকাছি দূরত্বে অবস্থিত নিজেদের স্কুল পার্টিতে। শীতের বিকাল মানেই এদেশে শহর জুড়ে রাত্রি নামা। শহুরে আঁধারে হলুদ বাতি জ্বলে উঠা। আলো-আঁধারিতে প্রশস্ত সড়কের কিনারে দাঁড়িয়েছিল তাঁরা রাস্তা পার হবে বলে। পথচারি পারাপারের বাতি জ্বলে উঠলে রাস্তা পার হবার সময় বিশাল বড় এক লরি বাঁয়ে মোড় নিতে গিয়ে ছেলেটিকে চাপা দিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই সে নিহত হয়। বোনের চোখের সামনেই প্রাণপ্রিয় ছোটভাইয়ের নির্মম মৃত্যু ঘটে! পরবর্তিতে ড্রাইভার পুলিশের কাছে স্বীকার করেছিলেন, কালো জ্যাকেট পরিহিত ছেলেটিকে আধো আলোয় সে দেখতে পায়নি। ছেলেটির বয়স তখন আট কিংবা নয় ছিল। বেঁচে থাকলে এখন সম্ভবত সে হাইস্কুলে যেতো। ঠিক আমার বড় সন্তানের মতো।
আরেকবার এক খাঁ খাঁ ভর দুপুরের কথা। স্কুল ছুটি হয়েছে সবে। বড় সড়কের দুইপাশের ফুটপাত ধরে স্কুলের ছোট ছোট শিশুরা বাবা-মায়ের সাথে বাড়ির দিকে ফিরছিল। মায়ের সাথে বাড়ির পথে হাঁটছিল ৭/৮ বছরের নাম না জানা সেই শিশুটিও, যে শিশুটি রাস্তার অপরদিক থেকে খালামনির ডাক শুনে দৌড়ে ছুটে গিয়েছিল সিগন্যাল বাতির তোয়াক্কা না করে। ওমনি দ্রুতবেগে ছুটে আসা ভ্যানগাড়ির নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। চোখের সামনে এমন ঘটনার আকস্মিকতায় মা জ্ঞান হারায়। বেশ কয় বছর আগে এই শহরে ঘটে যাওয়া আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে খুব। মেয়েটি সুইট সিক্সটিন উপলক্ষে বাবা-মায়ের কাছে একটি সেলফোন আবদার করেছিল। বিশেষ এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে আর মেয়ের আবদার মেটাতে বাবা-মা কিনে দিয়েছিলেন শখের সেলফোন। দু’দিন বাদে স্কুল থেকে ফেরার পথে সাবওয়েতে ট্রেনের জন্যে অপেক্ষার সময়টাতে ফোনে কিছু দেখছিল মেয়েটি। আচমকা হাত ফসকে ফোনটি পড়ে যায় রেললাইনের উপর। বহু প্রতীক্ষিত শখের ফোনটি তুলতে মেয়েটি ঝাঁপিয়ে পড়ে রেললাইনের উপর। কিন্তু খুবই দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঝড়ের বেগে ছুটে আসা ট্রেন মর্মান্তিকভাবে মাত্র ষোল বছরের মেয়েটিকে পিষে দিয়ে যায়! জীবন দেখার আগেই একটি জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে! ঠিক একইভাবে ম্যানহাঁটনের রাস্তায় রাস্তা পার হবার সময় এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছিল দুর্ঘটনায়। সে রাস্তা পার হবার পর লক্ষ্য করলো তাঁর ফোনটি হাতে নেই। পিছনে তাকিয়ে দেখে মাঝরাস্তায় পড়ে আছে দামী ফোনটি। সে দৌড়ে ফিরে গেলো সেটি তুলে নিতে। কিন্তু হায়, ততক্ষণে সবুজ বাতি জ্বলে উঠায় দূর থেকে ছুটে আসা দ্রুতগামী একটি গাড়ি তাঁকে চাপা দিয়ে যায়।
এমন সংবাদগুলো শোনা যায় প্রতিনিয়ত। আমাদের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। নিজের সন্তানের কথা ভেবে আতংকিত হই। সচেতন হয়ে উঠি। সন্তানের বিষয়ে সব বাবা-মায়ের মন বোধ করি দুর্বল থাকে। কেননা, বিগত বছরগুলোতে অজানা আশংকায় আমি আমার সন্তানদের আর কখনোই কালো জ্যাকেট কিনে দেইনি। উজ্জ্বল রং এর জ্যাকেট কিনি, যেন রাস্তা পারাপারের সময় ড্রাইভারের নজরে পড়ে। তাঁদের সাথে প্রতিটি দুর্ঘটনার বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। চলতি পথে অমনোযোগিতার বিষয়ে সতর্ক করি। রাস্তার অপরপাশ থেকে কেউ ডাকলেই যেন ছুটে না যায়। কিংবা কখনো কোথাও ফোন পড়ে গেলে, কিছু হারিয়ে গেলে যেন হারানোর ব্যাথায় ব্যাথিত না হয়। জীবনের চেয়ে এইসব জিনিষের মুল্য তো আর কোনভাবেই বেশি নয়! যদিও জীবন যতক্ষণ আছে বিপদ ততক্ষণ থাকবেই। তবুও প্রত্যাশা, নতুন বছর সকলের জন্যে আনন্দমুখর হয়ে উঠুক।
১৩টি মন্তব্য
ইঞ্জা
ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেলো আপু, আমার বাচ্চারা যখন ইউনিভার্সিটিতে থাকে, তখন শুধু আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকি, আজকে আপনার লেখাটি আমাকে কাঁদালো। 😢
সুপায়ন বড়ুয়া
ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেলো আপু,
একটি দুর্ঘটানা সারাজীবনের কান্না।
যার যায় সেই জানে
শুভ কামনা।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
মৃত্যু কষ্টের তাও এমন অকাল মৃত্যু মেনে নেয়া খুব কঠিন। যার যায় সেই বুঝে। ভালো থাকুন, শুভ কামনা রইলো
এস.জেড বাবু
অকাল মৃত্যূ মেনে নেয়া সত্যি অনেক কষ্টের। ওদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
প্রচন্ড রকম সচেতনতা দরকার-
বেঁচে থাকার জন্য সতর্কতা।
এযুগে আমাদের দেশে অন্যদের ড্রাইভিং এ সচেতন করার পাশাপাশি- নিজেকে সচেতন করে তুলতে হবে পাগল ড্রাইভারদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য।
প্রতিদিনই পত্রিকায় আট/দশ জন
আর কতকাল !!
ভালো থাকুন সবসময়।
সুরাইয়া পারভীন
মৃত্যু সবসময়ই কষ্টের। সেখানে অকাল মৃত্যু মেনে না সত্যিই অনেক বেশি কষ্টে। একটু সচেতনতাই পারে এই সব অনাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর কবল থেকে মানুষকে রক্ষা করতে। চমৎকার লিখেছেন
সাবিনা ইয়াসমিন
অকাল মৃত্যু কষ্টের হয়৷ বিশেষ করে দুর্ঘটনায় জনিত মৃত্যু মেনে নেয়া যায়না। সন্তানদের আব্দার-আহ্লাদ পুরণ করার পাশাপাশি তাদেরকে বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনাসমূহ সম্পর্কেও সচেতন করে তুলতে হয়।
নতুন বছরের শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা রইলো রিমি আপু। প্রবাসে ভালো থাকুন, নিরাপদে থাকুন।
শুভ কামনা 🌹🌹
সাদিয়া শারমীন
মন খারাপ হওয়ার মত লেখা।মৃত্যূ মানা খূব কঠিন বিষয়।
ফয়জুল মহী
লেখাটা হ্রদয় বিদারক । আল্লাহ সহায় হোন।
সঞ্জয় মালাকার
অকাল মৃত্যু কষ্টের হয়৷ বিশেষ করে দুর্ঘটনায় জনিত মৃত্যু মেনে নেয়া যায়না।
প্রচন্ড রকম সচেতনতা দরকার-
বেঁচে থাকার জন্য সতর্কতা।
ধন্যবাদ দিদি শুভ কামনা!
ছাইরাছ হেলাল
কোন মা বাবার জীবনে যেন এমন সন্তান-মৃত্যুর বিষ অনুভব করতে না হয়।
নূতন বছরে এই হোক প্রার্থনা।
তৌহিদ
এমন মৃত্যু কাম্য নয়। লেখাটি পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল আপু।
ভালো থাকবেন সবসময়।
ইসিয়াক
লেখাটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল। আল্লাহ সবার সহায় হোন।
ভালো থাকুন সবসময়।
জিসান শা ইকরাম
লেখাটি গতকালই পড়েছি, মনটা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল সন্তানদের এমন মৃত্যুতে,
যাদের সন্তানরা এমন ভাবে চলে গিয়েছে তারা কত কষ্টের মাঝে আছেন, তা অনুধাবন করতে পারছি।
সন্তানদের এ বিষয়ে সতর্কতা মুলক জ্ঞান দানই পারে এই ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করতে।
নতুন বছরের শুভেচ্ছা নিও দিদি ভাই।