iDxJmGLYdGEv

‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে গোপালগঞ্জ শহর মুখরিত হয়ে উঠল। নেতারা জনসমাগম দেখে খুবই আনন্দিত হলেন। সভা হবে, কিন্তু প্যান্ডেল গত রাতে ঝড়ে ভেঙে গিয়েছে। নৌকার বাদামগুলি ছিঁড়ে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে। সেই ভাঙা প্যান্ডেলে সভা হল। রাতেই সকলে বিদায় নিলেন। আমার অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে গেল। এত টাকা আমি কোথায় পাব? বাদামগুলি ছিঁড়ে গেছে, এখন তো কেউই এক টাকাও দিবে না। নেতারাও কেউ জিজ্ঞেস করলেন না। যাদের বাদাম এনেছিলাম, তারা অনেকেই আমাকে স্নেহ করত। তারা অনেকেই অর্থশালী, আর তাদের ছেলেরা প্রায়ই আমার দলে। অনেকে ছেঁড়া বাদাম নিয়ে চলে গেল, আর কিছু লোক উস্কানি পেয়ে বাদাম নিতে আপত্তি করল। তারা টাকা চায়, ছেঁড়া বাদাম নেবে না, আমি কি করব? মুখ কালো করে বসে আছি। অতিথিদের খাবার বন্দোবস্ত করার জন্য আমার মা ও স্ত্রী গ্রামের বাড়ি থেকে গোপালগঞ্জের বাড়িতে এসেছে তিন দিন হল। আমার শরীরও খারাপ হয়ে পড়েছে অত্যাধিক পরিশ্রমে। বিকালে ভয়ানক জ্বর হল। আব্বা আমাকে বললেন, “তুমি ঘাবড়িয়ে গিয়েছ কেন?” আব্বা পূর্বেও বহু টাকা খরচ করেছেন এই কনফারেন্স উপলক্ষে। বড়লোক তো নই কি করে আব্বাকে বলি। আব্বা নিজেই সমাধান করে দিলেন। যাদের ব্যবসা ভাল না, তাদের কিছু কিছু টাকা দিয়ে বিদায় দিলেন। একজন ব্যবসায়ী যার আট, দশটা বাদাম নষ্ট হয়েছে তিনি পুরা টাকা দাবী করলেন, না দিলে মামলা করবেন। আব্বা বললেন, “কিছু টাকা আপনি নিয়ে এগুলি মেরামত করায়ে নেন। মামলার ভয় দেখিয়ে লাভ নাই। যারা পরামর্শ আপনাকে দিয়েছে, তারা জানে না আপনার বাদাম যে এনেছি তা প্রমাণ করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে।” আমার জ্বর ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোক উকিলের নোটিশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সাহস করে আর মামলা করেন নাই।

রেণু কয়েকদিন আমাকে খুব সেবা করল। যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোটবেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়। জ্বর একটু ভাল হল। কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। লেখাপড়া তো মোটেই করি না। দিনরাত রিলিফের কাজ করে কূল পাইনা। আব্বা আমাকে এসময় একটা কথা বলেছিলেন, “বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখ, ‘sincerity of purpose and honesty of purpose’ থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না।” একথা কোনোদিন আমি ভুলি নাই।

আর একদিনের কথা, গোপালগঞ্জ শহরের কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি আমার আব্বাকে বলেছিলেন, আপনার ছেলে যা আরম্ভ করেছে তাতে তার জেল খাটতে হবে। তার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে, তাকে এখনই বাধা দেন। আমার আব্বা যে উত্তর করেছিলেন তা আমি নিজে শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, “দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো করছে না; যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে; তাতে আমি দুঃখ পাব না। জীবনটা নষ্ট নাও তো হতে পারে, আমি ওর কাজে বাধা দিব না। আমার মনে হয়, পাকিস্তান না আনতে পারলে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না।” অনেক সময় আব্বা আমার সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করতেন। আমাকে প্রশ্ন করতেন, কেন পাকিস্তান চাই? আমি আব্বার উত্তর দিতাম।

অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং-২০ হতে ২২)

বিঃ দ্রঃ অনিবার্য কারণবশত গতকালের নির্ধারিত পোস্টটি করতে দেরী হওয়ায় ত্রুটি মার্জনীয়।

অসমাপ্ত আত্মজীবনী-পর্ব-১৫

0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ