শান্তিতে ঘুমাচ্ছিল দীপ, জগৎ জ্যোতি, জাফর মুন্সি, শান্ত ও ত্বকী। হঠাৎ স্বর্গের প্রহরীই হবে হয়তো, তাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটালো। একটু বিরক্ত হয়েই তারা জিজ্ঞেস করলো- কি হয়েছে, ঘুম ভাঙ্গালেন কেন?
স্বর্গের প্রহরী হাসিমুখে বলল- আপনারা যখন এখানে এসেছিলেন, তখন বলেছিলেন যেনো কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় দেবার দিন আপনাদের জানাই আমি। আজ সেই দিন।
মুহূর্তেই বিরক্তিময় মুখে হাসির একটা উজ্জ্বল আভা খেলে যায় সবার মুখে। জাফর মুন্সী আনন্দে কেঁদেই দিল।
সবার মন উসখুশ করছে, স্বর্গকেই নরক মনে হচ্ছে যেন। সবার মনেই একই ইচ্ছা, যদি একটু নিচে নামা যেতো তাহলে শাহবাগে একবার ঢু মেরে আসতো।
ত্বকীর বয়স কম, জিদটাও বেশি। ছেলেটা বলেই বসল- রাজীব ভাই, এখানে বসে থাকতে ভাল্লাগছে না, চলেন বিধাতাকে পটিয়ে একদিনের জন্য দুনিয়ায় নামার ব্যবস্থা করা যায় কিনা, সবাই একসঙ্গে শাহবাগে গিয়ে একটু স্লোগান দিয়ে আসি।
শান্তর মনে খুশির ঢেউ খেলে গেল এ প্রস্তাবে। সে যে অনেকদিন স্লোগান দেয় না। সবাই গেল বিধাতার কাছে একটা দাবি নিয়ে। বিধাতা তাদের জোরাজুরিতে একদিনের জন্য বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন, শর্ত দিলেন শুধু শাহবাগ যাওয়া যাবে আর কোথাও না। সবাই খুশিমনে মেনে নিল।
সবাই এখন শাহবাগে। এখানে অনেক মানুষের ভীড়। স্লোগানে মুখরিত সেই চেনা শাহবাগ। শান্তই প্রথম শুরু করলো স্লোগান- “ক-তে কাদের মোল্লা।” ত্বকী, দীপ, রাজীব, জাফর মুন্সী, জগৎ জ্যোতি সবাই একসাথে বলে উঠলো-“তুই রাজাকার, তুই রাজাকার।” জনতাও তখন বলছিল-“তুই রাজাকার, তুই রাজাকার।” জনতার চোখে মুখে একই সাথে খুশি ও ঘৃণা। এ এক অন্য অনুভুতি, সবাই না বুঝলেও স্পষ্ট বুঝতে পারছে রাজীব, শান্ত, জাফর, ত্বকী, জগৎ জ্যোতি, দীপেরা। শেষ কবে জনতার স্লোগানের সাথে গলা মিলিয়েছিল মনে করার চেষ্টা করে তারা, কিন্তু এতো ভাববার সময় কই। এই একটা দিনের ছাড়পত্র পেয়ে শাহবাগে এসেছে, ভেবে সময় নষ্ট করে পরে পস্তাতে চায় না কেউ।
শান্তর খুব ইচ্ছা করছে লাকি মেয়েটার কাছ থেকে মাইক্রোফোন কেড়ে নিয়ে স্লোগান দিতে। সবাইকে টেনে সেখানে নিয়ে গেল শান্ত সেখানে। লাকিকে ডাকলো কবার, কিন্তু লাকি শুনতেই পাচ্ছে না যেন। শাম্মিকেও ডাকলো, কেউ শুনছে না। ত্বকির মাথাটা গরম হয়ে গেল- এতো ভাব নেবার কি আছে ভেবে পাচ্ছে না সে। চিৎ কার দিয়ে বললো সে- লাকি আপু, শুনছেন না কেন আমাদের কথা, কি ভেবেছেন নিজেকে? শুধু আপনিই স্লোগান দিতে জানেন, আমরা বুঝি পারি না?
তবুও স্লোগান দিতে থাকে লাকিরা। জাফর মুন্সির হঠাৎ মনে পড়ে গেল সব। ত্বকিকে বুকে টেনে নিয়ে বলল- চুপ কর বাবা, এরা আমাদের কথা শুনতে পারবে না। তারা এই দুনিয়ার মানুষ, আমরা এখন ভিন্নজগতের মানুষ। এখানে আমরা অতিথি হয়ে এসেছি, কিন্তু আমাদের আপ্যায়নের জন্য কেউ বসে নেই।
শান্ত, রাজীব, জগৎ জ্যোতি, দীপেরও মনটা হু হু করে কেঁদে ওঠে। তারা ফিরে যেতে লাগলো, এখানে এসে তাদের খুব অসহায় বোধ হতে লাগলো, এর চেয়ে ফিরে যাওয়াই উত্তম। যেদিন কাদের কসাইয়ের সত্যি সত্যি ফাঁসি হবে, সেদিন সেই ফাঁসি দেখতে আসাটাই ভাল হবে। আজ এসেছে বলে যদি আবার বিধাতা ফাঁসি কার্যকরের দিন না আসতে দেয়, তখন কি হবে!!
জনতার ভীড়ে এসব ভাবতে ভাবতে হাটছিল ওরা কজন। হঠাৎ কে একজন মঞ্চ থেকে রাজীব, দীপ, জাফর মুন্সী, জগৎ জ্যোতি, শান্ত ওদের নাম উচ্চারণ করলো। ওরা কজন চোখভরা বিষ্ময় নিয়ে ঘুরে তাকালো মঞ্চের দিকে। নাহ্, তাদের ডাকছে না তবে তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করছে। সবাইকে নীরবতা পালন করতে বলছে তাদের কথা স্মরণ করে।
সবাই এখন নিশ্চুপ। ওরা কজন নিশ্চুপ জনতাদের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে, চোখে অশ্রু চিক চিক করছে তাদের। দীপ হঠাৎ চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। নিশ্চুপ নীরবতা ভেঙ্গে গেছে বলে চমকে উঠলো বাকি কজন, জনতার কেউ চমকালো বলে মনে হলো না। শুধু একজন বাবার কোলে ৩ বছরের একটা বাচ্চা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দীপের দিকে, কি জানি সে আসলেই দেখতে পাচ্ছে কিনা তাদের? দেখতে পেলেই বা কি? একটু পরেই হয়তো মায়ের কোলে ঝাপিয়ে পড়ে খিললখিল করে হাসবে পিচ্চিটা, কিছু দেখেছিল তাও তার মনে থাকবে না, তবু স্বান্তনা- দেখেছে হয়তো কেউ।
দীপ অঝোরে কাঁদছে, তার মাকে মনে করে, সুন্দর দেশটার কথা মনে করে। সেই কান্নায় মিলেছে ওরা কজনা। পিচ্চিটাও কাঁদছে, হয়তো তার মায়ের কাছে ফিরে যাবার জন্যই। জনতার স্লোগানে কান্নাগুলো মিশে যায়, মিশে যায় লাখো শহীদের, সম্ভ্রমহারাদের কান্না, মিশে যায় গভীর দেশপ্রেম।
(এটা আমার কল্পনায় ঘটে যাওয়া ঘটনা, কল্পনা তো কল্পনাই হয়)
২৪টি মন্তব্য
আদিব আদ্নান
এমন খুশির দিনে এর থেকে ভাল কল্পনা আর কিছুই হতে পারে না ।
ফাহিমা কানিজ লাভা
খুশি তো সেইদিন পূর্ণতা পাবে, যেদিন সব শয়তানগুলা ফাঁসিতে ঝুলে মরবে।
লীলাবতী
লেখাটি পড়ে চোখ হতে পানি গড়িয়ে নামলো আপি ।
ফাহিমা কানিজ লাভা
🙁
আমার মন
কথা একটাই। রক্ত দিয়ে নাম লেখেছি, বাংলাদেশের নাম।
ফাহিমা কানিজ লাভা
রক্ত দিয়ে নাম লেখা দেশে কোন রাজাকার থাকতে পারবে না।
জিসান শা ইকরাম
অসাধারণ লিখেছেন ।
দীপ, জগৎ জ্যোতি, জাফর মুন্সি, শান্ত ও ত্বকীদের আত্মা অবশ্যই শান্তি পাবে কোন একদিন , যেদিন রাজাকারদের ফাসী কার্যকর হওয়া শুরু হবে ।
লেখকের চিন্তা শক্তির প্রশংসা করছি আন্তরিক ভাবে।
শুভকামনা ।
ফাহিমা কানিজ লাভা
জাতি অপেক্ষায় আছে ফাঁসির রায় কার্যকরের দিনগুলো দেখার জন্য। ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য ভাইয়া।
ছাইরাছ হেলাল
সব কল্পনা কল্পনা নয় ।
সবার কান্না একদিন সত্যি মুছে যাবে ।
ফাহিমা কানিজ লাভা
সবার কান্না একদিন সত্যি মুছে যাবে।
নীহারিকা
লেখাটিকে অসাধারণ বললেও কম বলা হয় । আপনার লেখা এই প্রথম পড়লাম মনে হয়। তাঁদের অপূর্ণ ইচ্ছে যেন পূর্ণ করতে পারি আমরা।
ফাহিমা কানিজ লাভা
ধন্যবাদ আপু। আশা রাখি তাদের অপূর্ণ আশা পূরণ হবে জলদি।
খসড়া
এমন খুশির দিনে কাদতে নেই
সাজিয়ে রাখ আতর গোলাপ
একাকার করে মন রাখতে নেই
ওরা আসবে চুপি চুপি
যারা এই দেশটাকে
ভালবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ
——-
ফাহিমা কানিজ লাভা
অসাধারণ একটা গান, শুনলেই কান্না এসে যায়।
কৃন্তনিকা
অনেক ভালো লাগলো… (y) (y) (y) আমরা সবাই এখনো আশাবাদী…
ফাহিমা কানিজ লাভা
ধন্যবাদ। আমরা আশাবাদী।
জি.মাওলা
ভাল লাগল। আপরাধীদের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন । কিন্তু রাউ নিয়ে রাজনীতি মেনে নেওয়ে যায় না
ফাহিমা কানিজ লাভা
যেখানে রাজাকারদের লালন-পালন করে একটা দল, সেখানে রাজনীতি তো হবেই। তবে যাই হোক, ফাঁসি দিলেই আমরা খুশি।
আফ্রি আয়েশা
চমৎকার কল্পনা , অসাধারন লেখা । ভাললাগা জানবেন ।
ফাহিমা কানিজ লাভা
ধন্যবাদ আপু।
বনলতা সেন
সব কল্পনা কল্পনা নয় ।
কল্পনা এবার আনন্দ বাস্তবেই ।
ফাহিমা কানিজ লাভা
🙂
সীমান্ত উন্মাদ
চমৎকার পোষ্টে ভালোলাগা নিরন্তর। শুভকামনা জানিবেন সব সময়।
ফাহিমা কানিজ লাভা
ধন্যবাদ।