"প্রিয়া সাহা" নামটি গত তিন চারদিন ধরে দেশের অনলাইন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সবচেয়ে সমালোচিত নাম। কে এই প্রিয়া সাহা আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কেন, কীভাবে তিনি সাক্ষাৎ করলেন? প্রিয়া সাহা কি বলেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যার পরিপেক্ষিতে সোশ্যাল মিডিয়ার তীব্র সমালোচিত হচ্ছেন তিনি? এসবকিছু নিয়েই আমার আজকের এই লেখা।

কে এই প্রিয়া সাহা?

প্রিয়া সাহা, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ -খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সাংগঠনিক সম্পাদক । এছাড়াও তিনি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ‘শারি’-এর নির্বাহী পরিচালক হিসেবেও দায়িত্বরত । তার গ্রামের বাড়ী পিরোজপুর জেলার চরবানিরীর মাটিভাঙ্গা নাজিরপুর গ্রামে।

প্রিয়া সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করাকালীন সময়ে রোকেয়া হলে থাকতেন। সে সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি ‘মহিলা ঐক্য পরিষদ’ এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য গতবছর তাকে মহিলা ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে ‘শারি’ এনিজিও সংস্থার মাধ্যমে প্রিয়া নিজ এলাকার দলিত সম্প্রদায়কে নিয়ে কাজ করেন। তার স্বামী মলয় সাহা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক। কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রিয়া সাহার দুই মেয়ে বসবাস করছেন।

প্রিয়া সাহা মার্কিন মুল্লুকে কেন?

কিছুদিন আগে তিনি মেয়েদের কাছে বেড়াতে যান। এসময় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আমন্ত্রণে খুব অল্প সময়ের প্রস্তুতিতে সংখ্যালঘুদের অধিকার সম্পর্কিত একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেয়াও তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো। ঐ অনুষ্ঠানের মাঝে হঠাৎ করেই আয়োজকদের পক্ষ থেকে হোয়াইট হাউজে যাওয়ার কথা বলা হয় তাকে।

গত ১৬ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতা বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে হোয়াইট হাউজে কথা বলেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ঐ অনুষ্ঠানে প্রিয়া সাহা ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এবং দুজন রোহিঙ্গা প্রতিনিধিও ছিলেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে তার করা অভিযোগগুলি কি কি?

বাংলাদেশি পরিচয়ে প্রিয়া সাহা উপস্থিত হয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করেন, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান নিখোঁজ রয়েছেন। দয়া করে আমাদের লোকজনকে সহায়তা করুন। আমরা আমাদের দেশে থাকতে চাই।

এরপর তিনি বলেন, এখন সেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘু রয়েছে। আমরা আমাদের বাড়িঘর খুইয়েছি। তারা আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, তারা আমাদের ভূমি দখল করে নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো বিচার পাইনি।

এক পর্যায়ে ট্রাম্প নিজেই সহানুভূতিশীলতার স্বরূপ এই নারীর সঙ্গে হাত মেলান। এ সময় ট্রাম্প প্রশ্ন করেন, ‘কারা জমি দখল করেছে, কারা বাড়ি-ঘর দখল করেছে?’

ট্রাম্পের প্রশ্নের উত্তরে প্রিয়া সাহা বলেন- তারা মুসলিম মৌলবাদি গ্রুপ এবং তারা সব সময় রাজনৈতিক আশ্রয় পায়, সব সময়ই পায়।

সোশ্যাল মিডিয়া এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের তোপের মুখে প্রিয়া সাহা-

মার্কিন টিভি চ্যানেল এবিসি নেটওয়ার্কের চ্যানেল এবিসি ফোর ট্রাম্পের সঙ্গে প্রিয়া সাহার সেই সাক্ষাতকারের ভিডিও প্রকাশ করে। এর পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সেটি। যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে দেশ-বিদেশে বাংলাদেশিরা নানা ধরণের মন্তব্য করছেন। সাক্ষাতের এই ভিডিও ফুটেজ সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে, বাংলাদেশেও তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়।

বাংলাদেশেরচসরকারী কয়েকজন মন্ত্রীও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন যে আমেরিকান প্রেসিডেন্টের কাছে মিথ্যা এবং কাল্পনিক বক্তব্য দিয়ে প্রিয়া সাহা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছেন। সোশ্যাল মিডিয়াতেও প্রিয়া সাহাকে লক্ষ্য করে তীব্র গালমন্দ শুরু হয়।

তার বিরুদ্ধে ঢাকার একটি আদালতে দেশদ্রোহিতার মামলা নিতে আর্জি করেন দু'জন আইনজীবী যদিও সেগুলো আদালত খারিজ করে দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র এবং আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় তার এক ফেসবুক পোস্টে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, উদ্দেশ্যমূলক-ভাবে তারা প্রিয়া সাহাকে ওয়াশিংটনে পাঠিয়েছে। তারা জানে প্রিয়া সাহাকে নিয়ে গেলে তিনি সেখানে এধরনের ক্রুদ্ধ ও আপত্তিকর আপত্তিকর বক্তব্য দেবেন।

পিরোজপুরে প্রিয়া সাহার এনজিও শারি'র ২৫ জন সদস্য তার এহেন কর্মকান্ডকে দেশবিরোধী আখ্যা দিয়ে পদত্যাগ করেছেন।

প্রিয়া সাহার আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজের দেয়া বক্তব্য-

প্রিয়া সাহা আমেরিকার এক সাংবাদিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন- তিন কোটি ৭০ লাখ সংখ্যালঘু নিখোঁজ হবার এই তথ্য তিনি সরকারি পরিসংখ্যান থেকে পেয়েছেন।

২০০১ সালের পরিসংখ্যানে সংখ্যালঘুদের ওপর একটি চ্যাপ্টার রয়েছে। সেনসাস ( আদম শুমারি) অনুসারে দেশভাগের সময় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ২৯.৭ শতাংশ। এখন তা কমে ৯.৭ শতাংশ।"

প্রিয়া সাহা বলেন, অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাত ২০১১ সালে এক গবেষণা করে দেখিয়েছেন, প্রতিদিন গড়ে ৬৩২ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক হারিয়ে যাচ্ছে।

তার প্রতি আনা দেশদ্রোহীতার অভিযোগ খন্ডাতে তিনি বলেন- "ঐ গবেষণা কাজের সাথে আমিও জড়িত ছিলাম। সুতরাং আমি বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত।"

আমাদের দেশের উপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের আন্তর্জাতিক চাপ এবং একজন শেখ হাসিনা-

বাংলাদেশ শান্তিপ্রিয় দেশ। একজন শেখ হাসিনা যেভাবে নিজের ব্যক্তিত্ব এবং কূটনৈতিক পারদর্শিতা দেখিয়ে বাংলাদেশকে সবসময় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত রাখছেন তাতে তিনি অবশ্যই সাধুবাদ পাবার যোগ্যতা রাখেন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না - পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কিন্তু আমাদের সেন্টমার্টিনকে মার্কিন সেনা ঘাঁটি হিসেবে পেতে চেয়েছিলেন। রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে হটাতে মিয়ানমারে সাথে বাংলাদেশের হয়ে যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা অত্যন্ত সুকৌশলে আমাদের দেশের নিজেদের সমস্যা বলে এসব কথা সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়েছেন। সেইসব আন্তর্জাতিক চাপ কিন্তু এখনো আছে আমাদের উপর।

"প্রিয়া সাহাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে, তার আগে কোনও রকম আইনি ব্যবস্থা নয়" - শেখ হাসিনার এই একটি কথাই প্রমাণ করে তিনি কতটা কৌশল অবলম্বন করেছেন আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের দেশের জন্য অমঙ্গলজনক যাতে কিছু না হয়। দেশবিরোধী সুবিধাভোগীরা যাতে কোনোরকম অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে অন্যায় সুযোগ নিতে না পারে সেদিকে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই বক্তব্য এবং নির্দেশনার মধ্যে।

প্রিয়া সাহা বলেছেন- হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে তিনি নাকি যুক্তরাষ্ট্রে যাননি এবং সংগঠনের নেতারাও তার সফরের কথা জানেন না। তাহলে মার্কিন মুল্লুকে কে বা কারা তাকে পাঠালো এবং যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাতকার করার জন্য সময় চেয়ে অন্যান্য অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগন পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকেন, সেখানে প্রিয়া সাহাকে কারা বাংলাদেশের বিরূদ্ধে এমন উষ্কানিমূলক বক্তব্য দেয়ার জন্য তাকে সহযোগীতা করেছে, এসবের ইন্ধনদাতা কারা কারা এর সবকিছুই তদন্ত করে বের করা উচিত।

প্রিয়া সাহা ট্রাম্পের কাছে এভাবে অভিযোগ করে অবশ্যই ঠিক কাজ করেননি। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য এটি চরম অপমানজনক। আমাদের দেশের সমস্যা আমরা কেন অন্য দেশের কাছে নালিশ করবো? যদিও অন্য দেশের কাছে অভিযোগ করার এই প্রথাটি আমাদের বহু দিনের রাজনৈতিক প্রচলিত ধারা।

আমরা সাম্প্রদায়িকতার একটি সুন্দর বাংলাদেশ চাই। দেশে নানান সময়ে নানান রকম বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে এটা অস্বীকার করবোনা তবে বাংলাদেশকে যেন আমরা কেউই অসাম্প্রদায়িক বলে অন্য দেশের কাছে নিজেদের ছোট না করি সেদিকে সু-দৃষ্টি রাখা সবারই নৈতিক কর্তব্য।

 

সূত্রঃ বিবিসি নিউজ, যুগান্তর অনলাইন।

0 Shares

২৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ