প্রবাসে নতুন প্রজন্মের বাংলা চর্চা — ২

রিমি রুম্মান ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, মঙ্গলবার, ১২:৫২:৫১অপরাহ্ন সমসাময়িক ৬ মন্তব্য

গত বসন্তে সপরিবারে এক বন্ধুর বাসায় রাতের খাবারের নিমন্ত্রণে যাই। সেখানে আমাদের সন্তানরা কেউ কেউ যখন জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল, কেউবা গেইম খেলায় মগ্ন, ঠিক সেইসময়ে কলেজ পড়ুয়া এক বন্ধু কন্যাকে বাংলা ভাষার পত্রিকায় গভীর মনোনিবেশ করতে দেখে তার মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ও কী বাংলা পড়তে পারে ? জানালেন মেয়েটি বাংলা পড়তে এবং লিখতে পারে। আমি দ্বিগুণ উৎসাহের সাথে জিজ্ঞেস করি, কীভাবে শেখালেন ? বললেন, সন্তান ছোট থাকতেই তিনি বেশ সচেতন ছিলেন মাতৃভাষা শেখানোর বিষয়ে। গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময়টাতে যখন পড়ার চাপ থাকে না বললেই চলে, সেই সময়টা বেছে নেন তিনি শেখানোর জন্যে। দেশ থেকে আদর্শ লিপি সহ ছোটদের বাংলা শিক্ষার বেশ কিছু বই আনিয়ে নিয়েছেন। সরাসরি সেইসব বই থেকে লেখা এবং উচ্চারণ শিখিয়েছেন। যেমন করে আমাদের মায়েরা আমাদের শিখিয়েছেন, ঠিক তেমন। এতে তিনি কখনোই রোমান হরফের আশ্রয় নেননি। রেকর্ড প্লেয়ারে বাংলা ছড়াগান কিংবা কবিতা ছেড়ে দিতেন সন্তানদের অবসর সময়ে। ছুটির দিনে বাংলা গল্পের বই পড়ে শোনাতেন। কখনোবা নিজে শ্রোতা হয়ে ওদের পড়তে বলতেন। এমন করে নানান কায়দায় বছরের বাকি সময়ে অল্প বিস্তর হলেও চর্চাটা চলমান রেখেছেন।

মাঝে মাঝে আমার এক আত্মীয় সপরিবারে বেড়াতে আসেন নিউইয়র্কে। তারা থাকেন অন্য রাজ্যে। সেখানে হাতে গোণা কিছু বাঙালি পরিবার বসবাস করে যদিও, কিন্তু সংখ্যায় একেবারেই নগন্য। সেইদিক থেকে হিসেব করলে নিউইয়র্ক নগরীতে আমরা অধিক সংখ্যক বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের সাথে মেলামেশার সুযোগ পাই। সপ্তাহান্তে একাধিক দেশীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত থাকার সুযোগ পাই। কিন্তু আমার আত্মীয়ের পরিবারের সেই অনুপাতে মোটেও এমন সুযোগ হয়ে উঠে না। বেড়াতে এলে যে কয়দিন আমার বাসায় অবস্থান করেন, আমি বেশ বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছি, তাদের এদেশে জন্ম এবং বেড়ে উঠা কন্যাদ্বয় স্পষ্ট উচ্চারণে একে অপরের সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলছে। তাদের মাকে প্রশ্ন করেছিলাম, এতো সুন্দর শুদ্ধ বাংলা শিখলো কোথা থেকে ? কন্যারা কি কোন বাংলা স্কুলে শিক্ষা নিয়েছে ? কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ? জানলাম, প্রবলভাবে ধার্মিক পরিবারটি কোন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত নয়। যে রাজ্যে পরিবারটির বসবাস, সেখানে কোন বাংলা স্কুল গড়ে উঠেনি। স্বল্প সংখ্যক বাঙালি বসত গেড়েছে কেবল। তবে ? তিনি জানালেন, ' এদেশের নাগরিক হিসেবে স্কুলে আমাদের শিশুরা ইংরেজি শিখবেই, এতে কোন সন্দেহ নেই। ঘরের বাইরে ইংরেজি বলুক, তাতেও কোন আপত্তি নেই। কিন্তু বাড়িতে কড়াকড়িভাবে ইংরেজি বলা নিষিদ্ধ। আমার সন্তানরা বুঝুক আর না-ই বুঝুক, আমি তাদের সাথে একজন পরিণত মানুষের মত করে খাঁটি বাংলা ভাষায় কথা বলি। তাদের বুঝানোর সুবিধার্থে আধা বাংলা আর আধা ইংরেজিতে কথা বলি না একেবারেই। কারণ এতে শিশুরা পুরোপুরিভাবে বাংলা ভাষাটা রপ্ত করতে শেখে না।' দুটো ঘটনা থেকে শতভাগ এই উপলব্ধি হোল যে, বাড়িতে বাবা-মায়ের আন্তরিকতা এবং সচেতনতার কারণেই প্রবাসে নতুন প্রজন্মের অনেকেই স্পষ্ট উচ্চারণে নিজেদের মাঝে বাংলায় অনর্গল কথা বলতে শিখেছে।

আমি যখন আমার শিশু সন্তানকে নিয়ে দেশে বেড়াতে গেলাম, দেখলাম সে আত্মীয়দের সাথে বসে কাঁঠাল খাচ্ছে অথচ উচ্চারণটা সঠিকভাবে করছে না। তাকে বিভিন্নভাবে ভেঙ্গে ভেঙ্গে উচ্চারণটি শেখাচ্ছিলাম। সে কখনো বলছে কাটাল, কখনো আবার কাটঠাল উচ্চারণ করছিল। কা শব্দটি বলার পর জিভ দিয়ে  কীভাবে ঠ শব্দটি উচ্চারণ করতে হয় বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। আমি চাচ্ছিলাম সে আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠালকে কাঁঠাল হিসেবেই চিনুক, জানুক। জ্যাক্‌ফ্রুট হিসেবে নয়। আর তাই অনেকটা নিরুপায় আমি বাধ্য হয়েই রোমান হরফের আশ্রয় নেই। তাকে কাগজে লিখে কা (kaa ) ঠা (tha) ল (l) অর্থাৎ kaathal এভাবে শেখাতে হয়েছে। যদিও এই পদ্ধতি আমার নিজেরই পছন্দ নয়, তবুও মনে হয়েছিল, সে যদি আওয়াজটা শেখে, তবে সে শব্দ শিখবে, শব্দ শেখা হলে তবেই না ভাষাটা রপ্ত করতে পারবে। আগে বলতে শিখুক, সঠিক উচ্চারণ জানুক। মাতৃভাষা শেখা এবং মাতৃভাষার প্রতি যে দরদ দেখেছি আমার প্রতিবেশিদের মাঝে, তা অনুকরণীয় বটে। আমার সন্তানরা প্রতি গ্রীষ্মে বাসার সামনের লনে যখন খেলা করে প্রতিবেশি অন্য অনেক শিশুদের সাথে, লক্ষ্য করলাম যেহেতু প্রতিবেশিরা সকলেই চীনা, তাই সেইসব শিশুরা তাদের মাতৃভাষায় নিজেদের মাঝে অনর্গল কথা বলে। প্রতিবেশি কলেজ পড়ুয়া চীনা মেয়েটির কাছে জানলাম কেমন করে তারা তাদের ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এ বিষয়ে ফাং হুয়া নামের মেয়েটির ভাষ্য, কর্মস্থলে কিংবা স্কুলে ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে হয় যদিও, কিন্তু বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের সাথে তারা কখনোই ইংরেজি ভাষায় কথা বলে না। এমন কী স্কুলেও তারা মাতৃভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বেছে নেয়। এ কারণে তাদের তৃতীয় কিংবা চতুর্থ প্রজন্ম নিজেদের ভাষায় কথা বলতে পারে অনায়াসে। আর এভাবেই এই মার্কিন মুল্লুকে বাস করেও নিজেদের ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছে চীনারা। একইভাবে স্প্যানিশ কমিউনিটিও নিজেদের ভাষা এবং দেশপ্রেমে এগিয়ে আছে। পিছিয়ে আছি কেবল আমরা। আমরা আমাদের ভাষাকে অনেকটাই অবহেলা করে আসছি। আমাদের নতুন প্রজন্মের সাথে বাড়িতে বাংলা ভাষায় কথা বলতে সেই অর্থে আন্তরিক নই। বিষয়টিকে আমাদের সন্তানদের উপর বাড়তি চাপ মনে করে এড়িয়ে যাই।

প্রবাসে আমাদের সন্তানদের দেশীয় উৎসব সমুহের অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ আগের যে কোন সময়ের তুলনায় বেড়েছে। বাংলা গান, আবৃত্তি কোনটিতেই  পিছিয়ে নেই আমাদের নতুন প্রজন্মের অনেকেই। লক্ষ্য করলাম, যে নোটবুক দেখে তারা গান গায় কিংবা আবৃত্তি করে সেগুলো রোমান হরফে লেখা। যেমন, Amar vaiyer rokte rangano ekushe February ...  ( আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি...)। আমাদের এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা শুনে শুনে ভাষা কিছুটা আয়ত্ত করা শিখলেও বাংলা লেখা কিংবা পড়ার ক্ষেত্রে এখনো অনেকখানি পিছিয়ে আছে। এ বিষয়ে আমার এক সময়ের কলিগ অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই বললেন, যে ভাষার জন্যে পৃথিবীতে একমাত্র বাঙালি জাতি রক্ত দিয়েছে, ভাষা নিয়ে ভাষার মাসে আমরা শোক প্রকাশ করি, শহীদদের স্মরণ করি, শহীদ মিনারে ফুল দেবার জন্যে হুলুস্থুল লাগিয়ে দেই, সেই ভাষায় আমাদের সন্তানদের কথা বলার ব্যপারে বাড়িতে আমরা কতটুকু মনোযোগ দেই ? শিশুদের আমরা ড্যাডি, ম্যামি ডাক শেখাই। অথচ মা, বাবা ডাকের মাঝে যে শেকড়ের টান, নাড়ির টান থাকে তা আমরা বুঝতে চাই না। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আন্তরিকতার সাথে সময়োপযোগী উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আমাদের সরকার প্রধান বাংলা ভাষায় জাতিসংঘে ভাষণ দেন। নিউইয়র্ক নগরীর স্কুলসমূহ থেকে প্রাপ্ত চিঠি, স্বাস্থ্যবীমা সংক্রান্ত চিঠি কিংবা প্রচারপত্র অন্যভাষা অর্থাৎ ইংরেজি, চায়নিজ, স্প্যানিশের পাশাপাশি বাংলায় পাচ্ছি, এটি আমাদের জন্যে আনন্দের এবং ইতিবাচক। এই ভিনদেশে দিনে দিনে আমরা অনেক কিছুই অর্জন করেছি। সরকারীভাবে ঈদের ছুটিও পাচ্ছি, যা একসময় আমাদের কাছে কল্পনাতীত ছিল। এখন স্কুলগুলোয় দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে চালু করা জরুরি হয়ে উঠেছে। আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, হয়তো একদিন এটিও অর্জন করতে পারবো আমরা এই প্রবাসে। নতুন প্রজন্মের মাঝে আমাদের বর্ণমালা বেঁচে থাকুক যুগের পর যুগ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত।

রিমি রুম্মান 

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ