প্রবাসে আশা-নিরাশায় বাংলাভাষা

রিমি রুম্মান ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, বুধবার, ০৮:২৭:১৯অপরাহ্ন সমসাময়িক ৭ মন্তব্য
ভাষার জন্যে লড়াই করা, প্রাণ দেয়া একমাত্র জাতি আমরা। পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত দেশের মানুষ হিসেবে আমরা বাংলাদেশিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আবাস গেড়েছি বিশ্বের আনাচে কানাচে। ভিনদেশে জন্ম নিচ্ছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। সময়ের সাথে সাথে একদিকে নতুন প্রজন্মের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, অন্যদিকে পাশ্চাত্যের শিক্ষা আর সংস্কৃতির সাথে তাদের ভাষাকেও স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করছে। মূলধারায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া কিংবা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশিদের আসীন হওয়া আমাদের গর্বিত করে। কিন্তু আমাদের সন্তানরা তো হাজার হলেও বাংলাদেশি, এবং তাঁদের শেকড় বাংলাদেশ। এই আইডেন্টিটি তাঁদের চেনাতে হবে পরিবার থেকে।যেহেতু আমাদের সন্তানরা জন্মের পর থেকে প্রথম খেলার সঙ্গী হিসেবে বাবা-মা’কে পেয়ে থাকে, তাই শিশুর শব্দ শেখা, ভাষা শেখার প্রথম শিক্ষক বাবা-মা। শিশুর মনের ভাব প্রকাশের জন্যে প্রথম ভাষাটা যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলাভাষা হয়ে থাকে, তবে সেই শিশু কখনোই আর তা ভুলে যাবে না বলে আমার বিশ্বাস। আমরা অনেকেই মনে করে থাকি যেহেতু আমেরিকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে পাঠদান করে থাকে, তাই ইংরেজিতে কথা বলাটাই শিশুর জন্যে সহজ হবে। আমরা বেশিরভাগ বাবা-মায়েরা ভাবি, একাধিক ভাষা শিশুর জন্যে একরকম বাড়তি চাপ। কিন্তু আমাদের ধারণা একেবারেই ভুল। শিশুদের মস্তিস্কের ধারণক্ষমতা কিংবা শেখার ক্ষমতা পরিনত মানুষের চেয়ে তিনগুন বেশি। যে কোন বিষয় তাঁরা খুব দ্রুতই শিখে নিতে সক্ষম। এদেশে জন্ম নেয়া শিশুরা স্কুলে যাবার আগেই টিভিতে কার্টুন কিংবা গেইম দেখে ইংরেজিটা শিখে নেয়। বিধায় ইংরেজি শেখা নিয়ে চিন্তিত হতে হয় না। কিন্তু বাংলাভাষাটা ধরে রাখতে হলে পরিবারই সবচেয়ে বড় শিক্ষক। আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির গৌরবগাঁথার কথা আমাদের নতুন প্রজন্মকে শুরুতেই না শেখালে খুব দ্রুতই তাঁরা শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
প্রবাসের শুরুরদিকের সময়ে আমি একটি বাংলাদেশি উচ্চশিক্ষিত পরিবারের তিনটি শিশুকে দেখাশোনার কাজ করতাম। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে বাংলাদেশিদের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে পরিবারটির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। শিশুত্রয়ের জন্যে বাবা-মা বাংলা গানের শিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন বাংলা সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে। প্রতি উইকএন্ডের সকালে তাঁরা একযোগে বাংলা গান গাইত যদিও, কিন্তু শুনতে অনেকটা ইংরেজির মত শোনাতো। কোনভাবেই তাঁদের উচ্চারণ শুদ্ধ বাংলায় হতো না। পরবর্তীতে বিষয়টি আবিষ্কার করি।যেহেতু বাড়িতে শিশুত্রয়ের বাবা-মাকে কখনোই বাংলায় কথা বলতে শুনিনি, তাঁরা সবসময় ইংরেজিতে কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন, তাই বাংলা চর্চাটা সেভাবে হয়ে উঠেনি শিশুদের। পরিবারের অগ্রজরাই যদি মাতৃভাষাকে নিষ্ঠার সাথে ধারণ না করেন, তবে তাঁদের শিশুরা শিখবে কোথা থেকে ?
গত সপ্তাহে আমি যখন বেশ কয়জন প্রবাসি মায়ের সাথে সন্তানদের বাংলা শেখানোর বিষয়ে কথা বলছিলাম, তখন কিছু বিষয় বেশ পরিষ্কারভাবে উঠে আসে তাঁদের কথায়। আমাদের বাংলাভাষা চর্চাকে গতিশীল রাখতে বাড়িতে বাংলাভাষায় কথা বলাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়ার কথা জানিয়েছেন অধিকাংশ মা। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মা বেশ হতাশার সাথে জানান, ছেলেমেয়েরা বাংলা বলতে চায় না। বাবা-মা’র সাথে খানিকটা বললেও ভাইবোনেরা নিজেদের মাঝে অনর্গল ইংরেজি বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সন্তানদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে বাংলায় বেশি বেশি কথা বলতে পারলে হয়তো পূর্বপুরুষের ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে তাঁদের উৎসাহ কিংবা আগ্রহবোধ হতো বলে জানান একজন। কেউবা বলেন, ‘ আমাদের জীবন, জীবিকা আর অর্থ উপার্জনে ব্যস্ততা বেশি, সন্তানদের সাথে নানান বিষয়ে কথা বলার সময় হয় না বললেই চলে।’ একজন জানালেন, ‘ ব্যয়বহুল হলেও গ্রীষ্মের ছুটিতে সন্তানদের নিয়ে দেশে বেড়াতে যাই শুধুমাত্র মাতৃভাষা এবং সংস্কৃতির সাথে বন্ধন দৃঢ় করার বাসনায়, এবং সেইসাথে মাতৃভাষার চর্চাটাও যেন মজবুত হয়।’ এভাবেই প্রবাসে বসবাসরত মায়েরা সন্তানদের বাংলাভাষা শেখার বিষয়ে তাঁদের আশার কথা, নিরাশার কথা, ভাবনার কথা জানালেন।

এখনো আমাদের সময় ফুরিয়ে যায়নি। চাইলে আজই শুরু করা যেতে পারে হাতে কলমে আমাদের সন্তানদের বাংলা শেখানোর কাজটি। প্রবাসে বসবাসরত বাঙালীরা গ্রীষ্মের দীর্ঘ ছুটিকেও বেছে নিতে পারেন তাঁদের সন্তানদের বাংলা অক্ষর শেখাতে। তবেই লিখতে এবং পড়তে শেখানোটা সহজ হয়ে উঠবে। বছরের বাকিটা সময় শুধুমাত্র ছুটির দিনগুলোতে বাংলা লিখতে কিংবা পড়তে চর্চা করালেই অনেকখানি এগিয়ে যাবে আমাদের ছেলেমেয়েরা। ‘ বাড়িতে সারাবছর বাংলায় কথা বলা বাধ্যতামূলক’ এই নিয়ম চালু করলে আমাদের ছেলেমেয়েরা তাঁদের আইডেন্টিটি ধরে রাখতে সক্ষম হবে। বাঙালী পরিবারগুলোর সাথে বেশি বেশি সম্পৃক্ততা, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা কিংবা লাইব্রেরি থেকে বাংলা বই, ডিভিডি সংগ্রহ করেও দেখানো যেতে পারে। প্রবাসিরা বিচ্ছিন্নভাবে বাংলা স্কুল চালু করেছেন নিজ উদ্যোগে। সেইসব স্থানেও ক্লাস করানো যেতে পারে। বাংলাভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি মমত্ববোধ থাকলে প্রবাসে জন্ম এবং বেড়ে উঠা আমাদের উত্তরসূরিরা আত্ন-পরিচয় নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে একদিন।

0 Shares

৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ