প্রতিহিংসার উল্টোপথে

আজিজুল ইসলাম ১৭ এপ্রিল ২০১৪, বৃহস্পতিবার, ০৮:০৩:৪৪অপরাহ্ন বিবিধ ২ মন্তব্য

 

রাজনৈতিক হানাহানি, সহিংসতায় চারিদিকে কেমন যেন একটা গুমোট ভাব । সহসা কাটবেনা এসব, এরকমই একটা ধারনা প্রতিষ্ঠিত হয়ে চলেছে প্রতিনিয়তই । ফলে প্রতিদিনই রাজনীতির আকাশ হয়ে উঠছে আরো গুমোট ।

একাত্তরে যাঁরা চরম ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছিলেন, অসহায়ভাবে মৃত্যুকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, যে মা-বোনেরা আমার হয়েছিলেন চরমভাবে লাঞ্ছিত-অপমানিত, এত অপমান সহ্য করা তাঁদের স্বজনরা, কেমন করে ভুলবেন সেসব ! তাইতো আমরা, তাঁদের আবেগী উত্তরসূরীরাও তাঁদের মতোই ভুলতে পারিনা সেসব । যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে তাই আমরা থাকি অবিচলিত । কোন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রশ্নে কখনও কোনরকমের সন্দেহ দেখা দিলে তাই আমরা বড় আবেগী হয়ে উঠি, আবার জমায়েত হই শাহবাগে, প্রতিবাদী হয়ে না উঠে পারিনা আমরা । রক্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে আমাদের ।

এই তরুনরাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে কি-না, সবকিছু ভেস্তে যাবেনা তো, জনে জনে তারা খালাস পেয়ে বেরিয়ে যায় কি-না, এধরনের হতাশা ও দুশ্চিন্তা থেকে এদেশের মানুষকে মূক্তি দিয়েছে ৫-ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৩ সৃষ্টির দ্বারা । যোগ্য উতরসূরীর-ই কাজ করেছে তারা আসলে আমাদের । একথা বলতে কারো আমাদের দ্বিধা থাকা উচিত নয় যে, ঐদিন তরুনরা যদি শাহবাগে জমায়ত হয়ে প্রতিবাদ জানানো শুরু না করতেন, তবে হয়তোবা অন্যরকম অনেক কিছু অঘটন ঘটতে পারত । সেসমস্ত ঘটনা ঘটার হাত থেকে তারা আমাদের আসলেই উদ্ধার করেছেন ।

ভালই চলছিল সবকিছু । এদিকে শাহবাগ মঞ্চের সবাই তরুন, গাইড করার পরিবর্তে তাদেরকে দলে টানার চেষ্টা করা হোল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবী তোলার কথা বলা হোল, মোট কথা এই তারুন্যকে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা চলেছিল তো বটেই, অদ্যবধি তা চলছে । আমাদের বিশ্বাস এখনও আছে যে, তারা কোন দলের পক্ষে যায়নি । নেতৃত্ববিহীন এই তরুনদের মধ্য থেকে সেদিন কিছু উগ্র স্লোগান উঠতো, যেমন একটা একটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর । এধরনের আরো দু’একটা । আমাদের মনে রাখতে হবে যে, যুদ্ধাপরাধীরা এবং জামাত-শিবিরের বর্তমান প্রজন্ম এক নয় । প্রথম পক্ষের জন্য তারা লড়ছে বটে, তবে তাদের সংগঠনেও কিছু প্রগতিশীল নেতা-কর্মী রয়েছেন, যারা চাননা যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন দিতে । কারন তারা চান ইসলামী সংগঠন হিসাবে জামাতকে টিকে থাকতে হলে সাধারন মানুষের মন জয় করতে হবে । গভীরভাবে তারা ভাবার চেষ্টা করেন, একাত্তরে তাঁরা স্বয়ং যদি ঐ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতেন, মানবতাবিরোধী অপরাধগুলি যদি তাঁদের পূর্বপুরুষদের উপর হোত! ঐ উগ্রবাদী স্লোগানগুলি না দিয়ে শাহবাগ মঞ্চের তরুনরা জামাত-শিবিরের এই প্রজন্মের তরুনদেরকে আহ্বান জানাতে পারত যুদ্ধপরাধীদের পরিত্যাগ করার ।

আজও আমার মনে হয়, জামাত-শিবিরের আজকের প্রজন্মের সাথে আমরা যেন তিক্ততার সম্পর্কটা কমিয়ে ফেলি । কারন তাদের অনেকে নেতার আদেশ শিরোধার্য মনে করে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে । আসলে তাদের নিজেদের মধ্যে একটা নীতি-আদর্শ মেনে চলার ব্যাপার রয়েছে । সাঈদীরা যুদ্ধাপরাধ  করেছিলেন, এটা চরম মিথ্যা এবং সরকার প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তাদের ফাঁসি দেওয়ার তোড়জোড় করছে, এভাবেই তাদের মধ্যে প্রচারনা চালানো হয়েছে এবং হচ্ছেও । এগুলি যে মিথ্যা প্রচার, সেটা এদেরকে বোঝানো এদেশের শিক্ষিতসমাজের দায়িত্বের মধ্যে কি পড়েনা ? হিংস্র নেতাদের কথায় তারা যাতে সহিংসতা আর না করে, এখনই এগুলি যাতে তারা বন্দ করে, সেই আহ্বান তাদের জানাতে হবে আমাদেরই সুশীল সমাজকে ।

কাদের মোল্লার ফাঁসি হওয়াতে উল্লাস প্রকাশ করা আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে উচিত নয় । কারন ফাঁসি একটি অত্যন্ত করুন মৃত্যু । মৃত্যুর সময়তো নয়ই, তারপরও কারো ফাসির জন্য উল্লাস প্রকাশ করা অনুচিত, হোক সে হাজারটা খুনের খুনী । এটাই মানবতা । কেউ অমানবিক হলে আমিও যদি ঐ একইরকম হই, তবে তার সাথে আমার পার্থক্য থাকলো কি ? সহিংসতা-হানাহানি বন্দ করার উদ্দেশ্যেই উল্লাস প্রকাশ করা ঠিক নয় । এখন সময়টাই এরকম হয়ে গেছে যে, এক পক্ষের উল্লাসে অন্য পক্ষ সহিংস হয়ে ওঠে । আসলে আমাদের এখন সবচেয়ে দরকার যে জিনিসটা, তা হচ্ছে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়টা । এটা কোন রাজনৈতিক দল দিয়ে হবেনা, হবে সকল ধরনের প্রজন্মের ঐক্যবদ্ধতায়, সরকারকে চাপে রাখার মাধ্যমে । সে আলোচনা অন্যত্র ।

নেলসন ম্যান্ডেলা বর্নবাদ তাঁর দেশ থেকে বিদায় করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন সাদারা কিছুটা এগিয়ে এসেছিল বলে, যেজন্য দক্ষিন আফ্রিকার তৎকালীন সাদা প্রেসিডেন্ট এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ককেও নেলসন ম্যান্ডেলার সাথে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয় । আমাদের জামাতী প্রজন্মকেও এগিয়ে আসতে হবে আমাদের মধ্যে হানাহানি বন্দ করার উদ্দেশ্যে । তারা এগিয়ে না এলে কিন্তু চলমান এই সহিংসতা বন্দ হওয়ার সম্ভাবনা কম । কারন সহিংসতাকে সহিংসতা দিয়ে মোকাবেলা করা যায়না । অপ্রিয় হলেও এটা মানতেই হবে যে, এ-প্রজন্মকে শান্তির পথে এগিয়ে আসার পথ দেখানোর দায়িত্ব এদেশের বিবেক বলে পরিচিত মানুষগনের । কারন প্রজন্মের মধ্যে কোন ভেদাভেদ আমাদের দেশের সার্বিক উন্নয়নের পথে বিরাট একটা বাধা, এমনকি মাদ্রাসার ছাত্রদেরও আমরা চাই, তারাও প্রচলিত শিক্ষার মত একই মানের শিক্ষা থেকে যেন বঞ্চিত না হয় । অন্য প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের মত তারাও পাবে একই মানের শিক্ষা, এটা তাদেরও অধিকার । দরিদ্র-অসহায় এরাও ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-শিক্ষক-গবেষক হবে । জামাত-শিবির যারা চালান, তাঁদেরও ভেবে দেখতে বলি, যুদ্ধাপরাধীদের বিসর্জন দিয়ে অহিংস নেতা-কর্মী নিয়ে গনমানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়ে সংগঠনের উন্নতি করবেন, প্রসার ঘটাবেন, নাকি বর্তমানে যেভাবে চলছন সেভাবে চলে গনমানুষের হৃদয়ের একেবারে বাইরে চলে যাবেন স্থায়ীভাবে ।

0 Shares

২টি মন্তব্য

  • জিসান শা ইকরাম

    পড়লাম আপনার লেখা ।

    যারা জামায়াত শিবির করে , তারা যদি ৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের পরিত্যাগ করে , এমন ঘোষনা দিতে পারেন ‘ ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের তৎকালীন নেতারা ভুল করেছিলেন , তাই আমরা তাদের ত্যাগ করেছি এবং আজ থেকে আমরা পিছনের ভুল সুধরে সামনে এগিয়ে যাবো ” – কেবল তাহলেই জামায়াত শিবিরকে মেনে নেয়া যায় , নতুবা নয় ।

  • শুন্য শুন্যালয়

    জামায়াত শিবিরের পক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের পরিত্যাগ করা সর্বোপরি ধর্মান্ধতা ত্যাগ করে মানবতার জন্য কাজ করা আদৌ কোনদিন সম্ভব নয়..আপনার গনজাগরনের অংশ টুকু চমৎকার তবে জামায়াত শিবির কে চিরতরে বর্জন চাই, এর বিকল্প নয়..
    ধন্যবাদ আপনাকে.

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ