প্রতিদান

দালান জাহান ২৫ অক্টোবর ২০১৯, শুক্রবার, ০৬:০৩:৩৮অপরাহ্ন গল্প ৭ মন্তব্য

 

প্রতিবেশীর রোষানলে পড়ে
একটা খুনের মামলায় জড়িয়ে চাকরি হারান রওশান সাহেব । প্রায় দের দশকের মামলার চাবুকে রওশান হারিয়েছেন তার সব সম্পদ । এখন শুধু অবশিষ্ট আছে বাজারে একটা দোকান যা বন্দক দেওয়া আছে আর বাড়ি ভিটা। এক ছেলে ও এক মেয়ে তার । মেয়েটার বিয়ে হয়েছে কিছুদিন আগে ।ছেলেটা অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দিলো সবেমাত্র।

মামলা মানুষকে কামলা বানায় এই প্রবাদের শক্তিতে ওড়ে গেছে রওশান সাহেবের সবকিছুই । কিন্তু তারপরও তিনি মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন এবং ছেলেকে অনার্স পড়িয়েছেন অনেক কষ্টে।

কিন্তু এই ছেলেটা যার নাম জায়ান হঠাৎ করেই গতকাল একটা মেয়ে নিয়ে বাড়ি উঠেছে। গ্রামের সবাই জায়ানকে ধিক্কার দিলেও জায়ানের বন্ধুরা আনন্দেই দিনমাত করেছেন। কিন্তু রওশান সাহেব এ বিষয়ে কিছুই বলেননি । শুধু মেয়ের বয়স জিজ্ঞাস করে কাজী ডেকে বিয়ে পড়িয়েছেন। কিন্তু এদিক থেকেও মামলা হয়েছে । পুলিশ এসেছিল শেষে মেয়ের জবানবন্দি নিয়ে চলে গেছেন।

তার কিছুদিন পর একটা চাকরির যোগার হলে জায়ান বউকে নিয়ে শহরে চলে যায়।
কিন্তু কিছুদিন পর বাড়ি আসে জায়ান এবং তার পিতাকে জানায় , একটা ব্যবসার জন্য তার কিছু টাকা লাগবে । কিন্তু রওশান সাহেবের তো বাজারের দোকান আর বাড়ি ভিটা ছাড়া আর কিছুই নেই। রওশান সাহেব একমাত্র ছেলের জন্য তা'ও বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলেন ।

কিন্তু বাঁধ সাধেন উনার স্ত্রী অণু। তিনি বলেন "বাড়ি ভিটা বিক্রি করলে থাকবা কই এটা মোটেও ভালো কাজ নয় । বাজারের দোকানটা বিক্রি কর এর বেশি কিছু করো না । চৌদ্দ পুরুষের ভিটা বিক্রির কোন অধিকার তোমার নেই" । রওশান সাহেব চিন্তা করলেন কথা তো ঠিকই। তাই তিনি বাজারের দোকান বিক্রি করে তাকে টাকা দিয়ে দিলেন।

তারপর পাঁচ বছর জায়ানের কোন খবর পাওয়া যায়নি। জায়ানের মা খুব অসুস্থ হলেন
ছেলেটাকে একবার দেখার জন্য রওশান সাহেবকে কতোই না অনুরোধ করলেন বেচারি। রওশান সাহেব জায়ানকে খোঁজার জন্য ঢাকাও গেলেন কিন্তু এতো বড় শহরে কাউকে কি এভাবে খোঁজে পাওয়া যায়। তাই ফিরে এলেন নিস্ফল হয়ে। কিছুদিন পর
ডায়োবেটিশে আক্রান্ত হয়ে মরে গেলেন জায়ানের মা। ছেলেটা দেখতেও এলো না একবার ।

রওশান সাহেব বাজারে নদীর ঘাটে চায়ের দোকান দিয়েছেন । অনেক সময় রওশানের বন্ধুরা আসেন নদীর ঘাটে দেখা হয় রওশানের সাথে । তারা জায়ানের কথা জিজ্ঞেস করেন রওশান সাহেব তখন নিশ্চুপ পাথর হয়ে যান ।

গতকাল পেপারে জায়ানের ছবি ছাপিয়েছে। তিরিশ লক্ষ টাকা লটারি পেয়েছেন জায়ান। পুরো গ্রামে ছড়িয়ে গেছে এই খবর । পেপার নিয়ে অনেকেই ছুটে আসছেন রওশান সাহেবের কাছে। সবার এই উৎফুল্লতা দেখে রওশান সাহেবের চোখ ভিজে যায়।

রওশান সাহেব পত্রিকা অফিসে ফোন করে নিজের পরিচয় দিয়ে জায়ানের ঠিকানা নেন । পরদিন সকালে চলে যান ঢাকা জায়ানের বাসায়। বাসার দরজায় সৌখিন কারুকার্যে ঝুলছে "ভূমিহীন স্বপ্ন" পাটের অক্ষরে অলংকৃত নাম জায়ান চৌধূরী। রওশান সাহেব নামটা পড়ে সস্তি পেল । কলিং বেল চাপতেই চল্লিশোর্ধ একজন মহিলা বের হয়ে এলো ।
" কে আপনি ? কাকে চান ?
"আপনি কে " ?
"আমি কে মানে কি আমি জায়ানের মা
আপনি কোথা থেকে এসেছেন কি চান "?

"ও আপনি তাহলে জায়ানের মা ! আমি জানতাম অন্য কেউ যে কিনা বলতে গেলে বিনাচিকিৎসায় মারা গেছে
যাইহোক আমি জায়ানের হতভাগ্য বাবা ! জায়ান কোথায় " ?

মুহূর্তেই মহিলার চোখ হেঁটে হেঁটে কপালে উঠে গেলো। টার্কি মুরগীর মতো মাথা উঁচু করে বললো "দেখুন জায়ান বলতে এখানে কেউ নেই আর জায়ানের বাবা-মা অনেক আগেই মারা গেছেন"। "আপনি লটারির খবর শোনে চলে এসেছেন নির্লজ্জের মতো তাই না " ?

রওশান সাহেব তাকিয়ে আছেন ভাঁজা কালাইয়ের মতো মহিলাটির দিকে। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে মনুষ্যত্বের পোড়া গন্ধ ।
সে গন্ধ যেকারো ইন্দ্রিয়ে লাগলেও তার বিবেক ও পোড়ে ছাই হতে পারে। রওশান সাহেব তাই দুই পা পিছু হটে তৈরি করলেন তার ব্যক্তিগত দুরত্ব।

কিছুক্ষণ পরেই জায়ান এলেন। দরজার সামনে বাবাকে দেখেই অনাকাঙ্ক্ষিত হতবাক হলো সে। যাকে বলে আনএক্সসেপ্টেত। বিরক্তিকর একটা বাদামি চিহ্ন যেন জায়ানের চোখ থেকে নেমে যাচ্ছে সিঁড়ির দিকে। নিচে নামার সিঁড়ির তাকগুলো যেন প্রমত্তা নারীর উন্মাদ যৌবনের মতো আহবান করছে, নেমে এসে নেমে এসো। বাবার চিন্তার চন্দ্রবিন্দুতে দাগ কেটে জায়ান উচ্চারণ করলো পৃথিবীর সমান ভারী বর্ণমালা

"বাবা তুমি কখন এলে" ?
"এই তো কিছু সময় যায় , "তা তুমি কেমন আছ জায়ান " ? "এসব কথা পরে হবে তুমি আগে আমার সাথে এসো বাবা" এই বলে বাবার হাত ধরে টেনে নেচে নেমে এলো এবং উবারে চেপে ছুটে চলল মিরপুরের দিকে। রওশান সাহেব হতচকিত হয় যে ছেলে কখনও তার সামনে কথা বলতো না সে ছেলে আজ কতো চঞ্চল কতো স্মার্ট।

রওশান সাহেব হতবিম্বত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন "কোথায় যাচ্ছ বাবা জায়ান "? তুমি এতো ভয় পাচ্ছ কেন কোন সমস্যা হয়েছি কী" ? " না বাবা কিছু হয়নি তোমার থাকার একটা ব্যবস্থা করতে হবে তো " বাসায় তো জায়গা নেই " ! "তো আমি কি বউমাকেও দেখব না" "দেখো পরে দেখো বাবা" ।

অবশেষে একটা অফিসের সামনে এসে তারা নামলো । জায়ান রওশান সাহেবকে পাঁচশ টাকার দুটো নোট দিলেন এবং অফিসের পিয়নের রুমে থাকার জায়গা করে দিলেন । রওশান সাহেব এবার চোখ তুলে আকাশে তাকালেন এবং তিনি দেখলেন একটি কাক আশ্চর্যজনকভাবে তাড়া করছে একটি চিলকে কাকটি চিলের পিঠে বার বার ওঠানামা করছে আর ঠোকর দিচ্ছে। জায়ান এবার জিজ্ঞেস করলো "আকাশে কী দেখছো বাবা "? "দেখছেনা কাকটা কিভাবে চিলটাকে মারছে"। "ওসব কিছু না বাবা" "কে বলছে কিছু না আমি স্পষ্টত চিলের কান্না শুনতে পাচ্ছি এবং দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে কিভাবে মানুষ্য সন্তান কাক হয়ে যাচ্ছে "

"সবকিছুই কী ভুলে গেছ পুত্র ? ভুলে গেছ আকাশ আর মাটির পার্থক্য অথচ তারাও একদিন একত্রিত ছিলো। নদী ও সাগরের পার্থক্য ভুলে গেছ? অথচ তারা এখনও একে অন্যের খবর রাখে। মাতৃস্নেহের অমূল্য সম্পর্ক শীতলতাপূর্ণ এক আদরিণীর চোখ। তোমার স্বপ্ন ডাঙায় কেঁদেছিলো যে রাজকুমার পিতার অবারিত বুক ।

কিন্তু জায়ান যারা সবকিছু ভুলে যায় , তাদেরকেও সবাই ভুলে যায়। তাদের কোন ইতিহাস থাকে না তাদের জন্য থাকে ইতিহাসের ইট পাটকেল, তাদের জন্য বন্ধ হয়ে যায় পৃথিবীর পথ । তারা নিজেদের অজান্তেই হাঁটতে থাকে নিয়তির চক্রে একই বৃত্তে এবং একদিন তাদের পা বিদ্রোহ করে ঢুকে যায় মাটির ভেতরে।

পাঁচশো টাকার দু'টো নোট আহ্ কি তরতাজা প্রশান্তি তাই না জায়ান ? স্নেহের কাছে শ্রদ্ধার
কাছে আজ এর মূল্য অনেক বেশি তা-না হলে
এই নগর কী করে হতো এতো মায়াহীন শহর কি করে জ্বলতো অবৈধ বাতিগুলো। কিন্তু তুমি ভুলে যেও না জায়ান তোমার বাবাও একজন ফাস্ট ক্লাশ কর্মকর্তা ছিলেন ! " এখনও তার সামান্যতম হলেও আত্মসম্মান আছে। সে মরে যাবে তবু ভিক্ষে করবে না।

তোমার মা মরে গিয়ে ভালোই করেছেন । নয় তো আমার মতো এসব সহ্য করতে হতো তাকেও । আমার এখানে থাকার কোন দরকার পড়ে না । আমি গ্রামে চলে যাব আজ এখন-ই এই বলে রওশান সাহেব চলে আসেন বাড়িতে।

বাড়িতে ফিরেই একটা চিঠি পেলেন রওশান সাহেব প্রাক্তন অফিসের চিঠি। চিঠি পড়ে শেষ করতে না করতেই আকাশ খুব রকম কালো হলো মেঘেরা সব ওড়ে এলো বন্ধুর মতো
অঝোর ধারায় নামলো ভূবনবিদারী বৃষ্টি রওশান সাহেবের কান্না অথবা বৃষ্টি কোনটায় কম ছিলো না। এরপর রওশান সাহেব সবমিলিয়ে এক কোটি টাকার মতো পেনশন পেয়েছেন। মনের সব দুঃখকে দাফন করে
বিয়ে করেছেন তারই সহপাঠী ডিভোর্সী তানিয়াকে তাদের এখন সুখের জীবন।

কিছুদিন পর রওশান সাহেবের বাড়িতে একটা পাগল এসেছে। মুখ ভরা দাঁড়ি গায়ের রঙ কিচকিচে কালো। একটা নোংরা প্যান্ট তাতে লেগে থাকে তার মলের গন্ধ।
পাগলটা কী সব বলে আর হাসে তার স্ত্রী সবকিছু লিখে নিয়ে চলে গেছে এইসব। রওশান সাহেব তানিয়াকে ডেকে বললো, খেয়াল রেখো পাগলটার দিকে তার যেন অযত্ন না হয়।

প্রতিদান
দালান জাহান।

0 Shares

৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ