প্রজ্ঞা -৪

নীরা সাদীয়া ২৬ অক্টোবর ২০১৬, বুধবার, ০৩:৩৩:৪৪অপরাহ্ন গল্প ১৬ মন্তব্য

মশা,তেলাপোকা,আরো কিসব নাম না জানা পোকা রিয়াকে আক্রমন করছে।এসব পোকা মাকড়ে তার দারুন ভয়।কিন্তু তা সত্বেও রোহানের ঘরটিতে তার প্রবেশ করতে মন চাইছে না।সারা রাত ঝড়তে ঝড়তে চোখের জলও এবার যেন ক্লান্ত।সকালে কারো কাছে সে কিচ্ছু বলল না। বিয়ে বাড়ির হৈচৈ,মেহমান কেউ আর নেই।এখন শুধু রিয়া,তার শশুড়,শাশুড়ি আর বর রয়েছে।ফলে কান্না ভেজা নির্ঘুম চোখ তার শাশুড়ির দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারল না।তবে তিনি রিয়াকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।তিনি নিজেও তাঁর ছেলের এই হঠাৎ বদলে যাওয়াটা লক্ষ্য করেছেন এবং বেশ অবাক হয়েছেন।যেহেতু তাঁর ছেলের মতামত নিয়ে দেখেশুনে বিয়ের আয়োজনটা হয়েছে,তাহলে সমস্যাটা কোথায়, সেটা তিনি বুঝতে পারছেন না।বাড়িতে এতদিন মেহমানরা ছিল বলে কিছু জিজ্ঞেস করেন নি।তাই এবার রোহানকে নাশতার টেবিলে পেয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন। খাবার টেবিলে রোহানরা পরিবারের সকলে একসঙ্গে বসে খায়।ফলে সেখানে রোহানের বাবাও ছিলেন।তিনিও ব্যাপরটা জানলেন।বাবা মায়ের প্রশ্নের মুখে রোহান ও সব বলে দিল।সে রিয়ার সঙ্গে সংসার করবে না সাফ জানিয়ে দিল। সবকিছু শুনে তার বাবা রিয়াকে বললেন,
- "এ বিষয়ে তোমার কিছু বলার আছে,মা? দেখ, তোমার বাবা আমার বাল্যকালের বন্ধু।আমাকে তোমার বাবার মতই ভাবতে পারো। তাই যা কিছু বলার খুলে বল,মা...."
.
-"বাবা, আমি এসবের কিছুই জানি না। আমার বিরুদ্ধে কেউ ইচ্ছে করে এসব ছড়াচ্ছে। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিনা...."
.
-"তোমার কি কাওকে সন্দেহ হয়?"
-"না বাবা।"
-"তাহলে এবার তুমি কি করতে চাচ্ছ?"
-"আপনার ছেলে যদি ব্যপারটা নিয়ে আমার সাথে একটু ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করত,আমার কথাগুলোও শুনতো তাহলে ভাল হত।সব শুনে তারপর বিবেচনা করে যদি আমাকে দোষী মনে হয়,আমি তার জীবন নষ্ট করেছি তা মনে হয়,তাহলে আমি চলে যাব।"
-"রোহান,বৌমার সাথে তুমি ব্যাপরটা মিটিয়ে নাও।এখনো তোমরা দাম্পত্য জীবনটা শুরুই করলে না, তার আগেই....... তুমিতো আমার এমন ছেলে নও,বাবা"
-"বাবা,কিছু মনে করো না,ওর সাথে আলোচনায় বসার মত রুচিও আমার নেই।"
.
রোহান আলোচনায় বসল না। এদিকে রিয়ার শশুড় জামাল সাহেব কিছুতেই সমস্যা সমাধান করতে না পেরে রিয়ার বাবাকে খবর দিলেন।তিনি সস্ত্রীক এলেন। রিয়া ও রোহান এবং তাদের মা বাবা একত্রে আলোচনায় বসল।এবার রোহান সেই পূর্বের মত রিয়ার বিরুদ্ধে একগাঁদা অভিযোগ ছুঁড়ে দিল।সে খারাপ মেয়ে।তার অনেক প্রেমিক ছিল।সারাদিন তাদের সাথে আড্ডাবাজী করে চলত।আরো নানা কথা। বিয়ের পর সে সব জানতে পেরেছে।আগে জানলে এমন মেয়েকে কোনদিন বিয়ে করত না। সব শুনে রিয়ার বাবা এমন একটা ভাব করলেন যেন তিনি সকল অভিযোগ মেনে নিয়েছেন।তারপর রোহানকে বোঝাতে চাইলেন যেন সে ক্ষমাঘেন্না করে রিয়াকে গ্রহন করে নেয়।রিয়াকে বললেন প্রতিজ্ঞা করতে যে, সে আর ঐসব প্রেমিকদের সাথে যোগাযোগ রাখবে না। বাবার এ আচরণে রিয়া খুব হতাশ হল ঠিকই,কিন্তু মোটেও অবাক হলনা।এদিকে রোহানের অভিযোগ আরো জোড়ালো ভিত্তি পেল। অপরদিকে, রিয়ার মা এবং রোহানের মা বাবা কিছুতেই এসব বিশ্বাস করলেন না। যদিও রিয়ার শশুড় শাশুড়ি খুব বেশিদিন যাবত তাদের বৌমাকে চেনেন না, কিন্তু অভিজ্ঞতার চোখ বলে গুনটি তাঁদের রয়েছে।সেই চোখ বলে দিচ্ছে রিয়া তেমন মেয়ে নয়।
এবার রিয়ার বাবা চলে যাবার আগে একান্তে মেয়েকে কিছু কথা বলে গেলেন।তাঁর কথার সার্মর্ম এই যে, সে এতদিন যা পাপ করেছে এটা তার ফল। তাই সে যেন রোহানের সাথে কোনভাবে "মানিয়ে" নেয়।
রিয়ার বাবা সর্বদাই নিজের মেয়েকে খারাপ কেন ভাবেন,তা সে খুঁজে পায়না।সে খুব সৎ,মেধাবী ও পরিশ্রমী একটি মেয়ে।নিয়মিত ক্লাস করত,টিউশন পড়াত।তার মাঝে কোন ফঁকিঝুকি নেই।তা সত্বেও কোনদিন জ্যামে পড়ে বা কোন কারণবশত ফিরতে দেরী হলে তিনি ভাবতেন মেয়ে কোন ছেলের সাথে আড্ডা দিয়ে ফিরেছে।কোন বান্ধবী ফোন করলেও ভাবতেন ছেলেদের সঙ্গে কথা বলছে।এরকম আরো নানা বিষয়ে তিনি অহেতুক সন্দেহ করতেন আর বকাবাজি করতেন।শুধুমাত্র তার মাই তাকে ঠিক চিনত এবং বিশ্বাস করত। ছাত্রজীবনে তার সেরকম কোন ছেলে বন্ধুও ছিল না।দু একজনের সাথে হঠাৎ পরিচয় ও বন্ধুত্ব হলেও তা কদিন পর হঠাতই মিলিয়ে যেত। ফোনে টুকটাক ২/১ জনের সাথে কথা বললে দেখা যেত এরা বন্ধুত্বের চেয়ে বিরক্তই করে বেশি।তাই কোন ছেলের সাথে তার বন্ধুত্বও তেমন জমত না।তা ছাড়া সে নিজেও নিজেকে ছেলেদের আঙিনা থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে রাখত।আর মনে মনে ঠিক তার মতই একজন জীবনসঙ্গী আশা করত,যার অনেক অনেক প্রেমিকা বা বান্ধবী থাকবে না।ব্যাক্তি রিয়া অনেক বেশি পসেসিভ।তাই সে এমন ভাবত।যা হোক,তার বাবার এসব ভুল ধারনার কোন কারণ যেমন সে উদ্ধার করতে পারেনি, তেমনি সেসব ভুল ধারনা কোনদিন ভাঙতেও পারেনি।আর আজ সেসব ধারনাই তার পথের বন্ধুরতাকে আরো ঘনীভূত করল।
.
রিয়া হেরে যাবার মেয়ে নয়।যুদ্ধ করতে করতে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়,একা একা পথ চলতে চলতে হাঁপিয়ে ওঠে, তখন সে ঘুরে দাঁড়াতে জানে।তাই সে মুখ লুকিয়ে অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে যায় নি,বরং এখানেই থেকে যায়,নিজেকে প্রমাণ করবে বলে।যতদিন তা না পারছে ততদিন বাবার বাড়িতেও যাবে না ঠিক করেছে। রোহান তাকে সহ্যই করতে পারে না।দিনে দিনে তার ব্যবহার অসহনীয় হয়ে উঠছে।রিয়াকে দেখলেই রেগে যায়,চেঁচামেচি করে,যা খুশি বলে। এসব সহ্য করতে না পেরে রোহানের বাবা দেশের বাড়ি চলে যান।যাবার সময় তিনি রিয়াকে আশীর্বাদ করে যান।মা দাঁত কামড়ে পড়ে থাকেন।রোহানকে বোঝানোর চেষ্টা করে করে তিনি এখন ব্যার্থ। রোহানের ধারনা তার ভাল চাকরী,টাকা পয়সা ইত্যাদি আছে বলে রিয়া তার প্রেমিকদের ছেড়ে তাকে বিয়ে করেছে।কিন্তু রিয়া মোটেও লোভী নয়,সেকথা রোহান বেমালুম ভুলে গেছে।অথচ একদিন এই চরিত্রের জন্যই সে রিয়াকে চিনত।মেয়েদের সম্পর্কে তার যেসব ধারনা,তারা লোভী,পয়সাওয়ালা, স্মার্ট ছেলে দেখলেই গলায় ঝুলে পরে,তার এসব ধারনা রিয়াকে দেখেই পাল্টেছিল একদিন।তারপর অনেক খুঁজে সে রিয়ার ঠিকানা বের করেছে।কৌশলে ঘটক দিয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে।আজ তার এসব কিছুই মনে পড়ে না।
রিয়ার থাকার জায়গা হল ডাইনিং এর পাশে একটি ঘরে।তার খুব মন চায় দৌড়ে চলে যেতে রোহানের ঘরে।হঠাৎ গিয়ে চুপি চুপি পেছন থেকে দু হাত দিয়ে বরের চোখ ঢেকে দিতে। আরো নানা কিছু তার ইচ্ছে করে।কিন্তু এ ঘর থেকে ও ঘরের মাঝে সাত সমুদ্র তের নদীর দূরত্ব।সে দূরত্ব সে কি করে ডিঙায়?
বিকেল বেলা বাড়ি ফিরল রোহান।ফিরেই তার মাকে চায়ের জন্য অস্থির করে তুলল।তিনি ও রিয়া একসাথেই রান্নাঘরে কাজ করছিলেন।তাই তার মা চা টা রিয়ার হাত দিয়েই পাঠালেন।
চলবে..........

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ