পিসার হেলানো টাওয়ার

ইঞ্জা ১৫ জুন ২০২০, সোমবার, ১১:০৫:০১অপরাহ্ন ভ্রমণ ৩০ মন্তব্য

আমার প্রথম  ইটালি ভ্রমণের সময়কার কথা, সময় ১৯৯২ সাল, বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে করে প্রথমে যায় লন্ডন, সেইখানে চাচার বাসায় ছিলাম চার দিনের মতো, এরপর রওনা হয়ে যায় ইটালির রোমে, সেইখান থেকে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে ফ্লাইট ধরে ফ্লোরেন্স শহরে চলে এলাম, এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি চেক শেষ করে যখন বেরিয়ে এলাম তখন খেয়াল করলাম আমার নাম লেখা কার্ড ধরে দাঁড়িয়ে আছেন এক ভদ্রলোক, আমি পরিচয় দিতেই উনি আমার সাথে হ্যান্ডশেইক করে পরিচয় দিলেন, উনি এসেছেন বিখ্যাত পিয়াজিও গ্রুপ যাকে সবাই চিনে পিয়াজিও ভি ই ইটালি নামে, পিয়াজিওর আমার আব্বার পরবর্তী আমি ছিলাম বাংলাদেশের ডিলার, সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশকে আমার আব্বাই প্রথম তিন চাকার গাড়ীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এই পিয়াজিওর তিন চাকার বেবি টেক্সি যার রুপান্তর বর্তমানের সিএনজি।

আমরা এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে গাড়িতে করে সোজা চলে এলাম পন্টেডেরা দ্যা পিয়াজিও সিটিতে, পিয়াজিও এক বিশাল গ্রুপের ক্ষুদ্র একটি অংশ, পিয়াজিওর ম্যানেজমেন্ট আসলে আলফা রোমিও, ফিয়াট এবং ফেরারি গাড়ি প্রস্তুত করে এই সিটিতে, যদিও কখনো এই গ্রুপ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এই পন্টেডেরা সিটি সম্পূর্ণ ভূতুরে শহরে পরিণত হবে। 

এদের এক একটি ফ্যাক্টরি এতো বিশাল যে, একটি  থেকে আরেকটিতে যাওয়ার জন্য এরা চপার (ছোট হেলিকপ্টার) ব্যবহার করে। 

আমি যখন পিয়াজিওর হেড অফিসে পোঁছুলাম তখন প্রায় লাঞ্চের সময় হয়ে আসছে, আমাকে ওয়েটিংরুমে বসিয়ে ভদ্রলোক বললো, অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের ডিরেকটর আসবেন তোমার সাথে দেখা করার জন্য।  উনি চলে গেলে কিছু সময়ের মধ্যেই ডিরেক্টর ভদ্রলোক এলেন, এইখানকার ডিরেক্টর মানে উচ্চ পদের অফিসার (জিএম) লেবেলের।

উনার সাথে যেহেতু আগে থেকেই টেলেক্সের মাধ্যমে যোগাযোগ ছিলো (তখন ইন্টারনেট ফ্যাক্স ছিলোনা) বিধায় উনি আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন, কিছু সময় সৌজন্য কথাবার্তার পর উনি আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন লাঞ্চ করার জন্য, আমরা পিয়াজিওর ক্যান্টিনে গেলাম লাঞ্চ করার জন্য, সেইখানে আমি ল্যাম্ব রোস্ট আর ভেজিটেবল, সাথে ডিনার রোল (এক ধরণের ছোট বনরুটি) নিলাম। 

লাঞ্চ শেষে উনি আমাকে বললেন, তুমি আজকে হোটেলে ফিরে যাও, রেস্ট করো, আমি সন্ধ্যায় আসবো তোমাকে নিয়ে বেরুবো।

আমি সায় দিলে উনি অন্য আরেকজন অফিসারকে দিয়ে আমার জন্য রিজার্ভেশন দেওয়া হোটেলে পাঠিয়ে দিলেন।

আমি রুমে গিয়ে গোসল সেরে দিলাম ঘুম, সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ঘুম ভাঙ্গলো ফোনের শব্দে, ডিরেক্টর ভদ্রলোক ফোন দিয়ে বললেন আমাকে রেডি থাকতে, আধা ঘন্টার মধ্যে উনি আসবেন। 

আমি দ্রুত রেডি হয়ে নিলাম, উনি আমাকে বললেন, পিসার হেলানো টাওয়ার দেখবো কিনা, আমি রাজি হয়ে গেলাম, আমাদের গাড়ি ছুটে চললো ফ্লোরেন্স শহরের উদ্দেশ্যে, ওখানেই আছে পিসার হেলানো টাওয়ার, এইখান থেকেই আমার আব্বা পাঠিয়েছিলেন পিসার ছবি, দেখে অবাক হয়েছিলাম টাওয়ারটা বাঁকা হয়ে থাকতে।

আমরা পিসার সামনে পোঁছালে গাড়ি পার্ক করে হেটে এগুলাম, সামনে থেকে ডিরেকটর ভদ্রলোক টিকেট কাটলেন,  টিকেট দেখিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম, আসলে এইটি ক্যাথেড্রাল এলাকা, ক্যাথেড্রালের ঘন্টা লাগানোর জন্যই এই টাওয়ার বানানো হয়। 

ধীরেধীরে এগিয়ে গেলাম পিসা টাওয়ারের দিকে, এই টাওয়ারটি ঘণ্টা বাজানোর উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছিল আগেই বলেছি, নির্মাণের শুরু থেকে আস্তে আস্তে এই মিনারটি ক্রমশ একপাশে হেলতে থাকে,  বলে রাখা ভালো, এই পিসা শহরে অনেক অবকাঠামো আছে, যেগুলো একপাশে হেলে পড়েছে, এই পিসা মিনারটি ৩.৯৯ ডিগ্রী কোণে হেলে আছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা এটি ওয়াচ-টাওয়ার হিসেবে ব্যবহার করত।

মার্কিন এক সেনা কর্মকর্তা এই মিনারের শৈল্পিক দক্ষতা এবং এই চত্বরে অবস্থিত ক্যাথেড্রালের সৌন্দর্য দেখে এতই অভিহিত হন যে, তিনি সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করতে নিষেধ করেন, এভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিশ্চিত ধ্বংসের মুখোমুখি হতে রক্ষা পায় ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্থান পাওয়া জায়গাটি।

আমি দূর থেকেই টাওয়ারটি দেখে অবাক হলাম, এইটি যেন এই মূহুর্তেই হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়বে, হাতে থাকা ততকালীন রিল যুক্ত ক্যামেরা দিয়ে টপাটপ কয়েকটা ছবি তুললাম, এরপর এগিয়ে যেতে লাগলাম, আটতলা উঁচু টাওয়ারের চারিদিকে লোহার ঘের দিয়ে রাখা হয়েছে, সকালে এলে টিকেট কেটে টাওয়ারের উপরে উঠা যায় কিন্তু আমি ভুলেও উঠতে রাজি না, যদি এইটি আমাকে  শুদ্ধ ভেঙ্গে পড়ে? 

আমই যতই ওর কাছাকাছি হচ্ছি ততই ভয়ংকর লাগছে এর কাঠামোটি, আমি ডিরেক্টর ভদ্রলোককে বললাম, এতো ভয়ংকর, এইটা যদি ভেঙ্গে যায়? 

উনি হেসে বললেন, এউটি যেন ভেঙ্গে না পড়ে তাই সরকার টাওয়ারের চারিপাশে ঢালাই করে দিয়েছে, এই পিসার টাওয়ার আগামী দুইশো বছরেও আর ভেঙ্গে পড়বেনা যদিনা ভয়ানক কোনো দূর্যোগ না হয়, উনি আরও সামনে এগুতে চাইলে আমি ভয়ে ভয়ে তাকালাম টাওয়ারের দিকে, উনি আমার ভয়ার্ত চোখ দেখে নিজে একটা হাত বাড়িয়ে ধরে আমার হাত ধরে সামনে এগিয়ে গেলেন, আমাকে টাওয়ারের সামনে রেখে কতেকটা ছবি তুলে দিলেন। 

এইখানে দেখা এবং বেরানোর পর্ব শেষ করে উনি আমাকে নিয়ে চললেন ডিনারে, আমি এই ফ্লোরেন্স এবং পন্টেডেরা শহরে কয়েকদিন থেকেই রওনা হলাম আমার পরবর্তী গন্তব্য   মিলান শহর, ওখানে যেতে গাড়িতে প্রায় তিন ঘন্টা লাগে, তাই আমি দ্রুত যাওয়ার জন্য ট্রেনে করেই গেলাম। 

 

সমাপ্ত। 

ছবিঃ গুগল।

জনস্বার্থেঃ

0 Shares

৩০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ