পহেলা বৈশাখে কি সাজব, কি গাইব, কোথায় বেড়াব, কি খাব ইত্যাদি চিন্তাভাবনা আমাদের সকলেরই থাকে। মনে থাকে প্রচুর আনন্দ এবং প্রাণে থাকে বৈশাখী সুর। নতুন করে নিজেকে ঢেলে সাজানোর প্রস্তূতিও গ্রহন করে অনেকেই। কিন্তু এবার চলুন একটু অন্যভাবে সাজাই নিজেদের।
কিভাবে সাজাব,তা বলার আগে চলুন আলোচনা করা যাক বর্তমানে আমরা কি কি করছি, কেন করছি, কোন কোন বিষয়ে আমাদের নিজেদেরকে পরিবর্তন করা দরকার। লক্ষ্য করলে দেখবেন, আমরা আজকাল একটা অস্থিরতার যুগে বাস করছি। ছোট থেকে বড়, ছাত্র কিংবা বেকার, বিবাহিত কিংবা ব্যাচেলর প্রায় সকলের মনেই রয়েছে অস্থিরতা। আমরা সবাই এর থেকে মুক্তি খুঁজি। মুক্তি মেলা বড্ড ভার, কেউবা আবার মুক্তি না মেলার কারণে জীবন থেকেই পালিয়ে যায়। রেখে যায় প্রিয়জনের তরে একবুক হাহাকার। আরেকটু গভীরে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আমাদের প্রাত্যহিক জীবন যাপন কতটা অস্বাভাবিক! আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল এই অস্বাভাবিক জীবনকেই আমরা স্বাভাবিক করে তুলছি, ফলশ্রুতিতে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সহজ সরল জীবন যাপন। এই যেমন, আজকাল অধিকাংশ কিশোর-কিশোরী,যুবক-যুবতী, ক্ষেত্র বিশেষে মাঝ বয়সী বিবাহিত নারী পুরুষ অনেকেই মাঝরাত অব্দি জেগে কাটাচ্ছে। তাদের সমস্যা হল, তাদের ঘুম আসে না, তাই তারা মুখবই বা ফেসবুকের পাতায় নিজেকে জাগ্রত রাখে। কেউবা ফোনে গল্প করে। আবার ব্যতিক্রম কিছু মানুষ আছেন, যারা তাহাজ্জুদের নামাজ পড়েন কিংবা কিছু মনযোগী ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করে। ব্যতিক্রমদের কথা বাদ দিলেও আমাদের আধুনিক যুগের একটা বড় অংশ কিন্তু এই রাত জাগার দলে। আমার পরিচিত এক বান্ধবী সারারাত জেগে ফেইসবুক করে,মুভি দেখে আর সারাদিন বলে তার নাকি মাথাব্যথা। আরেক বান্ধবীর অভিযোগ তার রাতে ঘুম আসে না। একদিন সে আমার সাথে ঘুমাল।সে আমাকে বলছিল, তার ঘুম আসে না,তাই ইয়ার ফোনে গান শুনবে। আমি যেন তার ইয়ার ফোনের সেটিংটা ঠিক করে দেই। আমি ঠিক করে দেই নি, এটা দেখতে চেয়েছিলাম, যদি কোন উপকরণ তার কাছে না থাকে রাত জাগার মত, তবে সে কি করে? তার কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম সে গভীর ঘুমে নাক ডাকছে। তখন বাজে রাত সাড়ে এগারোটার মত। অথচ এই মেয়ে রাত তিনটাতেও জেগে থাকে। তার কারণ কি? কারণ একটাই,তার রাত জেগে সময় কাটানোর জন্য যথেষ্ট উপকরণ রয়েছে। আমার এক বন্ধু খুব অসুস্থ। বয়স তার খুবই অল্প, এই অল্প বয়সে এত হতাশার কি আছে জানি না, তিনি ঘুমান ভোর চারটায়! এদিকে আবার কোন কোন রিকশাওয়ালাও কিন্তু রিকশা চালিয়ে এ প্লাস পায়। কোন কোন বিবাহিত নারী-পুরুষ রাত জেগে ফেইসবুক করার কারণে বাচ্চাদের ঠিকমত সময় দিতে বা যত্ন নিতে পারছে না, কর্তা কর্মক্ষেত্রে গিয়ে কাজে মনযোগ দিতে পারছে না।
ওপরে এতক্ষণ যাদের উদাহরণ দিলাম, তারা প্রত্যেকেই যথেষ্ট সম্ভাবনাময় একেকজন মানুষ। কিন্তু নিজেরাই নিজেদের মস্তিষ্ককে একটা অলস বস্তূতে রূপান্তর করছে। সারারাত না ঘুমানোর ফলে নিজের মস্তিষ্কের যেটুকু বিশ্রাম দেয়ার প্রয়োজন ছিল তা দেয়া হলো না। আবার দিনের বেলা ঘুমিয়ে সকালবেলার স্বাস্থ্যকর আবহাওয়াটা থেকে তারা নিজেদের বঞ্চিত করল।
অস্থিরতা গ্রাস করে ফেলছে আমাদের যুবসমাজকে। এর ফলে কেউ কেউ বিষন্নতায় ভুগছে। কোন কোন যুবক নিজেকে জড়িয়ে ফেলছে নেশার সাথে।হারিয়ে যাচ্ছে পারিবারিক মূল্যবোধ। তারা পথেঘাটে অসংযত আচরণ করছে, অশালীন, ছেড়া ফাটা পোশাক পরছে। অশ্লীল সব হিন্দী গানের সঙ্গে আজেবাজে নৃত্য করছে।
এবার আসুন গ্রামবাংলার আগের দিনের সহজ সরল জীবন যাপনে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠত। প্রার্থনা জানা থাকলে তা সেরে নিয়ে মুড়ি মুড়কি খেয়ে পড়তে বসে যেত। মা, বাবা,দাদা, দাদী কোরআন বা গীতা পাঠে মশগুল থাকতেন। পাঠ সেরে সকালের নাশতা তৈরিতে তাঁরা ব্যাস্ত হয়ে যেতেন। ছেলেমেয়েরা নাশতা করে স্কুল বা কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হত। বাড়ি ফিরে বিকেলে মাঠে খেলতে যেত।সন্ধ্যায় আবার হাতমুখ ধুয়ে সুর করে পড়তে বসে যেত। রাত দশটার মাঝেই খাওয়া দাওয়া সেরে একদম ঘুম। আবার ভোর বেলায় সেই একই রুটিন। কই তখনতো এত অস্থিরতা ছিল না। কত ছন্দময় ছিল জীবনটা। পরিবারের একের সাথে অন্য সদস্যদের কত ভাল সম্পর্ক ছিল। কখনোবা সবাই মিলে বসতো অাড্ডা। কত গঠনমূলক সমালোচনা হত।বাচ্চারা মা, বাবা, ফুপু,চাচা, দাদা বা অন্যকোন আপনজনের কাছে নিত হাতে খড়ি এবং নৈতিক শিক্ষা। সদস্যদের মাঝে পারিবারিক বন্ধন আরো দৃঢ় হত। সবাই বসে বৃষ্টির দিনে একত্রে মুড়ি মাখা খেত, লুডু খেলতো, হৈ চৈ করত। কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের সেই দিনগুলো?
অথচ আজকালকার বাচ্চারা সারাদিন বসে থাকছে হাতে ট্যাব,স্মার্ট ফোনসহ আধুনিক সব জিনিস নিয়ে।সারাদিন ডুবে থাকছে গেইম খেলা নিয়ে। আর পড়ার নামে কিছু হযবরল বিষয় মুখস্হ করে খাতায় লিখে দিয়ে আসছে। কি পড়ছে, খাতায় কি লিখছে তা তারা নিজেরাই জানেনা। পরবর্তীতে মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে স্মার্টফোনে ছবি তুলে কিংবা গুগলে সার্চ করে সব লিখে দিয়ে আসছে। অতপর তৈরি হচ্চ্ছে মেধাশূণ্য একটা জাতি! কখনো ভাবা যায় কি ঘটতে চলেছে ভবিষ্যতে? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে আমাদের যুবসমাজ?
বলেছিলাম পহেলা বৈশাখের কথা। চলুন এবারের পহেলা বৈশাখের দিন থেকে আমরা ফিরে যাই সেই যুগে,যখন শান্তি ছিল,নিয়ম ছিল,পারিবারিক বন্ধন ছিল। বাড়ির বাহিরে থাকলেও আমরা পরিবারের সকলের খোঁজ রাখতে পারি। সময়মত খাওয়া,সময়মত ঘুম,ভোরের প্রার্থণা, তারপর পড়ায় মন দেয়া এগুলো হোক আমাদের প্রাত্যহিক কর্মসূচী। অহেতুক ঘুরে বেড়িয়ে দামী রেস্টুরেন্টে না খেয়ে গরীবদের কিংবা পথশিশুদের মুখে একটু হাসি ফোটানোর অঙ্গীকার করি, চলুন শান্তির পথে হাঁটি।
শুভ হোক পহেলা বৈশাখ।
১৮টি মন্তব্য
নীহারিকা
খুব সুন্দর লিখেছো তুমি। রাতজাগাটা অনেকের কাছে নিয়মে পরিণত হয়েছে। অবশ্যই সেটা অস্থিরতা, অশান্তি, টেনশন আর বিনোদনের সকল ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইসের কারণে। এসব ব্যবহারে অনেকে তাদের সারাদিনের স্ট্রেসগুলো ভুলে থাকতে চান। পাশাপাশি পারস্পরিক বোঝাপড়া কমে যাচ্ছে।
সত্যিই আবারও যদি আগের দিনগুলো ফিরে পাওয়া যেতো! তবে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলে দিন বদলাতে বাধ্য।
সে আশায় আছি।
নীরা সাদীয়া
অনেক ধন্যবাদ দিদি। আমার লেখার দৃষ্টিকোণ যদি এভাবেই সকলে বুঝতে পারে এবং নিজেদের জীবন যাপনে একটু একটু করে পরিবর্তন আনে তবেই আমার লেখাটা স্বার্থকতা পাবে। শুভরাত।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
অত্যন্ত একটি দরকারী বিষয় নিয়ে লিখেছেন।
সৃস্টিকর্তা রাতকে বিশ্রামের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আমরা করছি বিপরীত। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। আমরা প্রযুক্তিকে কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণে বেশী ব্যবহার করছি। আমরা নিজেরাই যদি না বুঝি তাহলে কে বুঝাতে পারে আমাদের। আমরা প্রত্যেকে যার যার জায়গায় সবজান্তা!
নীরা সাদীয়া
একদম তাই। যতটুকু বিশ্রাম প্রয়োজন ততটুকু আমরা করছি না বলেই এ অবস্হা দাঁড়িয়েছে। অনেক শুভকামনা রইল।
ইঞ্জা
যথার্থ লিখেছেন আপু, বৈশাখির অগ্রিম শুভেচ্ছা রইল।
নীরা সাদীয়া
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ এবং বৈশাখী শুভেচ্ছা।
ইঞ্জা
ধন্যবাদ আপু
আবু খায়ের আনিছ
সাইকোলজি বলে, ঘুমের আগে ব্রেইনের উপর চাপ পড়ে এমন কাজ করতে নেই। বিশেষত প্রযুক্তির যে উপকরণগুলো রেডিয়েশন এর সাথে সম্পৃক্ত সেগুলো বিছানা থেকে দূরে রাখাই শ্রেয়, যেমন মোবাইল, ল্যাপটপ,ট্যাব এগুলো।
ভালো পোষ্ট। শুভেচ্ছা।
নীরা সাদীয়া
একদম ঠিক বলেছেন। অনেক শুভকামনা রইল।
নীলাঞ্জনা নীলা
খুবই সুন্দর একটা পোষ্ট। বর্তমানে সকলেই আমরা ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার উপর নির্ভর করি।
তবে কি জানেন আমরা এখন কিন্তু আমাদের পরবর্তী উত্তরাধিকারীদের প্রজন্মে বাস করছি। যখন প্রথম রেডিও এলো, তখনও সেই সময়কার মানুষেরা মেনে নেয়নি। যখন টিভি এলো তখনও না। যেমন এখন আমিও মেনে নিতে পারিনা আমার ছেলের আইপড কিংবা কম্পিউটারে বসে গেম খেলা। আবার ওদেরও একদিন মেনে নিতে কষ্ট হবে। এভাবেই চলে আসছে সেই অতীত থেকেই। যাক তবে এটা ঠিক আপনার পোষ্টটি আমার মন ছুঁয়েছে।
তবে ঘুমের কথা বললে বলবো, আমি কিন্তু বহু আগে থেকেই রাত জাগি। তখন না ছিলো ফেসবুক না ইন্টারনেট। সেলফোন তো ধরেছি ২০০০ সালে।
রাত জেগে পড়তাম, লেখালেখিও করতাম।
এখনও আমি রাত জাগি, তবে রাত জাগলে কি হবে সকাল সাতটায় ঘুম ভাঙ্গবেই ভাঙ্গবে। 🙂
অনেক বেশী বলে ফেলেছি। তাই না?
নীরা সাদীয়া
আপনি মোটেও বেশি বলেননি। বরং যুক্তিযুক্ত কথা বলেছেন। আমিও একসময় পড়ার কারণে রাত জাগতাম।আবার ফজরের সময় উঠতাম কিন্তু তখন এত পড়ার দরকার ছিল না। এখন পড়া দরকার,তবু রাত জাগতে পারিনা। প্রচুর ঘুম আমার। তবে রাত জাগলেও পর্যাপ্ত ঘুমের দরকার আছে, তাই না দিদি? শুভকামনা, শুভ সকাল।
নীলাঞ্জনা নীলা
আমি রাত জেগে গল্পের বই-ই বেশি পড়তাম। 🙂 আর গান শুনতাম। দীর্ঘ দশটি বছর লেখালেখি থেকে দূরে ছিলাম। কারণ রাত ছাড়া আমি লিখতে পারতাম না।
অবশ্যই ঘুমের দরকার। আমাদের দেশে বলে আট ঘন্টা। কিন্তু আট ঘন্টা ঘুম কি আদৌ হয়? শুভ সকাল। 🙂
নীরা সাদীয়া
হুম, সত্যি আমাদের অাট ঘন্টা ঘুমের প্রয়োজন রয়েছে। আমিতো প্রচুর ঘুমাই। ঘুম খুব প্রিয় আমার। শুভসকাল দিদি।
নীরা সাদীয়া
আপনি মোটেও বেশি বলেননি। বরং যুক্তিযুক্ত কথা বলেছেন। আমিও একসময় পড়ার কারণে রাত জাগতাম।আবার ফজরের সময় উঠতাম কিন্তু তখন এত পড়ার দরকার ছিল না। এখন পড়া দরকার,তবু রাত জাগতে পারিনা। প্রচুর ঘুম আমার। তবে রাত জাগলেও পর্যাপ্ত ঘুমের দরকার আছে, তাই না দিদি? শুভকামনা, শুভ সকাল।
মিষ্টি জিন
রাতজেগে মোবাইল কম্পিউটার ব্যাবহার করে অনেক বেলা করে ঘুম থেকে জাগা খুব অপছন্দ আমার। নিয়মের মধ্যে থাকা মানুষ আমি। কোন অনিয়মই সহ্য করতে পারি না।
পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীর খারাপ করবেই।
অনেক ভালো কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন।
নীরা সাদীয়া
একদম ঠিক বলেছেন। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে দিদি। শুভ সকাল।
মেহেরী তাজ
সত্যি কথা বলেছেন আপু।
মানুষ সব কিছুতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। আমরাও এই ইলেকট্রিক সময়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সব কিছুতেই মানিয়ে নিয়েছি। ছোটবেলার রুটিন চেঞ্জ করে বানিয়েছি নতুন রুটিন। যার ফলে শরীরে লালন করছি শতশত অস্বাভাবিকতা।
পহেলা বৈশাখের অগ্রিম শুভেচ্ছা।
নীরা সাদীয়া
এজন্যই আজকাল আমাদের শরীরে ও মনে বাসা বেঁধেছে অসংখ্য রোগ। বিষয়টা খুব জরুরী। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। শুভসকাল।