পর্বতকন্যের ইতিকথা

প্রদীপ চক্রবর্তী ২৭ জুলাই ২০১৯, শনিবার, ০৪:২০:৫৪অপরাহ্ন উপন্যাস ১৫ মন্তব্য

পর্ব_৬

দেবদাস উপন্যাসের নায়িকা পার্বতীর নামানুসারে মেয়েটির নাম ছিলো পার্বতী। এমন নাম গুলো আমার কাছে বেশ প্রিয়। যাত্রাপালা প্রায় শেষপর্যায়ে চলে এসেছে। হঠাৎ করে চারদিকে ঝড়বৃষ্টির ধমকা হাওয়া।
এ যেন কেউ স্টিমরোলার চালাচ্ছে।
তাড়াহুড়া করে আমরা সবাই যারযার যায়গায় বসে পড়লাম। আমার পাশে বিনোদ এসে বসে একটার পর একটা গল্প বলে যাচ্ছে।
তার কিছুক্ষণ আগে পার্বতীর বাবা মায়ের সাথে আমার  কথোপকথন শেষ করে সবাই একসাথে রাত্রিবেলা মঞ্চে খেয়েদেয়ে নিয়েছি। বেশ ভালো রান্না বেশ ভালো খাবার। শীতের রাতে গরম গরম খাবার এ যেন রাজালয়ে রাজভোগ। তাদের এমন করে অতিথি আপ্যায়ন তা ভুলে যাওয়ার নয়।
বরং প্রশংসার দাবীদার। সবাই প্রশংসা করছে তাদের আপ্যায়নে
জানি না পার্বতীর মুখে কেমন ভালো লেগেছে। উনি সবসময় ব্যস্ত যদি ভাগ্যক্রমে আমার মুখখানা দেখেন।
যদিও উনার ভাগ্যের চাকা আমার দিকে ঘুরে নি।
যাই হোক বাপ এমন খপ্পর থেকে আজকের রাত্রিবেলা চাদর দিয়ে মুখ ডেকে নিলাম। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার মানুষের এমন আত্মীয়তা আর তাদের সংস্কৃতি আমাকে অনেক অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে। সেখানের প্রতিটি মানুষ এত রসাত্মক আর এত অমায়িক বলার মত না। এত ভালোভাবে মিশতে জানে মানুষ ভালোবাসতে জানে।
বাহ্!
আর ঘন্টা খানেক যাত্রাপালা অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাবে। বলরাম দাদার সাথে এখন অভিনয়ে থাকবে নদীয়ার অভিনেত্রী অবন্তী। নামেগুণে সকলকিছুতে উনি গুণগ্রাহী। বেশ চলছে যাত্রাপালার পাঠ আর শীতের রাতে নিধুবাবুর টপ্কা গান। ভরপুর উৎসুক জনতা বেশ ভালো উপভোগ করছে। আমরাও তাই।
যাত্রাপালা শেষ হয়ে যাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে রায়বাহাদুর খেতাবটা ধরে রাখার জন্য এলাকার সকল জনতা বলরাম দাদা কে আহ্বান জানাচ্ছে।
যদিও বলরাম দাদা মানতে নারাজ।
তারপর সকলের উদ্ধাত্ব আহ্বানে রাজী হয়ে গেলেন।
এই মাসের শেষপর্যায়য়ে ভোটের আমাজে।
রায়বাহাদুর খেতাবে ভূষিত হওয়ার জন্য বলরাম দাদার সাথে দুজন প্রার্থি ভোটের মাঠে লড়ছে। একজন হলেন মেদিনীপুরের রায় রাজদত্ত অন্যজন বীরভূমের শরৎ পট্টনায়েক। যদিও এই রায়বাহাদুর খেতাবটা নিয়ে ভোটের মাঠে উনাদের জনপ্রিয়তা তেমন একটা নেই।

#পর্ব_৭

সবাই একে একে বাড়ির দিকে চলছে। আমি,বিনোদ, সাথে পার্বতীর বাবা মা আমরা সকলে চললাম বলরাম দাদার সাথে বাড়িতে। রাত্রি তখন প্রায় তিনটে। প্রিয়জনের সাথে কথা বলার উত্তম সময় অভিসার।
যে সময়ে প্রেমময়ী তার প্রাণের শ্যামকে পুলকিত নয়ন দ্বারা অর্ন্তবেক্ষণ করেছিলো। অভিসারের অমানিশা রাত্রি আর শীতের কনকনে আমেজ সময়ের সমসন্ধিতে ঘাসের ডগায় জমছে কত শিশির। এই অভিসারের উত্তম সময়ে আমার এমন কেউ নেই।
যে কি না আমায় তার পুলকিত নয়ন দ্বারা অর্ন্তবেক্ষণ করবে।
বিনোদ ঘুমিয়ে প্রায় কুম্ভকর্ণ। আর আমি মনেমনে ভাবলাম বিনোদের উপর নিদ্রাদেবীর কৃপা বর্ষণ হয়েছে। আমার যে এমন কৃপাবর্ষণ হয় না।
এসব মনে মনে ভাবতে ভাবতে শুয়ে পড়লাম।
কিছুক্ষণ পর ভোরের ঘন্টা বেজে উঠলো মন্দিরে মন্দিরে উলুধ্বনি আর শঙ্খধ্বনিতে।
আমি বিনোদ কে টেনেটুনে তুললাম। গতকালকের ন্যায় দুঘটি জলের জায়গায় আজ চারঘটি জল নিয়ে শৌচকাজের জন্য চলে গেলাম বিনোদ দাদার সাথে।
বেশ ভালোভাবে শৌচকাজ করে পুনরায় বলরাম দাদার  বাড়িতে চললাম। অর্ধেক পথে বিনোদ চিৎকার বলে উঠছে আহ্ কি শান্তি!
আর বলছে হাগায় শান্তি, হাগায় মুক্তি, হাগায় নেই ক পাপ,হেগেছে আমার দাদাঠাকুর হেগেছে আমার বাপ।

আমি বলে উঠলাম বিনোদ এসব কি বলছিস?
আর বলো না দাদা কালকে রাত্রিবেলার এমন ঠাসাঠাসা খাবার খেয়ে পেট টা যে বেশ বড়সড় হয়ে আছে। শৌচকাজ কাজ না করলে তো উপাই ছিলো না।
শৌচকাজ করে এখন বেশ শান্তি পাচ্ছি।
তাই মনের সুখে এই গান গেয়েছিলাম।

#পর্ব_৮

শীতের সকাল ভোর থেকে বৃষ্টি নামছে। সবাই যারযার কামরায় শুয়ে আছে। বৃষ্টির জন্য আজ স্কুলে স্কুলে রেইনি ডের ছুটি। তাই বলরাম দাদার ছেলে আবির অন্যদিনের থেকে আজ একটু বেশি আনন্দিত। কেননা আজ স্কুল ছুটি।
খানিক পর আবির পার্বতীর কামরায় গিয়ে বলছে দিদি দিদি আমায় একটা গল্প শোনাও না গো?
পার্বতী বলছে ঠিক আছে ভাই গল্প শোনাচ্ছি।
এই বলে পার্বতী গল্প বলতে লাগলো। পাশের কামরায় আমি আর বিনোদ শুয়ে শুয়ে গল্প শুনছি।
গল্পের সাথে সাথে পার্বতী শিউলি ফুল দিয়ে নিজের নামের আদ্যক্ষর আপনমনে আঁকছে। মন জুড়িয়ে গিয়েছে এমন নিপুণতার সহিত নিজের নামের আদ্যক্ষর আপনমনে গ্রথিত পার্বতীর হৃদমন্দিরে।
সকালবেলা বেশ উপভোগ্য ছিলো।
আজ আর এই বৃষ্টিতে কোথাও বের হওয়া যাবেনা।
তাই আমি আর বিনোদ দুজন মিলে লুডু খেলছি।
চারজন থাকলে খেলাটা বেশ ভালো হত।
লুডু খেলায় জয়টা আমার প্রাপ্য ছিলো।
কিন্তু বিনোদ খেলাধূলায় একটু ঠকানো তার বেশ ভালো অভ্যাস ছিলো। তারপর আজকের জয়টা আমার হলো।
প্রতিদিন দুপুরবেলা বলরাম দাদার মাকে পথ্য দিতে আসতেন হোমিও ডাক্তার শ্রী নীলমণি পাল। জাতিতে কুম্ভকার, সাং কানপুর, বয়স প্রায় ৫৫/৬০ বৎসর।
বলরাম দাদার মা বার্দ্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন। ডাক্তার নীলমণি উনাকে দেখে একোইনাইট ২০০ দিয়ে বললেন অর্ধ ঘন্টা অন্তর ১ মাত্রা হিসাবে খাওয়ানোর জন্য। তার সাথে আবিরের স্মৃতিশক্তির জন্য এনাকার্ডিয়াম ২০০ দিয়েছেন ডাক্তার  নীলমণি পাল। অন্যদিকে আকাশের এক কোণে সূর্যের প্রখরটা একটু বেশ বাড়ছে।

#পর্ব_৯

মধ্যাহ্ন ভোজন শেষ করে দ্বিপ্রহরের রৌদ্রের আমেজতায় একটু বেশ রেশ জমেছে শহরে।
ধীরে ধীরে শেষ বিকালের সূর্য পাটে বসতে চলেছে। চারিদিকে আলো অন্ধকারে এক মায়াময় পরিবেশ।
আকাশে গোধূলির আরক্তভা। প্রদীপের আলো আঁধারে
প্রিয়তমার ললাটের সিঁথির সিঁদুর। তার পাশ ঘিরে হিজলের ডালে শালিকের ঝাঁক।
সন্ধ্যাদীপ নিয়ে পার্বতী আপনমনে রাজরাজেশ্বরী মন্দিরে আরতি করছে। শীতের হিমেল পরশে মকরসংক্রান্তির রাত। হিমেল কুয়াশা জাঁকিয়ে বসেছে আকাশের চাদরে। রাত নয়টা বলরাম দাদার বাড়িতে আত্মীয়স্বজনে ভরপুর। সবাই মিলে নানা পিঠাপুলি বানাচ্ছে। বিশেষ করে পার্বতী পিঠে বানাবার হাত অতুলনীয়। সন্দেশ,বকফুল,পাটিচাপটা,নারিকেল নাড়ু এক পেয়েলা ভর্তি করে আমার আর বিনোদের জন্য নিয়ে এসেছে পার্বতী। দিয়ে বললো এই নিন আমার হাতে বানানো। না খেয়ে পার্বতীর সম্মুখে পার্বতীর প্রশংসা করলাম। আর বিনোদ লোভ সামলাতে না পেরে খাওয়া শুরু করে দিলো। পার্বতী আমায় বলছে হয়েছে অনেক প্রশংসা এইবার খেয়ে উপসংহার করেন। এই কথা বলে পার্বতী মৃদু হেসে পাশের কামরায় চলে গিয়েছে।
সত্যি পিঠা গুলো কি স্বাদ আপনারা না খেয়ে বুঝতে পারবেন না। আহ্ কি স্বাদ!
পার্বতীর হাতে বানানো পিঠা। বিনোদ পিঠা খেয়ে পার্বতীর প্রশংসা করছে। আর আমায় বলছে দাদা কি বলব এক যুগে এমন পিঠাপুলি খাইনি। আমি বললাম আজ খাও বিনোদ পেট ভরে। আর কবে আসবে তার তো ঠিক নেই।
আর তোমার পার্বতী দিদিকে বলো যাবার বেলা তোমার জন্য পিঠা বানিয়ে দিতে। আমি আর বিনোদ তাড়াহুড়া না করে ঘুমিয়ে পড়লাম পরেরদিন ভোর চার টায় ঘুম থেকে উঠতে হবে। সেই সুযোগে শরদিন্দু রচনাসমগ্র নিয়ে পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন পার্বতীর বাবা বিলাস চৌধরী। যিনি নাগপুরের নামকরা হোমিও ডাক্তার।
আমার দাদুও একজন নামকরা হোমিও ডাক্তার উনার বন্ধু ছিলেন হোমিও চ্যারিটেবল ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা মহেশ ভট্টাচার্য। বংশানুক্রমিক পর্যায়ে আমাদের পরিবারের একজন না একজন হোমিও ডাক্তার ছিলেন। বইটা ভাঁজ করে একপাশে রেখে শুয়ে পড়লেন বিলাস চৌধরী।

#পর্ব_১০

রাত্রি প্রায় দুটো শহরের পাড়াটা আচ্ছন্ন গভীর ঘুমে।
আমার মামাতো ভাই বিনোদের বেশ বড়সড় মুদির দোকান রয়েছে। দুদিন ধরে দোকানে না থাকায় রাত্রিবেলা স্বপ্নের ঘোরে চিৎকার কর বলে উঠছে এই মহানন্দ দু- ট্রাক চাল আর এক-ট্রাক চিনি পাঠানোর জন্য।
আমি ঘুম থেকে উঠে বিনোদ কে বলছে কোনজায়গায় এত জিনিস পাঠাবে বিনোদ?
বিনোদ থমকে উঠে আমায় বলছে দাদা কি হয়েছে! আমি বললাম কিছু হয়নি বিনোদ তুমি শুয়ে পড়ো।
স্বাদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে দু- ট্রাক চাল আর এক-ট্রাক চিনি। চোখে ঘুম আসছে না তাই এমনি করে শুয়ে আছি। হঠাৎ করে দেখি ড্রইংরুমের পাশের ব্যালকনির দরজাটা হাট করে খোলা,সেখানে পেছন ঘুরে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পার্বতী। শীতের শীতল পরশে উড়ছে তার চুল আর মনের আনন্দে আপনসুরে গাইছে গান গুণগুণ করে।

আমি পাশে গিয়ে বললাম এখনো ঘুমোও নি?
পার্বতী মৃদু হেসে বলছে নাহ্ ঘুম আসছে না এখন।
আর আমি বললাম এত রাতে কি দেখছ?
কিছুনা, এই একা একা বসে রাতের আঁধারে ভোরের সন্ধিক্ষণে ঝরে পড়া শিউলি ফুল দেখছি।
বাহ্ বেশ তো!
শিউলি ফুল আমারও যে বেশ প্রিয়।
এই বলে বেশ কিছুক্ষণ ধরে পার্বতীর সাথে কথা বললাম। কথা বলে বেশ ভালো লাগলো মুখের ভাষা এত অমায়িক আর শ্রুতিমধুর।
বাড়ির সবাই ঘুম থেকে উঠে স্নান করে মকরসংক্রান্তি পালনের জন্য পাশের মন্দিরে যাচ্ছে। আমি আর বিনোদ চললাম মন্দিরের উদ্দেশ্য। পূজা অর্চনা করে বাড়িতে ফিরারর পথে আমাদের সাথে ছিলেন পার্বতীর বাবা মা। প্রত্যের বাড়ি থেকে পিঠে খাওয়ার নিমন্ত্রণ এসেছে। তাই আমরা সকল মিলে চললাম বলরাম দাদার সাথে। ভোর থেকে শুরু আজকের দিনটা বেশ ভালো কাটালাম।
ধীরে ধীরে বাড়িতে আসা আত্মীয়রা সকলেই খেয়েদেয়ে বিদায়গ্রহণ করেছেন।
.
ক্রমশ

0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ