পর্বতকন্যের ইতিকথা

প্রদীপ চক্রবর্তী ৪ ডিসেম্বর ২০১৯, বুধবার, ০৬:০৮:১২অপরাহ্ন উপন্যাস ১০ মন্তব্য

পর্ব ৬৯

শীতের আদ্র সকাল। বারান্দায় বসে রোদের দিকে
পিঠে পিঠ দিয়ে এলোচুল শুকিয়ে নিচ্ছে পাশের বাড়ির অরুণিমা দিদি। বয়স প্রায় আঠারো কুড়ি ছুঁই ছুঁই। বাড়িতে অরুণিমা দিদি ও তার মা মৃন্ময়ী দেবী ছাড়া তাদের আর কেউ নেই। অরুণিমা দিদির আদরের এক ভাই ছিলো,গতবছর বসন্ত রোগে মারা গিয়েছে।
ভাইয়ের নাম অনুপম। লোকমুখে শুনেছি ছেলেটা লেখাপড়ায় বেশ মনযোগী ও ভালো ছিলো।
বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্র। তার প্রতি সবার স্নেহ মমতা ও ভালোবাসার কমতি ছিলোনা।
অরুণিমা দিদির বাবা অনুপমের জন্মের মাস তিনেক পর মারা গিয়েছেন। তাদের সহায়সম্বল প্রায় নিঃস্ব।
বলরাম দাদা সুখেদুঃখে সবসময় তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন।
অরুণিমা দিদি মাস দু এক আগে একটা চাকরি পেয়েছেন,এতে যা বেতন পান কোনমতে সংসার চলে।
এদিকে অরুণিমা দিদির জন্য একের পর এক বিবাহের
সম্বন্ধ আসছে। কিন্তু অভাবের টানাপোড়নের জন্য মৃন্ময়ী দেবী বিবাহকার্য সম্পাদন করতে পারছেন না।
মৃন্ময়ী দেবী প্রায় মতিচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন।
কিভাবে কেমন করে অরুণিমার বিবাহকার্য সম্পাদন করবেন। অভাবের সংসারে দুঃখকষ্ট যন্ত্রণা লেগেই থাকে। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত মৃন্ময়ী দেবীর সামাজিক যন্ত্রণার অন্ত ছিলোনা। একেকজন একেক কথা এসে বলে। কেউ কেউ বলে এতো বড় বিবাহ উপযুক্ত মেয়েকে কেমন করে ঘরে রাখো? এসব শুনে মৃন্ময়ী দেবী প্রায় হতাশা গ্রস্ত হয়ে পড়ে আছেন।
পাড়ার সবাই অরুণিমা কে দিদি বলে ডাকে।
আমি আর বিনোদ আমরা দুজনি দিদি বলে ডাকি। দিদি ডাকটা সবসময় আমার বেশ মিষ্টি।
পৌষসংক্রান্তি চলে গিয়েছে। অরুণিমা দিদির জন্য এক পরিবার হইতে বিবাহের সম্বন্ধ এসেছে। পাত্র কেরানি।
পাত্রের পরিবারে মা বাবা ও ভাইবোন মিলে প্রায় দশজন লোক। পাত্রের ভালো চাকরি শুনে মৃন্ময়ী দেবী কিছুতেই পাত্র হাতছাড়া করতে চান না। পাত্রের পরিবারকে যাচাই বাছাই না করে মৃন্ময়ী দেবী বিবাহের দিনতারিখ প্রায় ঠিক করে ফেলেছেন। পাত্রপক্ষ থেকে বেশ যৌতুক চাওয়া হয়েছে। এসব অর্থের দিকে না চেয়ে মৃন্ময়ী দেবী রাজি হয়ে যান। পাত্রপক্ষের যৌতুক দিতে গিয়ে মৃন্ময়ী দেবী তার ঘরের সামনের জমিটুকু বিক্রি করে দিলেন। তাহাতে যৌতুক টাকা না শুধরাতে বলরাম দাদার কাছে হাত পাতলে বলরাম দাদা বলেন বিবাহের সম্পূর্ণ খরচা কুলিয়ে নিবেন তিনি।
যাই হোক একি দিনে অরুণিমা দিদির বাগদান ও সম্প্রদান সম্পূর্ণ হয়। বাড়িতে মৃন্ময়ী দেবী একা।
তার একমাত্র মেয়ে অরুণিমা দ্বিরাগমনে আসার কথা ছিলো। কিন্তু অরুণিমার শুশুড় বাড়িতে চিঠি পাঠায় মৃন্ময়ী দেবীর সহায়সম্বল ভিটেমাটি টুকু বরকে দান করে দেওয়ার জন্য। তা না হলে অরুণিমাকে বাপের বাড়িতে আসতে দেওয়া হবে না।
একথা শুনে মৃন্ময়ী দেবী তার একমাত্র সহায়সম্বল বসতবাড়ি দান করে দেন। বরের পিতা তা কড়া দামে বিক্রি করে পুরো টাকা নিয়ে বাড়ি চলে যান।
এদিকে একের পর এক চিঠি আসছে অরুণিমার শুশুড় বাড়ি থেকে। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত নানা নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে অরুণিমা। যার কোন অন্ত ছিলো না।
মৃন্ময়ী দেবী ভিটেমাটিহীন,নিঃস্ব হয়ে এদিক ওদিক একা একা ভবঘুরে হয়ে ঘুরছেন। একদিন তাঁর একমাত্র কন্য অরুণিমাকে দেখতে গেলে তাঁকে মারধর করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এমনকি অরুণিমার মুখটুকু তাঁকে দেখতে দেওয়া হয়নি। অসহায় হয়ে বাড়ি ফিরে ভিটেমাটি হীন ভূমিতে চেয়ে চেয়ে আকুল সুরে কান্না করছেন মৃন্ময়ী দেবী।
মাস নয় এক পর অরুণিমার শুশুড় বাড়ি থেকে একখানা চিঠি এসেছে অরুণিমা যক্ষারোগে মারা গিয়েছে। মৃত্যুশয্যায় পতিত অরুণিমাকে শেষ দেখা দেখতে গেলেন অন্তঃপুরে মৃন্ময়ী দেবী। সেখানে গিয়ে তাঁর একমাত্র মেয়ে অরুণিমাকে দুচোখ ভরে দেখতে পাননি। অরুণিমার দেহখানি অগ্নিতে দাউদাউ করে জ্বলছে। অন্তষ্টিক্রিয়া প্রায় শেষ হয়ে গেলে অরুণিমার শুশুর শাশুড়ি কান্না করে বলছে বেয়াইন আমাদের একমাত্র আদারের বৌমা এভাবে চলে যাবে ভাবতেও পারি না। এই নেন তার অস্থি আপনার বাড়ির পাশ দিয়ে গঙ্গানদী বয়ে গিয়েছে সেখানে তার অস্থিখানা বিসর্জন করে দিবেন।
আমরা তার শ্রাদ্ধক্রিয়া চালিয়ে নেবো।
মৃন্ময়ী দেবী চোখেরজলে ভাসতে ভাসতে একমাত্র মেয়ে অরুণিমার কপালের অস্থিখানা বুকে নিয়ে অসহায় হয়ে ভিটেমাটি হীন ভূমিতে ফিরে গঙ্গাজলে ভাসিয়ে দিলেন অরুণিমার অস্থিখানা।
অসহায় আর দারিদ্র্য জর্জরিত ভিটেমাটি হীন মৃন্ময়ী দেবীর মাতৃহৃদয়ের কান্না আবহ বেড়েই চলছে।
মৃন্ময়ী দেবীর চোখেরজল কবে থামবে?
কবে থামবে সমাজের যৌতুক প্রথা নিয়ে সদ্যজাত বধূর উপর নির্যাতন।
অসহায়,দারিদ্র্য জর্জরিত যৌতুক প্রথার নামে বেদনাদীর্ণ মৃত্যুশোক যেন আর না আসে এ সমাজে।

চলবে...

0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ