নেপোলিয়ন নামটি উচ্চারিত হলে মনের পর্দায় ভেসে উঠে ধূসর কোট আর অদ্ভুত টুপি পড়া একজন ছোটখাট গড়নের মানুষ যার ভাষণে ছিল জনতাকে সম্মোহিত করার অনন্য ক্ষমতা। কারো কাছে তিনি অসাধারণ নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পন্ন দেশপ্রমিক বিপ্লবী যার সামরিক দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। প্রশাসনিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন সুদক্ষ। আবার অনেকের কাছে তিনি ছিলেন পীড়নকারী স্বৈরশাসক ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা যাকে করে তুলেছিল নিষ্ঠুর ও নির্দয়। নিজস্ব ইগোর ভিতরে এই দম্ভ গড়ে উঠেছিল যে তিনি কোন ভুল করতেই পারেন না! মিথের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ঐতিহাসিক চরিত্রকে বুঝে উঠা সত্যিই কষ্টসাধ্য!

নেপোলিয়ন জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভূমধ্যসাগরের দ্বীপ কর্সিকাতে। কর্সিকা দ্বীপ সেই সময় ইতালির জেনোয়ার শাসনাধীন ছিল। নেপোলিয়নের জন্মের বছর ফ্রান্স এটার দখল নিয়েছিল। বাবা কার্লোস বোনাপার্ট পেশায় আইনজীবী ছিলেন। পাশাপাশি ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই এর রাজসভায় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। কাজের ব্যস্ততায় পরিবারকে বেশি সময় দিতে পারতেন না। নেপোলিয়নের শৈশবের বেড়ে উঠায় মা মারিয়া লেটিজিয়া বোনাপার্টের প্রভাব ছিল অনেক বেশি। লেটিজিয়া দৃড়চেতা নারী ছিলেন। সন্তানদের কঠোর নিয়মের মধ্য রেখেছিলেন। ফ্রান্স কর্সিকা দখলের পর সেখানে ফরাসি ভাষা বাধ্যতামূলক করলেও তিনি পুরো জীবনে কখনো একটি ফরাসি শব্দও উচ্চারণ করেন নি। এর ফলে নেপোলিয়নের ও ফরাসি ভাষা দক্ষতার সাথে শেখা হয়নি। তিনি ইতালিক উচ্চারণে, ইতালীয় ভাষার রীতিতে ফরাসি বলতেন। লেটিজিয়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে কিছুটা বাতিকগ্রস্ত ছিলেন। প্রতিদিন সন্তানদের গোসল করাতেন যা ঐ সময়ের প্রচলিত নিয়ম ছিলনা। সংগ্রামী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন তেজস্বী কর্মচঞ্চল। মা নেপোলিয়নের আবেগের মূলকেন্দ্র ছিলেন আজীবন। মায়ের এইসব সংগ্রামী চরিত্র তার মধ্যেও ছিল।

নেপোলিয়নের শিক্ষাজীবন অগোছালো কিন্তু পান্ডিত্যপূর্ণ ছিল। বই পড়তে ভালোবাসতেন; আগ্রহী ছিলেন প্রাচীন সামরিক ইতিহাসের প্রতি। গণিতেও প্রতিভা ছিল। ইতিহাসের আরেক মহান নায়কের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ জন্মেছিল যার নাম জুলিয়াস সিজার! সিজার অন্য জাতি ও সংস্কৃতির উপর আক্রমণ ও আধিপত্যবাদের মাধ্যমে রোমান প্রজাতন্ত্রকে রোমান সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। ইতিহাসের এই পাঠ থেকেই হয়ত তিনি জুলিয়াস সিজারকে অনুকরণ করতে চেয়েছিলেন। রোমানদের মতো করেই হয়ত তিনি সবকিছু জয় করার বাসনা পুষে রাখতেন। শিক্ষাজীবনে কৃতিত্ব দেখালেও কর্সিকার অধিবাসী হওয়ায় সামাজিক ভাবে হীনমন্যতায় ভুগতে বাধ্য করা হত। নিজের ভিতরের গর্ববোধ তাকে এসব মেনে নিয়ে অন্যদের সাথে মেশার চেষ্টা থেকে বিরত রেখে নিজের মতো থাকতে অনুপ্রাণিত করেছিল। চামড়ার রং, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদির কারণে মূল ফরাসি ভূখন্ডের মানুষদের থেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে যথেষ্ট বুলিং এর শিকার হতে হয়েছিল। টিটকারি করে তার নাম দেয়া হয়েছিল ‘Pallie Au Nez’ যার অর্থ গ্রামদেশ থেকে আসা কৃষক যার শরীরে খড় লেগে আছে! তাচ্ছিল্য অর্থে ব্যবহার করা হতো এটা। কর্সিকান জাতিকে পরাজিত ও কাপুরুষ বলে অপমান করা হতো। এই অপমান নেপোলিয়ন জীবনের শেষতক মনে রেখেছিলেন। হয়ত এই ঘটনাগুলি তাকে সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা, প্ররোচনা সবই দিয়েছিল। গ্রাজুয়েশন শেষে প্যারীসের মিলিটারি একাডেমিতে সামরিক প্রশিক্ষণে যোগ দিয়ে দুই বছরের কোর্স মাত্র এক বছরেই সাফল্যের সাথে শেষ করেছিলেন। এরপর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে সামরিক বাহিনীতে কাজ শুরু করেছিলেন। প্রখর বুদ্ধিমত্ততার অধিকারী ছিলেন। ফলে কোন একটি পরিস্থিতিতে অনেক বড় পরিসর থেকে চিন্তা করতে পারতেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে আজীবন তাড়িত করেছিল। প্রায়ই তার চাহিদা গুলো ছিল আয়ত্ত্বের বাইরে। তবে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তা আয়ত্ত্বে আনতেন। সাথে ছিল নেতৃত্ব দেয়ার সহজাত ক্ষমতা।

জোসেফিন

ফ্রান্সের রাজনৈতিক পটভূমি তখন উত্তাল। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবে রাজতন্ত্র উৎখাত হলেও রক্তপাত বন্ধ হচ্ছিল না। অন্যান্য ইউরোপিয় শক্তিগুলো ভয় পেয়েছিল যে এই বিপ্লব তাদের দেশেও না ছড়িয়ে পড়ে! তারা কোয়ালিশন করে ফ্রান্স এবং সে দেশের বিপ্লবীদের উপর আক্রমণ শুরু করেছিল। কিন্তু এই বিপ্লব নেপোলিয়নকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ ও করে দিয়েছিল। সময়টা ছিল ভয়ের (Reign of Terror)। বিপ্লব পরবর্তী নতুন সরকারের বিরুদ্ধে যেকোন প্রতিরোধকে তীব্রভাবে দমন করার নীতি গ্রহণ করেছিল ফরাসি সেনাবাহিনী। এই সময়ে যুদ্ধক্ষেত্রে কৃতিত্ব দেখিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ উন্নীত হয়েছিলেন। ধীরে ধীরে নতুন শাসকদের কাছের মানুষ হয়ে উঠছিলেন। দক্ষ সৈনিক হলেও কিছুটা অগোছালো থাকতেন, রসবোধের অভাব ছিল, সবসময় গুরুগম্ভীর থাকতেন। এই উত্তাল সময়ে জোসেফিনের প্রেমে পড়েছিলেন। সময়টা খুব জটিল ছিল সাথে আরো বেশি জটিল চরিত্র ছিল জোসেফিনের! ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে ফরাসি অভিজাতের সাথে ভালোবাসাহীন বৈবাহিক জীবনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। সেই বিশৃঙ্খল সময়ে বিপ্লবের ডামাডোলে স্বামীর ভয়াবহ মৃত্যু সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল। সামান্যের জন্য নিজে রক্ষা পেয়েছিলেন। এই মৃত্যুকে সামনে থেকে দেখার দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা হয়ত তাকে পুরো বদলে দিয়েছিল। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আরো বেড়ে গিয়েছিল। বুঝতে পেরেছিলেন ওইসময়ে তার মতো মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় ছিল ক্ষমতাবান ও বিত্তশালী কারো সংস্পর্শে থাকা! তখন থেকে তিনি ক্ষমতাবানদের চোখে চোখে থাকতে ভালোবাসতেন। অনেক সন্দেহ করতো অভিজাত জীবন যাপনে অভ্যস্ত জোসেফিন তরুণ জেনারেলের কাছে বিপ্লব চলাকালীন বিশৃংখলায় নিরাপদ জীবনের সুযোগ খুঁজেছিল! অনেকে আবার মনে করেন সেই সময়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা পল বারাস নেপোলিয়নকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই সম্পর্কে উৎসাহিত করেছিলেন। স্বামীর গিলোটিনে শিরোচ্ছেদের পর জোসেফিনকে জেলে যেতে হয়েছিল। নেপোলিয়নের সাথে পরিচয়ের সময় তিনি তৎকালীন শাসক পল বারাসের মিসট্রেস হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। কথিত আছে পল বারাস জোসেফিনকে সরিয়ে নতুন মিস্ট্রেস রাখতে চাচ্ছিলেন। এরকম সময়ে পার্টিতে দেখা হয়েছিল জেনারেল নেপোলিয়নের সাথে। দীর্ঘ জীবনযুদ্ধের উথান পতন জোসেফিনকে নিঃখুত অভিনয় করতে শিখিয়েছিল। প্রথম দর্শনেই নেপোলিয়নকে আকৃষ্ট করার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেছিলেন। সফল ও হয়েছিলেন বলা যায়। নেপোলিয়ন তার প্রতি প্রচন্ড মুগ্ধ হয়ে পড়েন। তখন নেপোলিয়নের বয়স ছাব্বিশ এবং জোসেফিনের বত্রিশ। নেপোলিয়ন এতোটাই তীব্র ভালোবাসায় পরেছিলেন যে  অধিকারবোধ বা পজেসিভনেস জন্ম নিয়েছিল। আগের ডাকনাম ‘রোজ’ পালটে নতুম ডাকনাম ‘জোসেফিন’ বলে ডাকতেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রোজ নামে যেহেতু আগের স্বামী তাকে সম্বোধন করত তিনি সে নামে ডাকবেন না! রোমান্টিকতায় ভরা প্রেম পত্র লিখতেন।

জোসেফিন ও নেপোলিয়ন

১৭৯৬ সালে নেপোলিয়ন ও জোসেফিন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। অনুষ্ঠান খুবই অনাড়ম্বর ছিল। সেই সময়ে প্রথা ছিল কনে দেরী করে পৌঁছানোর, কিন্তু সবাইকে অবাক করে নেপোলিয়ন প্রায় দুই ঘন্টা দেরীতে আসরে পৌঁছেছিলেন। এই ঘটনা গুঞ্জন আরে বাড়িয়ে দিয়েছিলে যে এটা সত্যি ভালোবাসা থেকে বিয়ে নাকি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কোন সম্পর্ক বা চুক্তি! বিয়ের অল্প কয়েকদিন পর নেপোলিয়ন ইতালিতে তার সৈন্য বহরের সাথে যোগ দিতে গেলেন। অন্যদিকে ফ্রান্স থেকে তার ভাই পত্র মারফৎ জানাল জোসেফিন অশ্বারোহী বাহিনীর অফিসার সুদর্শন লুই হিপ্পোলাইট চার্লস এর সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটাচ্ছেন! তার জোসেফিনকে লেখা তখনকার চিঠি গুলি থেকে এটা মনে হয় স্ত্রীকে ভালোবাসতেন অনেক। জোসেফিন ও আবেগে পরিপূর্ণ উত্তর দিতেন। তবে নেপোলিয়ন যুদ্ধক্ষেত্রে দূরে থাকার সুবাদে প্যারীসে জোসেফিন আরো অনেকের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বজায় রাখতেন! এই সংবাদ নেপোলিয়নের সহকর্মীরাও জানত। কিন্তু মনে মনে ঈর্ষান্বিত হলেও একটা দৃড় বিশ্বাস ছিল যে জোসেফিন হয়ত শুধু তাকেই ভালোবাসেন। নেপোলিয়ন তীব্র ঈর্ষাবোধ এবং বুক ভরা ভালোবাসা নামক দুই অনুভূতির মধ্যে বিচূর্ণ হচ্ছিলেন।

নেপোলিয়ন নিজের জন্য মিসট্রেস নিয়োগ দিলেন। জোসেফিন এবার ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়লেন। তাদের দূরত্ব ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। নেপোলিয়নের জীবনেও একের পর এক মিসট্রেস আসছিল। ব্যক্তিজীবনে দূরত্ব বাড়লেও তাদের লক্ষ্যের মধ্যে একটা মিল ছিল। দুজনেই ক্ষমতার শিখরে যেতে চেয়েছিলেন। মিশর থেকে ফিরে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের সময় জোসেফিন ছিলেন নেপোলিয়নের প্রধান রাজনৈতিক সহযোগী। মুগ্ধ নেপোলিয়নের কাছে তিনি পুনরায় হয়ে উঠেছিলেন সৌভাগ্যের প্রতীক। ১৮০৪ সালে জোসেফিনকে সম্রাজ্ঞী ঘোষণা করেছিলেন। এর পূর্বে ফরাসি দেশে রাণি উপাধি ছিল। জোসেফিনই হলেন প্রথম সম্রাজ্ঞী!

জোসেফিনের রাজ্যাভিষেক

১৮০৭ সালে পোল্যান্ডে পরিচয় হয় কাউন্টেস মারি ওয়ালেস্কার সাথে। তখন মারির বয়স বিশ আর তার স্বামী কাউন্টেস আনাস্তেসি ওয়ালস্কির একাত্তর চলছিল। ওই বৈবাহিক সম্পর্কের বাঁধা পেরিয়ে মারি ও নেপোলিয়ন প্যারীস ও ভিয়েনায় অনেক সময় একসাথে কাটিয়েছিলেন। গুজব আছে ১৮১০ সালে মারি ওয়ালেস্কি যে সন্তানের জন্ম দেন তার পিতা নেপোলিয়ন! তখনো মারি কাউন্ট ওয়ালস্কির বৈধ স্ত্রী ছিলেন। কাউন্ট ওই সন্তানকে নিজের সন্তান ও উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করেছিলেন। মারি সম্ভবত সত্যিই নেপোলিয়নকে ভালোবাসতেন। যখন নেপোলিয়ন সব হারিয়ে এলবা দ্বীপে নির্বাসিত হয়েছিলেন সেখানেও তার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন মারি!

মারি ওয়ালেস্কা

নেপোলিয়নের নারীদের নিয়ে প্রথম দিকের অভিজ্ঞতা খুব বেশি সুখকর ছিলনা। ছাত্রজীবনে এই ব্যাপারে রক্ষণশীল ছিলেন। যদিও আঠারো বছর বয়সে জীবনে প্রথম একজন গণিকার সাথে মিলিত হয়েছিলেন। তিনি এটাকে বর্ননা করেছিলেন একটি বৈজ্ঞানিক এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে। অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন এটা স্রেফ একটা শারীরিক অনুভূতি যা সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। জোসেফিন জীবনে আসার পর সেই প্রথম জীবন তার কাছে আনন্দময় লেগেছিল। কিন্তু  যোসেফিন প্রতারণা করেছিলেন এই সন্দেহে আগের দৃষ্টিভংগীতে পুনরায় ফিরে এসেছিলেন। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল নেপোলিয়নিক কোডের আইনে। এখানে নারী স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল। বৈবাহিক জীবনে ও নারী সঙ্গীদের নিয়ে অনিশ্চয়তা ও ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস সম্ভবত অন্যদের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রেও বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছিল। কূটনৈতিক সম্পর্কগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

যদিও তিনি ক্রমশ ক্ষমতাবান হয়ে উঠছিলেন তবু মনে একটা হীনমন্যতা হয়ত কাজ করত যে পুরাতন অভিজাত রাজকীয় পরিবার গুলি হয়ত তাকে সাধারণ প্রজাই ভাবে! স্ত্রী এর অবিশ্বস্ততা সম্পর্কে অবগত হওয়া সত্ত্বেও তার আভিজাত্য নিয়ে মুগ্ধতা দেখাতেন! এমনকি ক্ষমতায় যাওয়ার পর পুরাতন রাজপরিবারের সদস্যদের সাথে নিজ আত্মীয় স্বজনের বিয়ে দিয়ে যেন রাজকীয় বৈধতা খুঁজেছিলেন। যা ছিল ফরাসি বিপ্লবের ধারণার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এই বিপ্লব চেয়েছিল রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ! হয়ত মনের গহীনে আত্মসম্মান বোধের জায়গায় কিছুটা ঘাটতি ছিল। যা তিনি পুরাতন রাজকীয় রক্তের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে দৃড় করতে চেয়েছিলেন।

নেপোলিয়ন ও জোসেফিনের কোন সন্তান ছিলনা। সাম্রাজ্যে উত্তরাধিকারীর দরকার ছিল। এছাড়া অস্ট্রিয়ার সাথেও শান্তি স্থাপনের প্রয়োজন ছিল। প্রথমে তিনি রাশিয়ার জার আলেকজান্ডারের বোনকে বিয়ে করার জন্য জারকে রাজি করিয়েছিলেন। কিন্তু বাধ সাধলেন জারের মা। এরপর জোসেফিনকে ডিভোর্স দিয়ে অস্ট্রিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রান্সিসের মেয়ে আর্চডাচেস ম্যারী লুইসকে বিয়ে করলেন ১৮১০ সালে। কথিত আছে যখন ডিভোর্সের কথা জোসেফিনকে জানিয়েছিলেন করুণ চিৎকার দিয়ে কান্নায় রাজপ্রাসাদ প্রকম্পিত করে মুর্ছা গিয়েছিলেন সম্রাজ্ঞী! এই বিয়ের পিছনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। ভেবেছিলেন এর ফলে অস্ট্রিয়ার সাথে স্থায়ী মৈত্রীতে পৌঁছাতে পারবেন! কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণ করে অস্ট্রিয়া পুনরায় যুদ্ধ ঘোষণা করে ইউরোপের অন্য রাজ্যগুলিকে সাথে নিয়ে তাকে গদিচ্যুত করেছিল। নেপোলিয়ন জোসেফিনকে ভালোবাসতেন। বেশ কয়েকবার ডিভোর্স স্থগিত করেছিলেন এই আশায় যে হয়ত সন্তানের মুখ দেখতে পারবেন। মনে ছিল প্রচন্ড দ্বিধা! দ্বিতীয় বিয়ের পর ১৮১১ সালে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হলো। ইতিহাসে এই সন্তান দ্বিতীয় নেপোলিয়ন নামে পরিচিত। নেপোলিয়নের পরাজয়ের পর তার এই স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে অস্ট্রিয়ায় বাবার বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। তাদের সাথে নেপোলিয়নের আর কখনো দেখা হয়নি।

নেপোলিয়ন দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তানের সাথে

ভগ্ন মনোরথে বিষণ্ণ জোসেফিন গ্রামের একটি প্রাসাদে ফিরে গিয়েছিলেন! সব কিছুর আড়ালে রাখতেন নিজেকে। এরমধ্যে ১১ এপ্রিল, ১৮১৪ সালে পরাজিত হয়ে প্রথম বারের মতো এলবা দ্বীপে  নির্বাসিত হলেন নেপোলিয়ন। এইসময় রাশিয়ার জার আলেকজান্ডার অতিথি হয়ে এসেছিলেন জোসেফিনের প্রাসাদে। শিল্প ও সাহিত্যে দুজনেরই আগ্রহ ছিল। কিন্তু জোসেফিন বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন। শরীরে এসেছিল তীব্র জ্বর। তিনি জারের কাছে অনুনয় বিনয় করেছিলেন যাতে তাকেও নেপোলিয়নের সাথে দ্বীপান্তরে নির্বাসনে থাকার সুযোগ করে দেয়া হয়! নেপোলিয়নকে তখনো ভালোবাসেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, সুখের দিনে যার পাশে ছিলাম দুঃখের দিনে তাকে ছেড়ে যাব কেন! জ্বর কাশি বেড়েই চলছিল। কথিত আছে ২৯ মে, ১৮১৪ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় জোসেফিনের উচ্চারিত শেষ শব্দ ছিল- নেপোলিয়ন…এলবা…!

সেন্ট হেলেনায় নির্বাসিত নেপোলিয়ন

ইতিহাসের চরিত্রগুলোর সত্যিকারের গল্প অনুভূতি উদ্ধার করা দুরুহ কাজ। প্রোপাগান্ডার আড়ালে হয়ত লুকিয়ে আছে বিশুদ্ধ ভালোবাসার গল্প যার পরিণতি সুখকর ছিলনা। জোসেফিনের মৃত্যসংবাদ পেয়ে নির্বাসিত নেপোলিয়ন দুইদিন রুমের দরোজা বন্ধ করে বসেছিলেন। সেন্ট হেলেনায় নির্বাসনে থাকার সময় এক বন্ধুকে বলেছিলেন- ‘আমি সত্যিই জোসেফিনকে ভালোবাসতাম, কিন্তু কখনো তাকে উপযুক্ত সম্মান দেখাইনি!’ সেন্ট হেলেনায় মৃত্যুশয্যায় নেপোলিয়নের মুখে উচ্চারিত শেষ শব্দ ছিল ‘জোসেফিন…’!

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট

তথ্যপুঞ্জীঃ বিভিন্ন বই, গবেষণা প্রবন্ধ, ইন্টারনেট প্রভৃতি।

0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ