নীলিমার প্রেম! (পর্ব-১)

মারজানা ফেরদৌস রুবা ২৮ মার্চ ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ০৯:৩৪:৫৩পূর্বাহ্ন গল্প ৫ মন্তব্য

অবশেষে নীলিমা তার প্রাপ্যতা বুঝে নিয়ে ফরহাদকে বিদায় দিলো এই বলে যে, "যাও, তুমি বরং এখন তোমার অসুস্থ বউয়ের কাছেই যাও। এখন তোমাকে তাঁর বেশি দরকার আর আমার দরজা তো খোলা রইলোই।"
"আচ্ছা যাই, ক্ষমা করো।" বলে ফরহাদ নিজ দেশে ফেরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলো বাসস্ট্যান্ডের দিকে। নীলিমা ফরহাদের চলে যাওয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলো ততোক্ষণ, যতোক্ষণ দেখা যায়। মনে পড়ে যায় ফরহাদের সাথে প্রথম পরিচয়ের কথা। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে স্বামীহারা নীলিমা একা একটা ছোট্ট বাসা ভাড়া করে থাকছিলো। মেয়েকে ভালভাবে পড়াশুনা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার ব্রত নীলিমাকে একাকী পথ চলতে শেখায়। এ শহরে সে অনেককাল যাবতই বসবাস করছে। স্বামী-সন্তান আর ঘরসংসার নিয়েই ছিলো তার ব্যস্ততা। কখনোই কোন কাজের জন্য ঘরের বাইরে পা ফেলতে হয়নি তেমন। কিন্তু অকস্মাৎ একদিন রোড এক্সিডেন্টে স্বামীকে হারিয়ে কুলকিনারাহীন সাগরে পড়ে যায় সে। একমাত্র মেয়ে শীলা সবে কৈশোরে পা দিতে শুরু করেছে। শহরের নামী স্কুলে পড়ছে। এ বিপর্যস্তকর অবস্থায় দিশাহারা নীলিমা কিভাবে কী করবে বুঝে উঠতে পারেনা। ভাইবোনরা যে যার মতো করে থাকলেও দুঃসময়ে সকলেই পাশে এসে দাঁড়ায় তারা। পৈতৃকসম্পত্তির অংশ ক্যাশ করে ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে দেয় যাতে নৈমিত্তিক খরচ চালিয়ে নেয়া যায়। আর শীলার বাবার রেখে যাওয়া টাকাকড়ি শীলার পড়াশুনা বাবত খরচ হচ্ছে। এভাবেই কোনরকমে চলে যাচ্ছিলো মা-মেয়ে দুজনের ছোট্ট সংসার। একদিন ব্যাংকে টাকা তুলতে গিয়ে দেখা ফরহাদের সঙ্গে। দেখতে ভদ্র, মার্জিত গোচের পড়ন্ত মধ্যবয়সী এক লোক। নীলিমা ওরকম সুন্দরী না হলেও চটপটে হাস্যোজ্জ্বল চরিত্রের কারণে সহজেই লোকের দৃষ্টি কাড়ে। ব্যাংকে টাকা তুলতে এসে দেখে বেশ ভীড় লেগে আছে আবার ট্র্যানজেকশন সময়ও তেমন নেই। এদিকে আজকে টাকাটা তুলতেই হবে। কাল মেয়ের ফি জমা দিতে হবে। মেয়ের স্কুলের কাজ শেষ করে মেয়েকে স্কুলে রেখে রাস্তার জ্যাম ঠেলে আসতেই বেলা শেষ। বুঝতেই পারেনি আজ এতো ভীড় হবে। লম্বা লাইনের শেষমাথায় দাঁড়িয়ে উসখুস করছিলো আর হাতঘড়ি দেখছিলো বারবার। ফরহাদ অনেকক্ষণ ধরে তার এই অস্থিরতা লক্ষ্য করে অবশেষে নিজেই হাত ইশারায় তাকে সামনে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "আজকেই তুলতে হবে টাকা?"
-হ্যাঁ। কী যে সমস্যায় পড়লাম। কাল মেয়ের স্কুলের ফি জমা দিতেই হবে।
-তাহলে চেকটা আমার হাতে দিন। আমি আমার টাকার সাথে এটাও তুলে দিচ্ছি। কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে নীলিমা চেকটা ফরহাদের হাতে দিতে পেরেই যেনো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
-আপনি ওখানটায় বসুন, হয়তো আরও দশমিনিট লাগতে পারে সিরিয়াল আসতে।
নিশ্চিন্তমনে নীলিমা সোফার দিকে এগিয়ে যায়। একটুপরেই ফরহাদ টাকার বাণ্ডিল হাতে নিয়ে এগিয়ে আসলে উঠে দাঁড়ায় সে। ধন্যবাদ দিতে দিতে বলে, "ভাই বাঁচালেন, কি যে টেনশনে পড়েছিলাম।" ফরহাদও সহাস্যে বলে, "ইটস ওকে।" বেরিয়ে যায় ফরহাদ। বেরিয়ে আসে নীলিমাও।

কদিন পর আবারও দুজনের দেখা একটা ফুডকোর্টের সামনে। নীলিমা মেয়েকে নিয়ে বেরুচ্ছিলো আর ফরহাদ ঢুকছিলো। সামনাসামনি দেখা হওয়ায় মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, "এই যে দেখো, তোমার সেই আঙ্কেল। তুমি জানো না, সেদিন এই ভাই না হলে আদৌ টাকা তুলতে পারতাম কি না সন্দেহ।" শীলাও স্মিত হেসে সালাম বিনিময় করে। "আচ্ছা ভাই, আসি" বলে নীলিমা পা বাড়ায়। ফরহাদ তাদের রিক্সায় উঠা অবধি দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে ঢুকে।

এর প্রায় মাস তিনেক পর একদিন আবার দেখা হয় দুজনের। মেয়েকে ভিকারুন্নেছায় নামিয়ে দিয়ে টুকটাক কেনাকাটা করতে বেরিয়েছে নীলিমা। সকাল বেলায় বেইলিরোডটা সাধারণত নীরব থাকে। জমে উঠে বিকাল বেলা। হাঁটার জো থাকে না তখন। শনিবার বলে ফরহাদও ছুটির দিনে সকাল সকাল এদিকটায় আসে টাঙ্গাইল শাড়ী কুঠির থেকে দুটো শাড়ী কিনবে বলে। সামনে ছুটি নিয়ে দেশে যাওয়ার কথা। স্ত্রী আর কন্যার জন্য দুটো তাঁতের শাড়ী নেবে। গত দুইবারই বারবার করে মেয়ে বলে দিয়েছে, ঢাকার বেলিরোডের টাঙ্গাইল শাড়ী কুঠির থেকে শাড়ী নিয়ে যেতে। কলকাতায় টাঙ্গাইল শাড়ী কুঠিরের শাড়ী খুব প্রসিদ্ধ। ফরহাদ দূর থেকে দেখতে পায় ব্যাংকের সেই মহিলাই যেনো ইয়েলো'তে ঢুকছে। নিশ্চিত হতে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে ইয়েলো'তেই ঢুকে। হ্যাঁ তাইতো। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, "কেমন আছেন?"
মুখ ফিরিয়েই নীলিমা সহাস্যে বলে, "আরে, আপনি?"
-হ্যাঁ, কী সৌভাগ্য দেখেন, দুটো শাড়ী কিনবো ভেবে বেরিয়েছি। ভাবছিলাম, আমি তো এগুলো এতো বুঝিনা, কিভাবে কিনবো? আর অমনি আপনাকে পেয়ে গেলাম।
-তাই?
-হ্যাঁ, তাইতো। হবে আপনার একটু সময়?
-তা হবে না? সেদিন কী বিপদ থেকেই না বাঁচিয়েছিলেন। আর এ তো দুটো শাড়ী পছন্দ করে দেয়া মাত্র।
-ধন্যবাদ
-চলুন তাহলে।
-চলুন। বুঝলেন, মেয়ে বলে দিয়েছে টাঙ্গাইল শাড়ী কুঠির থেকেই যেনো শাড়ীটা কিনি।
-তাই! শাড়ী কুঠিরের শাড়ী মেয়ের খুব পছন্দ?
-বাংলাদেশে যারাই আসে এখান থেকে শাড়ী নিয়ে যায়। মেয়েরও তাই আবদার।
-বাংলাদেশে আসে মানে? মেয়ে কোথায় থাকে?
-আমি আসলে কলকাতার মানুষ। চাকুরীসূত্রে এখানে থাকছি।
-ও আচ্ছা, তাই!
দুজনে মিলে টাঙ্গাইল শাড়ী কুঠিরে ঢুকলো। নীলিমা ফরহাদের বউ আর মেয়ের জন্য দুটো শাড়ী পছন্দ করে দিলো। বিল মিটিয়ে দুজনে বের হয়ে নীলিমা বিদায় নিতে যাবে অমনি ফরহাদ অনুরোধ করে কফি পানের। এমনভাবে অনুরোধ করে যে নীলিমা তা এড়াতেই পারে না।
এভাবেই আস্তে আস্তে পরিচয়ের গণ্ডি পেরিয়ে একসময়ে তা প্রণয়ে রুপ নেয়। নীলিমার একাকীত্ব আর ফরহাদের একাকীত্বে ভিন্নতা থাকলেও তারা একে অপরের জন্য একসময় অপরিহার্য হয়ে উঠে। মনের গণ্ডি যখন একবিন্দুতে এসে দাঁড়ায় তখন দুজনের মধ্যে দৈহিক টানও অনুভূত হতে থাকে। কিন্তু বয়স, পারিপার্শ্বিকতা, নীতিবোধে আবিষ্ট নীলিমা নিজের মধ্যে অবচেতনভাবেই এক অদৃশ্য সীমারেখা টেনে রাখে। ফরহাদ অনেকভাবে তাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। প্রেমের টানে নীলিমা দোলায়িতও হয় মাঝেমধ্যে কিন্তু পরক্ষণেই আবার বোধের জাগরণ তাকে নিবৃত করে। দীর্ঘ চেষ্টার পর একসময় ফরহাদও বুঝে যায় আবেগের জালে জড়িয়ে যতোই টানাটানি করুক না কেনো টলানো যাবে না তাকে। অবশেষে ফরহাদ বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব রাখে নীলিমার কাছে। ইতোমধ্যে নীলিমার মেয়ের সাথেও ফরহাদ ভালো বন্ধুত্ব গড়ে তুলে। এ পরিস্থিতিতে বৈবাহিক প্রক্রিয়ায় ফরহাদকে সামাজিক সম্পর্কে জড়িয়ে নেয়ার জন্য নীলিমার সামনে কোন বাঁধার দেয়াল না থাকলেও বাঁধ সাধে ফরহাদের বিবাহিত জীবন। যদিও ফরহাদ বলে এটা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার তবুও বোধের জগতের যে অদৃশ্য বাঁধা তা অতিক্রম করতে পারে না নীলিমা কিছুতেই। বুঝে উঠতে পারেনা কী করবে। ফরহাদ জানায় স্ত্রী থাকলেও তার দীর্ঘ অসুস্থতা ফরহাদের দাম্পত্যকে নিরামিষ এক যাপিত জীবনে আটকে রেখেছে। কর্তব্যবোধে কোন ঘাটতি না রাখলেও স্ত্রী সান্নিধ্যবঞ্চিত জীবন তাকে মারাত্মকরকমভাবে অসুস্থ করে তুলেছে। নীলিমার ভালোবাসায় এর থেকে পরিত্রান পেতে চায় সে। শীলার পিতৃত্বের দায়িত্ব নিয়েই নীলিমার পাশে দাঁড়াতে চায় ফরহাদ। নীলিমাকেও যোগ্য সম্মান দিয়েই আগলে রাখবে। একসময় নীলিমাও ভাবে কাঁচা বয়সে স্বামীহারা হয়ে কতো আর নিজেকে অবদমন করে চলবে? কতোরাত নির্ঘুম কেটেছে শরীরের যন্ত্রণায়। তারচেয়ে এই ভালো, একজন সঙ্গী হলো। একসময় ফরহাদকে শর্ত জুড়ে দেয় বউয়ের পারমিশন আনার। ফরহাদও তাই করে। নীলিমা নিজেই ফরহাদের বউয়ের সাথে কথা বলে। শেষমেশ পারিবারিক সম্মতিতেই বিয়েটা হয়।

বছর দুয়েক তাদের ভালোই কাটে। প্রথম প্রথম নীলিমা অনেকটা জোর করেই ফরহাদকে ছুটিছাটায় দেশে পাঠাত অসুস্থ বউয়ের কাছে। আর ফরহাদের ছিলো ভীষণরকম উদাসীনতা যদিও সে বড় বউয়ের চিকিৎসা বিষয়ে ছিলো খুব সচেতন। মূলত এই উদাসীনতার কারণ নীলিমার সাহচর্য। এমন হলে নীলিমার মধ্যে অপরাধবোধের সৃষ্টি হতো। নীলিমার মনে হতো যেনো ফরহাদ তার জন্যই কলকাতায় যেতে চায় না। একারণে প্রায়শই সে বড়বউয়ের সাথে ফোনে কথা বলে ব্যালেন্স মেইনটেন করে চলত।

চলমান...

0 Shares

৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ