নলডাঙ্গা রাজবাড়ী !!!

আসলে রাজবাড়ী নাম শুনলেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে রাজকীয় ঐতিহ্যে গড়া বিশালাকৃতির অভিজাত ভবন।

এখানে আসলে এখন আর রাজবাড়ীর সেই জৌলুস আর নেই, তবে টিকে আছে সুদৃশ্য ৭টি মন্দির। কালীমাতা মন্দির, লক্ষী মন্দির, গনেশ মন্দির, দুর্গা মন্দির, তারামনি মন্দির, বিষ্ণু মন্দির, রাজেশ্বরী মন্দির। মন্দিরগুলোর নির্মাণশৈলী, নকশা, টেরাকোটার ডিজাইন এগুলো আপনাকে মুগ্ধ করবেই।

ঝিনাইদহ জেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে ও কালীগঞ্জ উপজেলা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে এই প্রাচীন রাজবাড়ির অবস্থান।

প্রতিদিন দেশ বিদেশ থেকে এই রাজবাড়ি দেখতে আসেন পর্যটকরা। স্থানীয়দের ভাষায় এটি নলডাঙ্গা মঠ বা নলডাঙ্গা রাজবাড়ি বলে পরিচিত।

স্থানীয় লোকমুখে এবং ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় পাঁচশ’ বছর আগে এই রাজ বংশের আদি পুরুষ ভট্টরায় ফরিদপুরের তেলিহাটি পরগনার অধীন ভবরাসুর গ্রামে বসবাস করতেন। তারই এক উত্তরসুরী বিষ্ণুদাস হাজরা নলডাঙ্গার রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নবাবের চাকরি করে হাজরা উপাধি পান। তার পিতার নাম ছিল মাধব শুভরাজ খান। তিনিও নবাবের চাকরি করতেন। বৃদ্ধ বয়সে বিষ্ণুদাস ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগী হয়ে সন্ন্যাসী হন এবং ফরিদপুরের ভবরাসুর থেকে নলডাঙ্গার কাছে খড়াসিং গ্রামে চলে আসেন। এবং বেগবতী নদীর তীরে এক জঙ্গলে তপস্যা শুরু করেন। ১৫৯০ সালে মোঘল সুবেদার মানসিংহ বঙ্গ বিজয়ের পর নৌকা যোগে বেগবতী নদী দিয়ে রাজধানী রাজমহলে যাচ্ছিলেন। তার সৈন্যরা পথিমধ্যে রসদ সংগ্রহের জন্য অনুসন্ধানে বের হয়ে বিষ্ণুদাস সন্যাসীকে তপস্যারত অবস্থায় দেখতে পান। এ সময় বিষ্ণুদাস সৈন্যদের খুব দ্রুত রসদ সংগ্রহ করে দেন। এতে সুবেদার মানসিংহ খুশি হয়ে সন্যাসীকে পার্শ্ববর্তী পাঁচটি গ্রাম দান করে যান। এই গ্রামগুলোর সমন্বয়ে প্রথমে হাজরাহাটি জমিদারি এবং ক্রমান্বয়ে তা নলডাঙ্গা রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন এই এলাকাটি নল-নটায় পরিপূর্ণ ছিল, তাই স্থানটি নলডাঙ্গা নামেই অভিহিত হয়। এরপর প্রায় তিনশ’ বছর এ বংশের বিভিন্ন শাসক বিভিন্ন সময়ে রাজ্য শাসন করেন। এবং বিভিন্ন শাসক বিভিন্ন সময়ে বিলুপ্তপ্রায় মন্দিরগুলো প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ১৮৭০ সালে রাজা ইন্দু ভূষণ যক্ষা রোগে মারা গেলে তার নাবালক দত্তক পুত্র রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় রাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এবং তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন আজকের এই বিলুপ্তপ্রায় কয়েকটি মন্দির যা কালের সাক্ষী হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বেগবতী নদীর তীরে।

প্রকৃতপক্ষে রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় ছিলেন বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার কুমড়াবাড়িয়া গ্রামের গুরুগোবিন্দ ঘোষালের কনিষ্ঠ পুত্র। তিনি রাজবংশের কেউ ছিলেন না। রাজা ইন্দু ভূষণ মারা যাওয়ার দীর্ঘ নয় বছর পর ১৮৭৯ সালে পূর্ণ জমিদারি ভার গ্রহণ করেন রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায়। ১৯১৩ সালে তিনি রাজা বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত হন। সে সময় তিনি শিক্ষার প্রতি অনুরাগি হয়ে পিতা-মাতার নামে ইন্দু ভূষণ ও মধুমতি বৃত্তি চালু করেন যা তখনকার সময়ে এক বিরল ঘটনা ছিল। তিনিই ১৮৮২ সালে রাজবাড়ির কাছে আজকের সরকারি নলডাঙ্গা ভূষণ হাই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি এখন কালীগঞ্জে প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। রাজা বাহাদুর প্রথম ভূষণ দেবরায় ১৯৪১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের কাশিতে মারা যান। কুমার পন্নগ ভূষণ দেবরায় ও কুমার মৃগাংক ভূষণ দেবরায় নামে তার দুই পুত্র ছিল। ১৯৫৫ সালে এক সরকারি আদেশে অন্যান্য জমিদারীর মতো এই জমিদারীও সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং রাজবংশ শেষ বারের মতো লোপ পায়।

সরকারী পৃষ্টপোষকতা পেলে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হলে, শুধু পূণ্যার্থী নয়, দর্শনার্থীদের কাছেও আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে এই স্থানটি।

নলডাঙ্গা মন্দির এবং নলডাঙ্গা ভূষণ হাই স্কুল,  আমার শৈশবের অনেক স্মৃতি বিজড়িত স্থান।

এই মূহুর্তে সশরীরে নলডাঙ্গা রাজবাড়ীতে না যেতে পারলেও,

সোনেলার পাঠকরা আমার ক্যামেরার চোখে উপভোগ করতে পারেন রাজবাড়ীর সৌন্দর্য ।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

নলডাঙ্গা ভূষণ হাই স্কুল।

 

 

 

 

0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ