লকডাউন এবং জানালা

জাকিয়া জেসমিন যূথী ১২ এপ্রিল ২০২০, রবিবার, ০৩:৩২:২৩পূর্বাহ্ন গল্প ২৩ মন্তব্য

 

ডেস্কটপ কম্পিউটারে বুঁদ হয়ে ক্লায়েন্টের কাজ করছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিলো পেছনে তাকাতে। আমার পেছনে থাই এর গ্লাস দেয়া জানালা। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ওটা খুলে দেই। আবার বিকেলের আগেই বন্ধ করে দেই। এখনো দুপুর। তাই লাগাইনি। মন বলছে জানালার কাছেই তাকাতে হবে। মনের কথায় পাত্তা না দিয়ে কাজ করা যাচ্ছে না। উজ্জ্বল সূর্যের আলো পড়ে আমার ঘর আলোকিত। আমি পেছন ফিরলাম। এবং বিস্ময়ে আমার চোয়াল ঝুলে পড়লো।

একী দেখছি আমি?

দুজন জোয়ান লোক যাদের উর্ধ্বাংশ উদোম, নিম্নাংশে ট্রাউজার টাইপের পায়জামা পরা আমার জানালার কার্নিশে বসে গ্রীল ধরে দোল খাচ্ছে আর ঘরের ভেতরে নজর তাদের।

আমি তাদের দেখে একদম জমে গিয়েছি। কিন্তু তা বুঝতে না দিয়ে ধমকে উঠলাম, “এই, এই, কে আপনারা? এখানে কেন? কী করছেন হ্যাঁ? ঝুলার আর জায়গা পান না? নামেন। এক্ষণ নামেন।“

কোন ভাবান্তরই হলো না লোকগুলোর। এ সময় চোখে পড়লো ওদের হাতের নাগালের সামান্য বাইরে সোফার উপরে আমি আমার ল্যাপটপ টা রেখেছি। ঘুমোতে যাওয়ার সময় ল্যাপটপ টা প্রতিদিন ডেস্কটপের পাশেই রাখি টেবিলের ওপরে। ক্লায়েন্টের ডিজাইন করার সময়ে টেবিলের ওপরটা মোটামুটি ফাঁকা করে নিলে কাজে আরামবোধ করি।

ছোঁ মেরে ওদের খুব সামনে থেকে ল্যাপটপ টা নিয়ে এসে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লাম। ভাগ্যিস ওরা আমাকে চুলে ধরে টেনে ধরেনি। নিরাপদ দূরত্বে ফিরে এসে এইবার দিলাম চিৎকার। “আবির কোথায় তোমরা? সব যেয়ে মরেছে! এদিকে শুনশান!” প্রথম বাক্যটা চেঁচিয়ে বললেও পরের লাইন দুটো বিড়বিড় করে বললাম।

 

ধরফর করে জেগে উঠলাম। এখনো শ্বাসের দ্রুত গতির ওঠানামা চলছে। চট করে জানালার দিকটায় চেয়ে দেখলাম। লতানো কাজ করা ফুলের শরীরে জানালায় পর্দা উড়ছে হাই ভলিউমে থাকা ফ্যানের জন্য। ঘরটা আধো আলো আধো অন্ধকার। বালিশের পাশে থাকা মোবাইল ফোন সেটের উপরে হাত নিতেই সময় দেখিয়ে দিয়েছে। বিকেল পাঁচটা বাজতে চলেছে। তাড়াতাড়ি উঠতে হবে বিছানা থেকে। তা নইলে আসরের নামাজের দেরী হয়ে যায়। কিন্তু শরীরে কোন জোরই পাচ্ছি না। ইচ্ছে করছে আবিরকে ফোন করে ডেকে নিয়ে আসি এই ঘরে। যে কাজটা সাধারণত আম্মা আমাদের সাথে করে।

দেয়ালের সাথে প্রচন্ড জোরে ব্যথা পেলাম বাম হাঁটুতে। আমার মিনি সাইজের ব্যাচেলর বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমানোর উপায় নেই। ডান কাত হতে গেলে হাত টা বিছানার পাশের টুলের উপর বিছিয়ে দিতে হয়। আর বাম হাত কে গুটিয়ে নিজের শরীরের উপরেই না নিয়ে উপায় নেই। ঘুমের ঘোরে ঠুয়া তো নিয়মিত।

ডাকতে হলো না। আম্মা নিজেই এসে হাজির। তার সাথে সাথে ছোট ভাই আবির। আম্মা এসে দরজায় দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করলো, “কিও? কী পাঠাও খালি মোবাইল টুঙ্গুর টুঙ্গুর করে গানবাজনা করে ডাকে আমারে!” আমি সে কথায় কান না দিয়ে রেগে বলে উঠলাম, “কই থাকো তোমরা? দুই দুইখান উদোম ভূতে নিয়া যাইয়া সারছিলো!”

আম্মা আর ভাই দুজনের পরস্পর চোখাচোখি করতে করতে কথা না বাড়িয়ে মুখ আমসি করে সোফায় বসলো। আর ভাইকে বললাম, “ঐ, আমাকে টেনে তোল। শরীর একেবারে অবশ হয়ে গেছে!”

ভাই দু কান প্রসারিত চওড়া হাসি হেসে বললো, “স্বপ্ন দেখছো?”

 

কাহিনী খুলে বলতেই আম্মা চিন্তিত মনে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকলো। গত কিছুদিন ধরেই বলছিলো, এই জানালা দিয়ে ইন্টারনেট লাইনটা নেয়া ঠিক হয়নি। জানালার লক টা তো লাগানো যায় না।

আমি আগে আমলে নেই নি। আজকে নিজেই বললাম, “লক ডাউন শেষ হলেই আগে জানালার ব্যবস্থা করতে হবে।“ আম্মা চিন্তিত কণ্ঠে বললেন, “কবে যে এই অচলাবস্থা থেকে মুক্তি আসবে!”

ছোট ভাই এর মধ্যে হাতে ধরে ঠিকই টেনে উঠিয়েছে আমাকে। দাঁত কেলিয়ে হেসে টিটকারি মারতে মারতে বলতে লাগলো অত্ত বড় বেটি ভুতের স্বপ্ন দেখে! হে হে হে!

 

স্বপ্নটা অন্তত একটা কাজ করেছে। সতর্ক করেছে আমায়। স্বপ্নের ভয় ভুলে ছুটলাম ওজু করতে। যিনি রক্ষা করবেন সব রকম বিপদাপদ থেকে তার দেয়া দৈনিক পাঠ আগে শেষ করি।

 

(সমাপ্ত)

 

( নোটঃ সংযুক্ত ছবিটির ডিজাইনার হ্যাপি হাসিন)

0 Shares

২৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ