আমাদের ভ্যালেনটাইন

রোকসানা খন্দকার রুকু ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, মঙ্গলবার, ০২:১২:৪৭অপরাহ্ন ছোটগল্প ১৭ মন্তব্য

-বুবু, এই নিন গ্যারেজ, স্টোর রুম আর রান্নাঘরের চাবি। কাল আমি বাসায় থাকতে পারবো না। রান্না করে রেখেছি, তাই গরম করে খাবেন। ছুটিও নিতে পারেন। যদি না নেন তাহলে আপনি রিকসায় অফিস যাবেন কারণ আমি গাড়ি নিয়ে যাবো।

সরিষা দানা বালিশে মেশালে শুতে যেমন মাথায় সুরসুরি লাগে। সেরকম মনের ভেতর সুরসুরি অনুভূত হলো। বলেই ফেললাম মানে কি? তুমি কোথায় যাবে! আর বাবুকে দেখবে কে?

-ওমা! সেকি? আপনি জানেন না কাল বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস। আমরা ঘুরতে যাবো সেজন্যই তো গাড়ি নিলাম। গাড়ি যদি না দেন তাহলে তিনদিন আসবো না। তখন বুঝবেন, সংসার চালানো কাকে বলে।

হেসেই ফেললাম। এই মেয়েটি কথা বলে একদম ঝারাতারা। একটুও ভুল নেই। আমার সাথে বেরুলে কেউ বলে না আমার বাসার কাজের মেয়ে। এতো ফিটফাট আর সুন্দর যে সবাই আমার বোন হিসেবেই জানে। দশ বছরের মেয়েটিকে এনেছিলাম। এখন সে ষোল বছর পার করে গেছে। তার আবার প্রেমিকও আছে, সে আমার গাড়ি চালায়। এক সকালে সে লম্বা পাতলা এক যুবককে নিয়ে হাজির।

কি ব্যাপার!

সে ঝটপট জানালো, এর সাথে আমার বিয়ে হবে। তাই ধরে নিয়ে এলাম, আমাদের গাড়ি চালাবে। এখানেই থাকবে। একসময় পয়সা জমে গেলে আমরা বিয়ে করে ফেলবো।

দুজনে কাল বেড়াবে। যদি না করি, তাহলে ঠিকই তিনদিন কোথাও লুকিয়ে থাকবে। চারদিনের দিন কাঁদতে কাঁদতে বাসায় হাজির হবে। সরি বলবে, এবং বাবুকে বুকে নিয়ে খুব কাঁদবে। তারপর ঝাড়ু হাতে নেমে পড়বে। একগাদা কাপড় কাচবে, রান্না করবে। বাড়ি- ঘর ঝকঝকে করে তুলবে। আর সারাক্ষন বকবক করবে, আমি কেন এতো অপরিস্কার?

ঝরনা, সবসময় আমাদের বলে। এটা শুনতে আমার ভালোই লাগে। আমার সংসারের সকল খুঁটিনাটি সেই দ্যাখে। পান থেকে চুন খসতে দেয় না। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছে। খুব জেদ করলাম, ম্যাট্রিকটা দিতে। তার নাকি সাজুগুজু ছাড়া কিছু ভালো লাগে না। আমার যতো প্রসাধন সামগ্রী সব সে ব্যবহার করে। সেজে- গুজে আমাকে দেখায়। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে ফ্যাশান শো- এর মডেল হতে চায়। আমি খুব হাসি।

আমার মা আমাকে বলে, নাহিদা অন্তত এই মেয়ের কাছে সংসার শেখো। মাকে বলতে মন চায়, নিজে যে কতোটা সংসার বুঝেছ, আমার জানা আছে। তিনটা কাজের মেয়ে ছিলো তোমার, সারাদিন ক্যাটর ক্যাটর করা ছিলো তোমার কাজ। তা আর না বলে, আমিও মাঝে মাঝে সংসার শিখতে বসে যাই। কি করে দুধ- ডিম মিশিয়ে ব্লেন্ডারে দিয়ে ফ্রিজে ঠান্ডা করে লোভনীয় খাবার তৈরি হয়।

আমি বা হাতে খাই। এটা ঝরনার ভীষন অপছন্দ। অল্পদিনের মধ্যেই আমার বা হাতে খাওয়া সে বন্ধ করে দিলো। বুবু, ডান হাতে খেতে হয়। যদিও হাত দুটোই তারপরও ডানহাতে খেলে শান্তি বেশি হয়। আর আপনি যে লিকলিকে, দেখেন ডানহাতে খেলে শরীরে একটু মেদ জমবে। মেয়েদের সামান্য ভূডি ছাড়া ভালো লাগে না। কথা সত্যি! ছ’ বছরে আমারও বেশ মেদ জমে গেছে। আমি এখন রীতিমতো মহিলা এবং আমাকে জিমে যেতে হয়।

দশটা নাগাদ ঝরনা বেডিয়ে গেলো। আবারও আমাকে সব বুঝিয়ে বলে দিলো। এরপর আমাকে নতুন বউ এর মতো পা ছুঁয়ে সালাম করলো। আমি যে শাড়িটা এনেছিলাম, সেটি পরেছে। খুব সুন্দর লাগছে। কাল রাতে যখন তাকে শাড়ি দিলাম সে হো হো করে কেঁদে দিলো। সে কান্না থামাতে তাকে অবশ্যই মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হবে। না হলে জোডে জোড়ে কাঁদতেই থাকবে।

আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। আজ আমি বাসা, মেয়েকে, মেয়ের বাবাকে, আমার মাকে সামলাবো। সে বিকেল পর্যন্ত ঘুরবে। যাবার সময় তার হাতে পাঁচশ টাকা দিলাম। সে আবার কেঁদে দিলো। আমি ঈশারায় বললাম, কেঁদোনা, কাজল নষ্ট হবে। মিনিটেই কান্না বন্ধ। অদ্ভুত মেয়ে।

বিকেল হলেই আমার চরম আদা চায়ের তেষ্টা পায়। গলা শুকাতে থাকে। এটা অনেক বছরের অভ্যাস। চা যদি যেমন তেমন হয় তাতে কাজ হয় না। তখন খুব দ্রুত বাসায় ফিরে আসি। ঝরনা চা বানিয়ে দেয়। শাওয়ার থেকে ফিরেই টেবিলে ধোয়া তোলা চা আর বাদাম। জীবন যেন প্রাণ ফিরে পায়।

আজ নিজে গেলাম চা বানাতে। কেমন করে গরম পানি এসে ছলকে পড়লো হাতে। আর চা নামক যে লাল পানি বানিয়েছি তা একেবারেই মুখে দেবার অযোগ্য। চা রেখে পোড়া হাতে পেষ্ট লাগিয়ে বসে আছি। মা ক্যাটর ক্যাটর করছে, এসময়েই তার অতিরিক্ত চিনি দিয়ে চা চাই। আদিত্যর ফোন বেজেই চলছে, সে বাসায় ফিরছে। মেয়ে ঘুম থেকে উঠে বিছানায় হাগু করে ট্যা ট্যা করে কাঁদছে।

এতোসবে আমারও রীতিমতো কান্না পেয়ে গেলো। হাতের জ্বলুনিতে চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। এমন সময় আদিত্য বাসায় এলো। নাক সিটকে রুম থেকে বেডিয়ে চিৎকার দিতে দিতে, নাহিদা বাবু পটি করেছে! ফেলে দাওনি কেন? কাল বলেছিলাম, কাজের মেয়েকে না ছাড়তে। তোমার যতোসব ঢং। এখন বোঝ। এখন আমার কফি দাও আমি খেলতে যাবো।

আমি একচুলও নড়লাম না। সংসার বড়ই অসহ্য জিনিস। আর আমার মতো মানুষের জন্য তো সংসার অবশ্যই না। কেন যে এ ভুল করলাম।

সন্ধ্যা সাতটা ছুঁইছুঁই, ঝরনা হাসতে হাসতে প্যাকেট হাতে বাসায় ঢুকলো। ডাইনিং-এ আমি বসে। আমাকে এ অবস্থায় দেখে সে হা হা করে উঠলো। যেন তারই কষ্ট হচ্ছে। এক দৌড়ে শাড়ি খুলে নেমে পড়লো আমার সংসার যজ্ঞে। কিছুক্ষনের মধ্যেই সব শান্ত। আমাকে ওষুধ লাগিয়ে এক মগ আদাযুক্ত ধোয়া তোলা চা আর দ্ই ফুচকা খেতে দিলো।

আশ্চর্য হলেও সত্যি আমি সারাদিনের সমস্ত কষ্ট এই মেয়েটার হাসিমুখ দেখে ভুলে গেলাম। আমি চা খাচ্ছি আর সে হাতে ফুঁ দিয়ে দিচ্ছে। কি অপূর্ব দৃশ্য!

ছ’বছর আগে আমি যখন ঝরনাকে নিয়ে এলাম। আদিত্য তো মহাবিরক্ত। কারণ আমি নাকি আদিখ্যেতা করি। বিছানায় শুতে দেই, আলাদা ঘর দিয়েছি। আমার মতোই তার জন্যও কেনাকাটা করি। আমাদের সাথেই সে খায়। বাইরে বের হলেও তাকে নিয়ে যাই। মাঝে মাঝে গানের কুইজ খেলি। এসব আমাকে মানায় না। কাজের মানুষ তার মতোই থাকবে।

আমি কিছুই বলি না। কারন বিয়ের এতোগুলো বছরে আদিত্য আমাকে কোন কাজে কখনও হেল্প করেনি। সে কাজ পারেও না আর তার সময়ও নেই। বরং আমি কিছু পারিনা এটা নিয়ে নানা কথা শুনতে হয়েছে। এই মেয়েটি আসার পর থেকে আমি চরম স্বস্তিতে আছি। তাহলে অবশ্যই তাকে আমি বিশেষ দিনে তার মতো করে চলতে দিবো। এবং গাড়িও দিয়ে দেবো। আর কোনদিনই আমি তাকে আমার কাছ থেকে যেতে দিবো না। বিয়ে দিবো সে এখানেই সংসার করবে। বড় বোনের মতো আমি তাদের সংসারে সব সাজিয়ে দিবো।

আদিত্য খেলতে ক্লাবে গেছে। আজ ভ্যালেন্টাইন তার হয়তো মনেও নেই। কিংবা এসব যাচ্ছে তাই ব্যাপার বলে তার কাছে মনে হতে পারে। আমার মায়ের এ মানুষটাকে কেন এতো পছন্দ আমি জানিনা। হয়তো তার অনেক পয়সা বলেই! আমি আর ঝরনা বসে গেলাম কুইজ খেলতে। মেয়ে ঘুমিয়ে গেছে।

ঝরনা হঠাৎ বললো, বুবু আসছি।

টকটকে লাল গোলাপ সে আমার দিকে ধরলো। আমি তাকে যে টাকা দিয়েছিলাম তার কিছুই সে খরচ করেনি। আমাদের জন্য খাবার আর ফুল কিনেছে। আমি কেঁদে ফেললাম। আমার ম্যারেজ ডেও সে ভোলে না। অথচ দিব্যি আদিত্য সব ভুলে বসে আছে স্বামীর তকমা নিয়ে। এই মেয়েটি জ্বর হলে আমার মাথায় পানি ঢালে, নির্ঘুম রাত কাটায়। আমরা না খেলে সে খায় না। বাবুর জন্যও সে রাত জাগে, আমি পরদিন অফিস করবো বলে বেঘোরে ঘুমাই। অথচ সে সারাদিনই কাজ করে। মা তাকে অসংখ্যবার বকা দিলেও সে পা টিপে দেয়। অসুস্থ হলেও সারারাত জাগে। অথচ আমরা কি নির্দ্ধিধায় তাকে কাজের মানুষ বলি। ভালোবাসতে কার্পণ্য করি। তাকে ভালোটা দিতে আটকায়।

আজকাল পাশে থাকার মানুষই যেখানে খুবই কম পাওয়া যায়। যাকে পাশের মনে করা হয়, সেও থাকে না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। এ টুকুর মধ্যে যে সময় দিতে চায় তাকে নিয়ে চলাই তো জীবন। আমি ঝরনাকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম। এবং আজ আমার তাকে অবশ্যই কপালে একটা চুমু দিতে হবে। ঝরনা চুমু পেয়ে আমাকে জড়িয়েআবার কান্না শুরু করে দিলো। আমি গলা ফাটিয়ে হাসতে লাগলাম।

ছবি- নেটের

0 Shares

১৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ