জীবনের বাস্তবতা

মনির হোসেন মমি ৯ এপ্রিল ২০১৯, মঙ্গলবার, ০৬:১৭:১৩অপরাহ্ন গল্প ২৯ মন্তব্য

ইস্সেরে...মশাটা কেমনে রক্ত খাইছে দেহদি!
ময়নার গোলাপী গালটা টকটকে লাল হয়ে গেল।থাপ্পরটি দিয়ে মফিজ যেন একটু ভুলই করে ফেলেছেন।ময়না সেই যে থাপ্পর খেয়ে দুহাতে  গাল চোখ চেপে ধরে একদম চুপ হয়ে গেলেন তার যেন আর হুস আসছে না।বেচারা মফিজ ময়নার চেহারার একবার এ দিক আরেক বার ঐ দিক অস্তিরতায় বার বার তাকাচ্ছেন।অবশেষে মফিজ গাল চেপে ধরা দুহাতটি সরাতে চেষ্টার ফাকে কথা বলেন।
-ইস্ বেশী লেগেছে?আমি কি আর ইচ্ছে করে মেরেছি-সালার বেটা মশা!তোমার রক্ত খেয়ে আর নড়তে পারছিলনা তাই মন সামলাতে পারলাম।থাপ্পর দিয়ে মারতে হল।
ময়না এবার এক ঝাটকায় উঠে দাড়িয়ে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলতে থাকলেন।পাশে দাড়ানো বেচারা মফিজ অনুশোচনায় অনুতপ্ত।
-ঢং দেখে আর বাচিনা!
ড্রেসিং টেবিলের গ্লাসে তাকিয়ে ময়না চিল্লাইয়া উঠলেন।
-এই এই এদিকে আসো…এই দিকে আসো।
মফিজ খুব অপরাধীর মত কাছে গেলেন।
-কৈ?কৈ তোমার মশা!দেখোত থাপ্পর দিয়ে আমার গালটার কি অবস্থা করেছ!
মফিজ ময়নার গালে মশার চিহ্ন খুজতেঁ লাগলেন।না কোথাও মশার কোন চিহ্ন খুঁজে পেলেন না।অবশেষে তার গালে দুহাত দিয়ে আদুরে স্পর্শ করে বলতে থাকলেন।
-আহারে মরার মশা!কেমন গালদুটো লাল করে দিয়ে চলে গেল।আবার আসুক!
বলতে না বলতেই আরেকটি মশা ময়না কান বরাবর লতিতে বসল।ময়না নড়তেই মফিজ বলে উঠল।
-একটুও নড়বে না—হা হা হা এবার পেয়েছি!এবার কৈ যাইবা!
ময়না হঠাৎ পাথরের মূর্তি হয়ে গেলেন।মফিজ পজিসন নিচ্ছেন দু হাতের তালুতে এবার মশাকে যে করে হোক আটকাবেন অথবা এট্যাম টু মার্ডার।খুব ধীরে ধীরে মফিজের হাতের তালু দুটো সংকুচিত করে তার কানের লতি বরাবর এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।ময়নার যেন আর তর সইছে না।না নড়ে খুব সতর্কতায় বলছেন।খুব চাপা শব্দে।
-মারছো না কেন?আমার রক্তেতো কামড় দিয়েছে।
-একদম চুপ কথা বলবে না…আরেকটু রক্ত খাইয়া নিক।
-মানে!
-এখন মারলে উড়ে যাবে।বেশী রক্ত খেলে মশা উড়তে পারবে না আর আমিও মিস করবো না।
-কি বলছো তুমি!
কিছুক্ষণের মধ্যে মফিজ দেখতে পেল মশার পেটটা রক্তের ভারে ঝুলে পড়েছে।তখনি দিলেন জোরে দুহাতের দুতালু চাপিয়ে।ঠাস্ ঠাস করে শব্দ হওয়ার সাথে সাথে ময়না পড়ে খাটে আর মফিজ হাতের তালুতে মৃত মশা খোজাঁয় ব্যাস্ত।কৈ তার হাতের তালুতেতো মশা নেই তাহলে এবারও কি মিস হল!ঐ দিকে তাকিয়ে দেখে ময়না খাটে কান চেপে পড়ে আছে।মফিজ এগিয়ে গিয়ে ময়নাকে ডাকছে।
-কি গো কি হয়েছে এবারতো আর চর মারিনি তোমারতো ব্যাথা পাবার কথা নয়!এই শোনছো?তুমি কি শুনতে পাচ্ছো না!
ময়না হঠাৎ উঠে রেগে গেলেন।
-এটাইতো হয়েছে! তোমার হিজড়ার মত তালির আওয়াজে এখন আমি যে কিছুই শুনতে পাচ্ছি না।
-সরি সরি সরি….।
-মশাটা মরেছে?
-আমি অপরাধী-মরেনি!

-ঠিক আছে ঠিক আছে এবার যাও তোমাকে আর মশা মারতে হবে না।জীবনটাতো জ্বালিয়েই মারলে।
-ওখানে একটু আপত্তি আছে!
-কোনটা?
-ঐযে জ্বালিয়ে মারছি!
-তুমি যাবে এখান থেকে?
-যাচ্ছিতো ধমকাও কেন!আমি অফিসে গেলাম তুমি সাবধানে থেকো কিন্তু…।

এমনি হাসিখুশির মাঝে কষ্টেরা চাপা পড়ে থাকে হৃদয়ের উঠোনে।দিনের আলোতে সদা হাস্যজ্জোল চেহারা রাতের গভীরতায় ছেয়ে যায় বিষাদের ছাঁয়ায়।কেউ কাউকে বুঝতে দেননা কতটা কষ্টে আছেন তারা।কষ্টগুলো ভালবাসায় নয় কষ্টগুলো যাপিত দিতের অর্থের চার দেয়ালে।ক্লাশ ফাইভে পড়ুয়া একমাত্র ছেলের লেখা পড়া যেন মুখ থুবরে পড়ে আছে অনিশ্চিত উন্নত ভবিষৎতের দরজায়।
দুজনেই মা বাবার অমতে ইয়ে করে বিয়ে করেন বলে তারা বিচ্ছিন্ন হন উভয়ের পরিবার হতে।পরিবারও এ যাবৎ তাদের কোন খোজঁ খবর রাখেননি।মফিজ একটি চাকুরী করতেন সামান্য বেতনে তাই দিয়েই কোন মতে নুন আনতে পানতা ফুরোয় অবস্থায় সংসার চালিয়ে যাচ্ছিলেন।আগত গর্ভের সন্তান ছেলে কি মেয়ে কিংবা কেমন আছে তা জানতেও ডাক্তারের চেকআপে যেতে পারেননি কেবলি অর্থের অভাবে।তবুও তারা উভয় খুশি-ভরসা করেন স্রষ্টার উপর নিশ্চয় উপরওয়ালা তাদের মঙ্গল করবেন।তাদের কারোর প্রতি কারোর কোন অভিযোগ নেই বরং উভয় উভয়ের প্রতি সহনশীল।

ইদানিং মফিজ মাঝে মাঝে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন।বিয়ের পর কত রাত যে দুজনে কখনো এক সাথে কেঁদেছেন কখনো বা নীরবে একা  চোখের জলে কত বালিশ ভিজিঁয়েছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।এক রাতে-মফিজ বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়।রুমের কলিংবেল টিপলে ময়নার হাসি মুখটি দরজার সামনে অথচ কিছুক্ষণ আগেও ময়না নীরবে অনেক কেদেছিল-স্বামী আসবে অফিস হতে অথচ ঘরে রাতের খাবারের কিছুই নেই।তখনো ছেলের জন্ম হয়নি।ছিলো আট মাসের ময়নার উদরে।
হাতের অফিস ব্যাগটি তার নিজের হাতে নিলেন।ময়না কিছু বলার আগেই মফিজ বলল।
-আমি খেয়ে এসেছি।তুমি খেয়ে নাও..।
মফিজ যতই নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করুক না কেন ময়না তা ঠিকই বুঝে ফেলবে,তেমনি ময়নার ক্ষেত্রেও তাই।
-আমিওতো খেয়ে ফেলেছি।
উভয় চুপচাপ কিছুক্ষণ দাড়িয়ে হঠাৎ ময়না মুখে হাসি নিয়ে বলল।
-তুমিতো মিথ্যে বলতে জানো না তবে কেন মিথ্যে বলছ!
মফিজের সরল উত্তর।
-তুমিওতো তাই!
দু’জনের চোখে জলের ছিটে।অতপর আলিঙ্গনে রুমে প্রবেশ করে খাটে বসল। অতপর মফিজ তার সেই ব্যাগ হতে একটি পাওরুটি আর একটি কলা বের করে, দু’জনে সমান ভাগ করে জল পান করলেন পুরো এক মগ করে।তৃপ্তির ঢেকুর গিললেন মফিজ।
-আরতো বেশী দেরী নেই,আমাদের ঘর আলো করার অতিথি আসছে।আল্লাহ জানেন কি হয়!কি করে যে কি করি!
-এ ভাবে ভেঙ্গে পড়লে চলবে! কৈ আমিতো ঠিক আছি একটুও ভাবি না যা হবার তা হবে আল্লাহ আমাদের সহায় নিশ্চয় হবেন।
হঠাৎ ইস্ শব্দ করে ময়না যখন তার পেটে হাত দিল তখন মফিজ ময়নাকে জরিয়ে ধরে শান্তনা দিল।
-তুমি ভয় পেয়ো না সব ঠিক হয়ে যাবে।

অবশেষে ময়নার যখন সন্তান ভুমিষ্ঠের ব্যাথা উঠল তখন পাগলের মত ছটফট করতে থাকল মফিজ।কি করবেন বুঝতে পারছেন না।হাতে তেমন কোন টাকা পয়সাইতো জমানো নেই যে যা দিয়ে তার আগত সন্তানের আলোর মুখ দেখবেন।তবুও হঠাৎ সাহস করে পাশের আরেক মহিলাকে নিয়ে সিএনজিতে চলে গলেন হাসপাতালে।

হাসপাতালে সিজারিং এর আগে ক্যাশ কাউন্টার থেকে জানিয়ে দেয়া হল দ্রুত যেন টাকার ব্যাবস্থা করেন।এখন এ মুহুর্তে এতোগুলো টাকা পাবেন কোথায়।চিন্তিত মন কেবলি বাসায় যাওয়ার কথাই মনে পড়ছে তার।দ্রুত বাসায় চলে আসল। চোখ পড়ল সাজানো প্রাপ্ত মেডেলগুলোর উপর।তার স্কুল কলেজ জীবনে এবং এক সময়কার তুখোর দাবাড়ু খেলোয়ার তিনি।পুরষ্কার পেয়েছিলেন স্বর্ণ রৌপ্য সহ বেশ কয়েকটি মেডেল।ঐগুলো দ্রুত হাতে নিয়ে বাজারে বিক্রি করে টাকা জমা দিলেন ক্যাশে।এরই মধ্যে অপারেসন ডাক্তার সাহেব নিউজ দিলেন তার ছেলে হয়েছে।

0 Shares

২৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ