চারিদিকে কতো রং!

রিমি রুম্মান ১৪ এপ্রিল ২০১৯, রবিবার, ১০:৫৩:১৮পূর্বাহ্ন সমসাময়িক ৭ মন্তব্য

শেকড় থেকে দূরে বসবাসকারী আমরা প্রবাসীরা বাংলা নববর্ষ পালনে তুমুল আগ্রহ নিয়ে বসন্তের মাঝামাঝি থেকেই অপেক্ষায় থাকি। চারিদিকে যখন ম্যাগনোলিয়া কিংবা চেরি ফুলের আগমনী সংবাদে বাতাস আর পাখিদের কানাকানি চলে, ঠিক সে সময়ে এই শহরের বাঙালিদের মাঝে প্রস্তুতি চলে বৈশাখ বরণের । মুসলমানদের ধর্মীয় বড় উৎসব দুই ঈদ যদিও, কিন্তু বর্ষবরণ সার্বজনীন উৎসব। আর তাই আয়োজনটাও চলে বড় পরিসরে, মাসব্যাপী। নিউইয়র্কে এ উপলক্ষে অর্থাৎ পয়লা বৈশাখকে সামনে রেখে পোশাকের দোকানগুলোয় বিশেষ বৈশাখী শাড়ি, সেলোয়ার, কামিজ, গহনার সমারোহ চোখে পড়ার মতো। কেনাকাটার ধুম পড়ে। অবশেষে বহু প্রতীক্ষিত পয়লা বৈশাখের দিন সকাল থেকেই নিউইয়র্কের বাঙালি অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটসে লাল-সাদা পোশাকের মানুষজনের উচ্ছ্বাস আনন্দে ঘুরে বেড়ানো চোখে পড়ে। যেদিকে চোখ যায়, শুধুই লাল-সাদা ! সময় যতই দুপুরের দিকে গড়ায় ততোই বাড়তে থাকে ভিড়ভাট্টা। বাঙালি মালিকানাধীন রেস্তোরাঁগুলোয় পান্তা-ইলিশ, নানান পদের ভর্তা, ভাত, শুটকির বিশেষ আয়োজন থাকে। থাকে উপচে পড়া ভিড়। হৈচৈ। একই পরিস্থিতি চলে ব্রুকলিন, ব্রনক্স কিংবা জ্যামাইকায়।

আগে বাড়িতেই পান্তা-ইলিশ-ভর্তার আয়োজন করা হতো। দুপুরে ভোজের পর তৈরি হয়ে আমরা স্বামী-স্ত্রী অনুষ্ঠান দেখতে যেতাম। এখন পরিবার বড় হয়েছে। সন্তানদের সাথে নিয়ে সপরিবারে আমরা বন্ধুরা রেস্তোরাঁয় যাই। দুপুরের খাবার খাই। সেখানে থাকে বিশাল লাইন, বাঙালির খাবার নেবার ভিড়। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে উন্মুক্ত আকাশের নিচে খোলা মঞ্চে যে নাচ, গান চলে, পথের ধারে দাঁড়িয়ে তা উপভোগ করি। রাস্তায় রকমারি পশরা সাজিয়ে যে বৈশাখী মেলা হয়, তা ঘুরে ঘুরে দেখি। শিশুদের নানান রকম খেলনা কিনে দেই। ব্যনার, ফেস্টুন, রং বেরং এর মুখোশ পরে যে র‍্যালি সড়ক প্রদক্ষিণ করে, রাস্তার কিনারে দাঁড়িয়ে সন্তানদের সাথে নিয়ে তা উপভোগ করি। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভিনদেশিদের ব্যাখ্যা করি আমাদের ঐতিহ্যবাহী বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন উদযাপনের কথা। এই যে বিদেশে জন্ম এবং বেড়ে উঠা সন্তানদের সাথে নিয়ে দিনভর এমন ঘুরে বেড়ানো, তা অনেকাংশে আমাদের বাংলাদেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রচেষ্টা বলা চলে।

আমেরিকায় বাংলাদেশি অধ্যুষিত অঙ্গরাজ্যগুলোতে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা নিজেদের মতো করে একতাবদ্ধ হয়ে বৈশাখী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। নিউইয়র্কে ড্রামা সার্কল এবং বিপা ( বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পারফর্মিং আর্টস ) দীর্ঘদিন যাবত বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে আয়োজন করে এসেছে। পান্তা-ইলিশ-ভর্তা, ভাত আপ্যায়নের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করে থাকেন ড্রামা সার্কল। নৃত্য, কবিতা আবৃত্তি, অভিনয় এবং মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। রাস্তায় নাচ, গান আর ঢোলের বাদ্য দিয়ে বিপা বাংলা বর্ষবরণকে স্বাগত জানায়। সেখানে আগত নারী, পুরুষ, শিশু সকলেই বাহারি পোশাকে অনুষ্ঠানস্থলে আসেন। এতে উৎসবে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়। অতপর চলে নাচ, গান, আবৃত্তি। ভাবতে ভালো লাগে যে, এইসব অনুষ্ঠান পরিবেশনায় থাকে আমাদের প্রবাসে বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্মের শিশু কিশোরেরা।' আনন্দধ্বনি ' বাংলাদেশের রমনা বটমূলের আদলে অনুষ্ঠান শুরু করে থাকে ভোরের দিকে। বিধায় সকালের নাস্তা আপ্যায়ন করে থাকেন আয়োজকরা। বাংলাদেশের লোকগীতি, রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজ্রুল গীতি, বৈশাখের গান পরিবেশনা এবং কবিতা আবৃতির মাধ্যমে চমৎকার এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন তারা। ' বাংলাদেশি আমেরিকান কালচারাল এসোসিয়েশন ' নামের সংগঠন বৈশাখী শোভাযাত্রা অর্থাৎ র‍্যালি দিয়ে শুরু করে তাদের মুল অনুষ্ঠান। এর আগে পান্তা-ইলিশ ভোজন পর্বের আয়োজন থাকে। আছে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর আয়োজনে বিভিন্ন পার্টি হলে তাদের নিজস্ব বর্ষবরণের আয়োজন। এইসব অনুষ্ঠান চলে মধ্যরাত অব্দি।

পয়লা বৈশাখের আনন্দ অনুষ্ঠান এখন আর শুধু নির্দিষ্ট দিনেই সীমাবদ্ধ নয়। চলে সারা মাসব্যাপী। এই যে নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণে এতো এতো আয়োজন, এ থেকে ভিনদেশে বেড়ে উঠা আমাদের সন্তানদের মাঝে দেশিয় সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ছে নিশ্চিত ভাবে। অথচ দুইযুগ আগে আমি যেদিন এই প্রবাসের মাটিতে পা রাখি সেদিনও ছিল বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাসের প্রথম দিন। জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্ট থেকে জ্যাকসন হাইটসে আত্মীয়ের বাসায় আসা পর্যন্ত পুরোটা পথ কোন আয়োজন চোখে পড়েনি। শাঁ শাঁ শব্দে ছুটে চলছিল গাড়িগুলো। ব্যস্ততায় রুদ্ধশ্বাসে ছুটে চলছিল ভিনদেশি মানুষজন। বাঙালি পোশাক পরিহিত কোন মানুষজন চোখে পড়েনি। শুধু সেদিনের কথা বলছি কেন, পরবর্তী বেশ কয়টি বছর বৈশাখ আসে, বৈশাখ যায় বড় বেশি অগোচরে, নিরবে। আমি কাজ শেষে ঘরে ফিরে একাকি বৈশাখী খাবার রান্না করে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম। পাখির ডাক, ফুলের সৌরভ আর হিমেল বাতাস ছিল আমার সেইসব নিঃসঙ্গ বৈশাখ দিনের সাক্ষি। তখন ও পথ ধরে হেঁটে যাওয়া ভিনদেশি মানুষ দেখতাম। কদাচিৎ কাউকে বাঙালি মনে হলে অজান্তেই ভেতরটা চঞ্চল হয়ে উঠত। মনে হতো ঐ তো হেঁটে যাচ্ছে আমার দেশি মানুষ, আপনজন। কখনবা আমার ফরটি ওয়ান এভিনিউয়ের সেই বাড়িটির জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আমি ফিরে যেতাম স্মৃতির জানালায়। সেখানেও আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম অন্য এক জানালায়। ইডেন কলেজের নতুন হলের ষোল নাম্বার রুমের জানালায়। যেখানে দাঁড়িয়ে আমি একে একে সিনিয়র আপুদের প্রেমিকের হাত ধরে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানস্থলের দিকে চলে যাওয়া দেখতাম। পয়লা বৈশাখের দিন সকাল থেকেই উনাদের বড় বেশি ব্যস্ততা ছিল। বাথরুমে বিশাল সিরিয়াল ! গোসল সেরেই একে একে সকলে তৈরি হয়ে নিতো। লাল-সাদা শাড়ি, চুড়ি, খোঁপায় ফুল, সবমিলে সিনিয়র আপুদের এক একজনকে কী অদ্ভুত সুন্দরই না দেখাতো বৈশাখী সাজে। তবে আমার আনন্দময় পয়লা বৈশাখ কেটেছিল সেই শৈশব কৈশোরে। বাবা-মায়ের সাথে কাটানো দিনগুলোতে। বাবার সাথে নতুন বাজারে বৈশাখী মেলায় যেতাম। মাটির খেলনা কিনতাম। কটকটি, মুরালি সহ এটা সেটা খেতাম। বাড়ি ফিরে দেখতাম মা নতুন শাড়ি পরে আমাদের ফিরবার অপেক্ষা করছেন। খাবারের টেবিলে সেদিন বিশেষ আয়োজন থাকতো। কাঁচা কাঁঠাল, সিমের বিচি সহ নানান রকম সব্জি দিয়ে বেশ মজার এক তরকারি রান্না হতো।

বহু দুরের মফঃস্বল শহরে ছিল আমার ব্যবসায়ী বাবার চৈত্র সংক্রান্তির দিন, হালখাতার হিসেব নিকেশ, মিষ্টিমুখ। এখন এই বিদেশ বিভূঁইয়ে আমার ছোটবেলার বৈশাখের সাথে আমার সন্তানদের বৈশাখের মিল আর অমিল নিয়ে ভাবি। কতো কী হারিয়ে গেছে ! যোগ হয়েছে নতুন কিছু। তবে, মাঝে বিদেশ বিভূঁইয়ের বেশ অনেকগুলো বছর নববর্ষ উদযাপন হয়নি। চারপাশ ধূসর পানসে আর খাঁ খাঁ শূন্যতায় ভরা ছিল। অথচ এখন চারিদিকে কতো রং !

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 Shares

৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ