আজ থেকে মাস ছয়েক আগের ঘটনা। আমি সেদিন অফিসে ঢুকেই ফেসবুক ওপেন করে দেখলাম, সে আমাকে রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে। সাথে সাথেই আমি চিৎকার করে উঠলাম, “ইয়াহু, আমি জিতে গেছি”।
সেটা শুনে আমার অফিসের এক কলিগ বললো, “ভাই, অফিসটারে স্টেডিয়াম বানাইয়েন না”।

সন্দেহ নেই, আমি তখন অত্যন্ত উচ্ছসিত ছিলাম। সে একজন সেলেব্রেটি। তার কাছে ফেসবুকে রিকুয়েস্ট পাঠানোর উপায় ছিলনা, তার কাছে জমা হওয়া পেন্ডিং রিকুয়েস্ট বেশী থাকার কারণে। তাই, আমি মাঝে মাঝেই তাকে ফেসবুকে ইনবক্স করেছিলাম। বলেছিলাম, “আপনাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠানো যাচ্ছেনা। আপনি কি একটা রিকুয়েস্ট পাঠাবেন?” কিন্তু, সেটার রেসপন্স পাছিলাম না। এভাবে লাস্ট তাকে ফেসবুকে ইনবক্স করার পর কমপক্ষে তার ৪-৫ মাস কেটে গিয়েছিল। অবশেষে ২০১৪ সালের শেষের দিকে ঘটলো এই ব্যাপার। সে আমাকে ফেসবুকে রিকুয়েস্ট পাঠালো। সন্দেহ নেই, আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম সেদিন।

এরপর, তার সাথে মাঝে মধ্যেই ফেসবুকে চ্যাট হতো। সবসময় সে যে আমার মেসেজের রিপ্লাই দিত, তা নয়; তবে মাঝে মাঝেই রিপ্লাই দিত। সেলিব্রেটি বলে কথা !

আমি একবার ফেসবুকে জানালাম, “আমাদের অফিসের অনেকেই কিন্তু আপনার অনেক ভক্ত”।
“শুনে খুশি হলাম”, সে রিপ্লাই দিয়েছিল।

তার সাথে আমার সামসামনি দেখা হয়েছে অনেক। তার সাথে শাহবাগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, প্রেসক্লাবের সামনে অনেকবার দেখা হয়েছে – কিন্তু সেটা কিছুটা দূর থেকেই। একবার প্রেসক্লাবে এক সমাবেশে তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল – এই বছরের জানুয়ারীতে। নাগরিক অইক্য, জাসদ (রব), গণফোরাম, সিপিবি, বাসদের যৌথ সমাবেশ ছিল ওটা। প্রেসক্লাবের সামনেই ও আমার থেকে ২০-২৫ গজ সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন, দূর থেকেই তার সাথে হাই-হ্যালোও বিনিময় করেছি। কিন্তু, মজার ব্যাপার হল আমরা সেখানে দুজনই আড়চোখে একে অপরকে দেখছিলাম, আর মিটিমিটি হাসতেছিলাম। বিশেষ করে, ও আমাকে অইখানে দেখে অবাক হয়েছিল, তার পাশাপাশি মনে হয়, মজাও পেয়েছিল।

এরপর আরও-দুই তিন মাস কেটে গেল। এই বছর মারচের মাঝামাঝি তার সাথে একবার চ্যাট হয়েছিল ফেসবুকে। আমি বলেছিলাম, “আপনার কনটাক্ট নম্বর কি দেয়া যাবে”?
ও সুন্দর তার কনট্যাক্ট নাম্বার দিয়ে দিল।

পরে, একদিন আমি তাকে ফোন দিয়েছিলাম। কিন্তু, সেখানে আমার পরিচয় দেয়ার পরও তার কাছ থেকে তেমন কোন হৃদ্যতার ছোয়া পেলাম না। সামান্য একটু কথা বলার পর ‘পরে কথা বলবো’, বলে সে ফোন রেখে দিল।

এরপর গত ২৪শে এপ্রিল, পহেলা বইশাখে নারী নিরযাতনের বিরুদ্ধে ‘পালটা আঘাত’ শিরোনামে একটা প্রোগ্রাম আয়োজন করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্করযের ওখানে। ফেসবুকে এই প্রোগ্রামের ইনভাইটেশন পেয়েছিলাম। আমি জানতাম না এই প্রোগ্রামের মূল আয়োজক ছিল ছাত্র ইউনিয়ন। তারপরও, আমার মনে হয়েছিল, ছাত্র ইউনিয়নের একটা ভূমিকা এই প্রোগ্রামে থাকবে। আমি শাহবাগে বাস থেকে নেমে ‘নিঝুম ভাস্করয’ থেকে রাস্তা ক্রস করে রাজু ভাস্করযের দিকে এগোলাম। দেখলাম, ৪ তার সময় প্রোগ্রাম আয়োজনের কথা থাকলেও ৪-টার সময় শুধু ব্যানার টাঙ্গানো ছাড়া আর কিছুই সম্পন্ন হয় নাই।এটাও দেখলাম যে, প্রোগ্রামটির মূল আয়োজক ছাত্র ইউনিয়ন।

আমি রাজু ভাস্করযের বাম দিকে ঘুরে হেটে কয়েক কদম সামনে এগোলাম। মনে হল, আমার ‘অনাগত বন্ধুটি’ আশে-পাশেই থাকতে পারে। ঘাড়-ঘুরিয়ে পেছন ফিরে দেখলাম। দেখলাম, ও ঠিক পেছনেই, টিএসসির সড়ক দ্বীপে রেলিংয়ের উপর বসে আছে। তার সাথেই বসে আছে ‘পয়লা বইশাখের হিরো’ লিটন নন্দী। মনে হল, ওরা দুজনই কি একটা বিষয় নিয়ে একটু হাসতেছে; মনে হল সেটার প্রতিপাদ্য বিষয় আমি।

যাই হোক, আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে টিএসসির ফুটপাতে গিয়ে বসে থাকলাম, ওদের কাছ থেকে একটু দূরে।
তখন, আমার খুব মেজাজ খারাপ হচ্ছিল। মেজাজ খারাপ হচ্ছিল এই ভেবে যে, আমি ওদের ২০-২৫ গজ সামনে দিয়েই তো হেটে গেলাম। ও এট লিস্ট, আমাকে একটা ডাক দিতে পারতো। ‘শেহজাদ ভাই’ ‘শেহজাদ’, অথবা ‘ভাইয়া’ – যে কোন নামেই আমাকে ডাক দিয়ে তাদের কাছে আসতে বলতে পারতো। সে আর লিটন নন্দী – দুজনই আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে আছে। কিন্তু, ফেসবুকে ফ্রেন্ড থাকাতো আসলে সবকিছু নয়, বলতে গেলে কিছুই নয়। এই সুযোগে তাদের সাথে প্রথমবারের মত সামনাসামনি কথাও হতে পারতো তাদের সাথে।

দুইটি বিন্দু মিলে একটা সরলরেখা তইরি করে। একটি বিন্দুর চেয়ে একটি সরলরেখা অনেক শক্তিশালী। আর তিনটি বিন্দু মিলে তইরি হয় একটা ত্রিভুজ। সরলরেখার চেয়ে একটা ত্রিভুজ তো আরও বেশী শক্তিশালী। সরললেখা থেকে ত্রিভুজ, ত্রিজুজ থেকে চতুরভুজ – এভাবে ব্যক্তি থেকে সমষ্টি গড়ে তোলার ইচ্ছা সমাজতান্ত্রিক আদরশের যে কোন করমীর থাকা উচিত। সেটা তাদের মধ্যে কতটা আছে, তা আমি বলতে পারবোনা।

সেলিব্রিটিদের চোখে পড়া আমার মত “প্রলেতারিয়েতদের মধ্যেকার প্রলেতারিয়েত”-এর জন্য হয়তো একটু কষ্টকরই বটে!

যাই হোক, এর ২০-২৫ মিনিট পরে আমি টিএসসির সড়ক দ্বীপে উঠে আমি আর আমার বন্ধু আরিফ আড্ডা মারছিলাম। খেয়াল করলাম, আমাদের থেকে হাত বিশেক সামনে সে বসে আছে আমাদের দিকে পেছন ফিরে। ইচ্ছা করলো, ওর কাছে গিয়ে ‘হাই’ বলে আসি। কিন্তু সেটা করতে মন চাইলোনা – মনে হল, সেটা হ্যাংলামো হয়ে যাবে। শুধু পেছন থেকে দেখলাম, তার দুই কানের মাঝখান দিয়ে নেমে আসা লম্বা চুলের গোছাটিকে। ‘শাহবাগের কৃষ্ণকলির’ কানদুটো তার সাথে বড়ই বেমানান, বেশ খাড়া, অনেকটা ইদুরের মত। কিন্তু তার উরু পরযন্ত লম্বা দীঘল কালো চুলগুলো সম্ভবতঃ তার সবচেয়ে সুন্দর জিনিস – অন্তত, আমার কাছে তাই মনে হয়।

এরপর, গত ১০ তারিখে, থানা ঘেরাওয়ের করমসূচিতে পুলিশ যেদিন ছাত্র ইউনিয়নের করমীদের, বিশেষ করে ইসমাত জাহানসহ কিছু মহিলা করমীকে পেটালো, সেদিন সন্ধায় আমি টিএসসিতে একটা কাজে উপস্থিত ছিলাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা করে টিএসসির মামার বানানো ‘স্পেশাল বুস্ট চা’ খাচ্ছিলাম। হথাত দেখি, আমার পাশ দিয়েই ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকজন করমীর সাথে সে হেটে গেল। হেটে গিয়ে টিএসসির ফুটপাথের উপর তারা বসে পড়লো। বুঝলাম, গত কয়েকদিনের আন্দোলন আর দউরাদউড়ির কারনে ওর বেশ পরিশ্রম গেছে। যার কারণে, ও আরও স্লীম হয়েছে। মোবাইল প্যান্ট আর অনেক পুরনো ক্রীম কালারের ফতুয়া পরিহিত ও যখন আমার পাশ দিয়ে হেটে গেল, ওকে আগের চেয়েও আকরষণীয় মনে হচ্ছিল। সন্ধার আবছায়ায় ঘেমে নেয়ে একাকার ওর কালো মুখকে মনে হচ্ছিল কষ্টিপাথরে গড়া কোন নারী-মূরতির প্রতিচ্ছবি।

আমিতো চাই-ই, আমার এই ‘অনাগত বন্ধু’টি আরও দেখতে সুন্দর আর আকরষনীয় হয়ে উঠুক। তার থেকেও সুন্দর হয়ে উঠুক তার মনটি।

এরপর, লাস্ট ওর সাথে ফেসবুকে চ্যাট হয়েছে গত ১৮ই মে। ওকে বললাম, “আপনাদের তো মনে হয় গত কিছুদিন অনেক দউরাদউরি গেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর আন্দোলনের কারণে। যাই হোক, আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, এট লিস্ট আপনার ফেসবুক ফ্রেন্ড হতে পেরেছি’।
ও রিপ্লাই দিলো, “Thank You’.
আমি আবার লিখলাম, “আপনার সাথে আমার সামসামনি অনেকবার দেখা হয়েছে। কিন্তু, এখনো আমাদের সামনাসামনি কথা হয়নি। যদি, আপনার সাথে টিএসসি বা শাহবাগে দাঁড়িয়ে এককাপ চা খেতে পারতাম তাহলে অনেক ভাল লাগতো”।
এটার অবশ্য কোন রিপ্লাই সে দেয়নি।

তো সবাই হয়তো বুঝতে পারছেন অবস্থাটা…। আমার কাছে মনে হচ্ছে, “এত কাছে, তবু এত দূর”। আমার ‘চাইছি তোমার বন্ধুতা’ ও ‘চাইছি তোমার বন্ধুতা -২’ পড়ে অনেকেই এই ব্যাপারে পুরো ধারণা পেয়ে যাবেন।
আমার অনেকদিনেরই ইচ্ছা, আমি ওকে ভাল একটা বন্ধু হিসেবে পেতে চাই। তার থেকে আমি বয়সে কয়েক বছরের বড়। রাজনইতিক আদরশের দিক দিয়েও তার সাথে আমার কিছু পারথক্য রয়েছে। তারপরও, যদি তাকে আমার বন্ধু হিসেবে পাই, তাহলে তার সাহচারয, তার অনুপ্রেরণা, বা তার সহযোগিতায়-সহমরমিতায় আমি নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারবো বলেই আশা রাখি।

কিন্তু, জানিনা ও আমাকে কেমন চোখে দেখে? সে তো আমাকে এভয়েড করেনি। আমাকে নিজে থেকেই ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে, একবার চাইতেই সে তার সেল নাম্বারও আমাকে দিয়ে দিল। কিন্তু, ২৪শে এপ্রিল যখন তার সামনে দিয়ে হেটে গেলাম, তখন সে আমাকে ডাক দিয়ে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করেনি। আবার, যখন তাকে এককাপ চা খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানালাম, তখন নিরলিপ্ত থাকলো। এইসব কারণে, আমি ব্যাপারটা নিয়ে কনফিউজড। কিছু মেয়ে আছে, শুধু ফেসবুকেই আন্তরিক, বাস্তবে নয়। মনে প্রশ্ন জাগে, সেও কি এইরকম কিছু?

তবে, আমি আশা রাখি, আমি যদি তার প্রতি আন্তরিক থেকে একটা বন্ধুত্বপূরন সম্পরক তইরি করতে চাই, সে আশা করি আমাকে নেগলেক্ট করবেনা। কিন্তু, তার আগ পরযন্ত আমাকে বলতেই হচ্ছে, “এত কাছে, তবু এত দূর”।

0 Shares

৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ