সমান্তরাল

শেহজাদ আমান ২০ অক্টোবর ২০১৬, বৃহস্পতিবার, ০২:২২:২৮অপরাহ্ন গল্প ১৩ মন্তব্য

(১)
এরকম মেয়ে সচরাচর চোখে পড়ে না। দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি স্মার্ট। উচ্চতা গড়পড়তা মেয়েদের থেকে বেশ খানিকটা বেশি – কমসে কম ৫ ফিট ৬ ইঞ্চি তো হবেই। উচ্চতা বেশি হলে অনেক মেয়েকেই একহারা লাগে, বেঢপ লাগে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যেন নিজ হাতে মেয়েটিকে তৈরী করেছেন যথেষ্ট সময় নিয়েই। শরীরের যে অংশ যতটুকু হলে একটা মেয়েকে দারুণ আকর্ষণীয় লাগে, তার সবটুকুই মেয়েটির ভিতরে আছে। শুধু তাই নয় মেয়েটির হাসিতে যেন মুক্তো ঝরে। তার দুষ্টুমিস্টি হাসি যে কোন ছেলেকে মাতাল করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। আর এই অনন্য সুন্দরী মীমের সাথেই যে এত তাড়াতাড়ি এরকম অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব হবে, তা ভাবতে পারেনি অনীক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র অনিক মীমকে প্রথম দেখেছিলো কলা ভবনের সামনে – সেখানে ওর কিছু পরিচিত মুখের মধ্যে মেয়েটিকে সে আবিস্কার করে। প্রথম পরিচয়েই মীমের সৌন্দর্য আর স্মার্টনেস নজর কেড়েছিলো অনীকের; তবে তার থেকেও বেশি ভালো লেগেছিলো তার বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ। পদার্থবিজ্ঞান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী মীমের সাথে যখন তার বন্ধুবর রবিন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো, তখন মীম নিঃসঙ্কোচে ‘হাই’ বলে হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিলো। দ্বিধাসঙ্কোচহীম মীম যেন সেদিনের সেই আড্ডার মধ্যমণি হয়েই ছিলো। সেই আড্ডায় আরও পাঁচ ছেলের মধ্যে মীমই ছিলো একমাত্র মেয়ে। অনীকের মনে হল কিছু ছেলে এর মধ্যে যেন মীমের সাথে কথা বলার জন্যই আড্ডায় যোগ দিয়েছিলো।

পরে রবিনের কাছ থেকেই মীম সম্পর্কে বিতারিত জেনেছিলো অনীক।
“বুঝলি দোস্ত, মীমের মত মাইয়া হয় না,” বলেছিলো রবিন। “দেখতে কেমন, সেটা তো তোরা সবাই জানস। ও ছাত্রী হিসাবেও একদম এক নাম্বার। ফাস্ট ইয়ারে ও তো ফাস্ট হইছেই, তাও আবার রেকর্ড নম্বর নিয়া।’
‘ভাল তো,’ বলেছিলো অনীক। ‘তা, ছেলেপেলের তো ওর পিছনে লাইন লাগার কথা। তা দোস্ত ও সিঙ্গেল না ডাবল।
‘আরে, ওর মত মাইয়া কি আর ফ্রি থাকে! ও প্রেম করতেছে দুই বছর আগে থেকেই। ওর বয়ফ্রেন্ড থাকে ইউএসএতে। তবে, পোলাপান কি আর জানে সেইটা? ঢাবিতে ভর্তি হওয়ার পর ও তো মনে হয় কমসে কম ১০-১৫ টা অফার পাইছে। ছেলেপেলে তো এফবি আর মোবাইলে ওরে চরম বিরক্ত করে।“
“হুম! তা আর কি গুণপণা আছে তোদের ফ্রেন্ড মীমের। শুনি…।”
“কইলাম তো, ওর লাগান মাইয়া হয় না। রুপ গুণে এত মাশাআল্লাহ একটা মাইয়া, কিন্তু কোন অহংকার নাই। তবে, ও যে সবার সাথে এত ফ্রি, অনেকেই আবার এইটারে ভাল চোহে দেখে না। আর যারা ওর কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হইচ্ছে, তারা তো ওর পিছে লাইগা আছেই।’
“হুম। বুঝতে পারছি। অনেকেই হয়তো মনে করে ও সবকিছু দিয়া দিবো। কিন্তু, তারা যখন ওর কাছ থেকে পাত্তা পায় না, তখন নিশ্চয় বাজে কথা বলে।”

রবিনের সাথে আলাপচারিতার কয়েকদিন পরই মীমের সাথে আবার দেখা অনীকের। অনীক কেবল লানচ শেষ করেছিলো, তখন মীমকে হাকিম চত্বরে দেখতে পেলো সে। নেভি ব্লু জিন্স আর জাম রঙের ফতুয়া পরিহিত মীমকে যথারীতি চমতকার লাগছিলো। ‘মীম’ বলে ডাক দিতেই সে ফিরে তাকালো। সাথে সাথে হাসি, পরিচিত মুখ দেখতে পেয়ে। মুখে হাসি নিয়েই সে অনীকের কাছে এল। বললো, ‘কি অবস্থা দোস্ত?’
‘ভালো, ছোট্ট করে জবাব দিলো অনীক। ‘কেবল ক্লাস শেষ হলো। ‘বিকেলে আবার ক্লাস আছে। এই ফাঁকে লানচটা সেরে নিলাম। তুমি লানচ করছো?’
‘হুম, আমার টাও কমপ্লিট,’ বললো মীম। বাসা থেকেই করে এসেছি।“
“তাহলে বন্ধু এক কাপ চা তো চলে অবশ্যই?’
মীম চাতে অমত করলো না। তারপর অরা দুজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে আলাপ চালিয়ে যেতে থাকলো। অনীক প্রমাণ পেল মীমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রবিন তার সম্পর্কে যা বলেছে, তা একেবারেই বাড়িয়ে বলেনি। দেশ, সমাজ, রাজনীতি থেকে শুরু করে বন্ধুত্ব, নারী-পুরুষের সম্পর্ক, শিল্প-সাহিত্য- সবকিছু সম্পর্কেই মীমের প্রখর ধারণা। অনীক অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো মীমের চিন্তাচেতনার সাথে তার নিজের চিন্তা-চেতনায় অনেক বেশি মিল রয়েছে।তার মনে হল, তাদের দুজনের চিন্তা যেন সমান্তরালে বয়ে চলেছে। তবে, এর চেয়েও বড় বিস্ময় তার জন্য অপেক্ষা করছিলো যখন সে মীমের কাছ থেকে বিদায় নিলো ঠিক তার পরপরই। মীমের ডাক শুনে সে পিছন ফিরে তাকালো। মীম আবার তার কাছে আসলো। বললো, দোস্ত, তুই কি কোন সমস্যার ভিতর দিয়ে যাচ্ছিস?”
মীমের প্রশ শুনে সে কিচুক্ষণ হাঁ করে মীমের মুখের দুকে তাকিয়ে রইলো। সে বর্তমানে সত্যিই একটা সমস্যায় রয়েছে – অর্থনৈতিক সমস্যা – যেটার মধ্যে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেককেই যেতে হয়। এই সমস্যা অনেকদিন ধরেই তার পিছনে লেগে রয়েছে। অনিক এই বিষয়টা খুব একটা প্রকাশ করতে চায় না তার ভার্সিটির সার্কেলের কাছে। যার কারণে ভার্সিটির খুব ক্লোজ কয়েকজন ছাড়া ওর এই ব্যাপারটা সম্পর্কে খুব কম বন্ধুবান্ধবই জানে। এই সমস্যা শুরু হয়েছে বছর চারেক আগে তার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই। তার মা একট লোকাল এনজিও’র তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। অনীকও দুটো টিউশনী করে। এরপরও ঢাকা শহরে মা আর বেটার থাকা-খাওয়া-পড়ার যে খরচ, অনেক সময়ই সেটা বহন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। আগামীকালের মধ্যে দ্বিতীয় বর্ষের ভর্তির ফি জমা দিতে হবে। সেই টাকা এখনও অনীক বা অনীকের পরিবার ম্যানেজ করতে পারেনি। কিছুক্ষণ আগে এক বন্ধুর থেকে সে হাজার চারেক টাকা ধার চেয়েছে; কিন্তু বন্ধু তাকে নিরাশ করেছে। রবিনের কাছে এখন |টাকা ধার চাইতে হয় কিনা, সেটাই সে ভাবছিলো। তখনি মীমের সাথে দেখা।
কিন্তু মীম এই ব্যাপারটা কেমন করে বুঝলো যে সে সমস্যায় আছে। ব্যাপারটা তো সে রবিনকেও এখনো জানায়নি।
অনিকের মুখে কোন প্রতিউত্তর না পেয়ে মীম যেন একটা নির্ভারের হাসি দিলো। বললো, “দেখ, তুই আমাকে বিষয়টা খুলে বলতে পারিস।’
অনীকের বিস্ময়ভাব এখনো কাটেনি। সে বললো, ‘তুই বুঝলি কি করে?’
‘আমি তো তোর বন্ধু না? খুব মিষ্টি করে হেসে বললো মীম। ‘তুই আমাকে ব্যাপারটা খুলে বল। দেখি আমি এটা সলভ করতে পারি নাকি?’
অনীক ভাবলো, তার মুখে হয়তো কিছুটা মলিনতার ছাপ আছে, যেটা দেখে মীম হয়তো বুঝতে পেরেছে যে সে সমস্যায় আছে। কিন্তু, মীমকে কি এই ব্যাপারটা খুলে বলা উচিত হবে? একে তো দুইদিনের পরিচয়। তার উপর মীম একটা মেয়ে। ছেলেরাই যেখানে অনেক সময় বন্ধুকে আর্থিক সাহায্য করতে চায় না, সেখানে একটা মেয়ে কি এই ব্যাপারটা সলভ করতে পারবে? হোক না সে, অনেক উদার মনের একটা মেয়ে। আজ পর্যন্ত ফ্রেন্ড সার্কেলে কাউকে কোন মেয়ের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেতে শোনেনি। এই ব্যাপারে মেয়েরা একেবারে অনুদার।
মৃদু হাসলো অনীক। বললো, আমি বলতে পারবো না রে। তবে দেখি, অন্য কোনভাবে হয়তো এটার একটা সলভ হবে।“
“আরে তুই দেখি নতুন জামাইয়ের মত করছিস! কি সমস্যা তোর, বলতো আমাকে? পারিবারিক সমস্যা, আর্থিক সমস্যা- কি ব্যাপার?”
অনীক বুঝলো এই মেয়ে আসলেই অনেক অন্য ধরণের একটা মেয়ে। সে সিদ্ধান্ত নিলো, জাস্ট টেস্ট করে দেখবে, একটা মেয়ে হয়ে মীম তাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে নাকি?
সে মীমকে ব্যাপারটা খুলে বললো। মীম বললো, ‘কোন সমস্যা নেই। তুই আমাকে তোর বিকাশ একাউন্টের নাম্বারটা বল। আমি এখনই টাকাটা পাঠায়ে দিচ্ছি আমার বিকাশ একাউন্ট থেকে।’
অনীকের মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে। বিস্ময়ের ঘোরে সে বিকাশ নাম্বারটা মীমকে বললো। তারপর সে মীমের স্মার্টফোনে দ্রুত কয়েকবার তার আ্নগুল খেলে যেতে দেখলো। তারপর সে অনীকের দিকে তাকিয়ে একগাল হাসি নিয়ে বললো, “দোস্ত, হয়ে গেছে। চেক করে দেখতো, ৪০০০ টাকা তোর একাউন্টে পৌঁছেছে কিনা।
অনীক তার বোতামওয়ালা আনস্মার্ট ফোনটা চেক করে দেখলো। সত্যি সত্যিই একটা নাম্বার থেকে ৪০০০ টাকা এসেছে তার বিকাশ একাউন্টে। সে কি বলবে ভেবে পেলো না। বললো, ‘আই কান্ট বিলিভ! আমার বিশাস হচ্ছে না!’
‘কি বিশ্বাস হচ্ছে না?’ প্রশ্ন করলো মীম।
‘আমার মনে হচ্ছে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নির্ঘাত কোন মহামানবী অথবা মাদার তেরেসা। আমি এই সময়ের এই দেশের কোন মেয়ের সাথে তোর মিল খুজে পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে তুই এই দেশের, এই জগতেরই কেউ না!”
অনীকের কথা শুনে যেন খিলখিল করে হেসে উঠলো মীম। তারপর বললো, ‘দোস্ত যাইরে! আমার ক্লাস আছে। কাল আমার কোন ক্লাস নেই।তারপরও কাল ক্যাম্পাসে আসবো আড্ডা দিতে। রবিনদের বলিস টিএসসিতে চলে আসতে।’
‘ওকে দোস্ত,’ ছোট্ট করে বললো অনীক। ভাল থাকিস দোস্ত। আর থ্যাঙ্ক ইউ ফর দ্যা হেল্প। আমি এজ আরলি এজ পসিবল তোর টাকাটা ব্যাক করার চেষ্টা করবো।’
‘নো মেনশন মাই ফ্রেন্ড,’ বলে ধীরে ধীরে বিদায় নিলো মীম। বিস্ময়ের ঘোর মনে নিয়েই মীমের যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে রইলো অনিক, আর ভাবতে থাকল|ও এই জগতে, এই বাংলাদেশে এমন মেয়েও হয়!

(২)
এরপর থেকে অনিক আর মীমের ঘনিষ্টতা বেড়ে গেল। অনিক যেন প্রথমবারের মত একটি মেয়েকে পেল যে নিজেকে একজন মেয়ে নয়, মানুষ হিসেবেই ভাবে – যেমন অনীক সব মেয়েদেরকেই মানুষ হিসেবেই দেখে, মেয়েমানুষ হিসেবে নয়। এদিকে, মীমও তাকে একদিন বললো, অনীকের মত আর একটা ছেলেও পায়নি, যার সাথে তার চিন্তাধারায় এতটা মিল। তাদের দুজনের বন্ধুত্ত্বকে মাঝে মাঝে অনীকের মনে হতো, সমান্তরালভাবে চলা দুটো একইরকম সরলরেখা।

মীম কিন্তু ভার্সিটিতে যে ব্যাপক পরিচিত মুখ, সেটা অনিক বুঝতে পারলো। প্রায়ই সে ভার্সিটির বড় ভাইদেরও আলাপ-আলোচনা করতে শোনে যে, সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে একটা ‘সেইরকম পিছ’ আছে। আর সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে গেলেও সে তার বন্ধু-বান্ধবকেও বলতে শোনে, “আরে, পিছ তো একটাই আছে – মীম। সেইটারে নিয়াই সবাই-টানা আর টানি, টানি আর টানা। এদিকে, অনীকের সাথেই এখন মীমকে বেশি ঘোরাফেরা করতে দেখে সবাই। অনীকের সাথে মীমের ঘনিষ্ঠতাটা বন্ধুমহলে সবার নজরেই পড়লো। রবিনের মাধ্যমেই মীমের সাথে পরিচয় হয়েছিল অনীকের; কিন্তু রবিনের চেয়েও সে অনীককেই অনেক বেশি সময় দিত। একদিন মীম অনীকের সাথে ওর বাসায় বেড়াতে গেল। পরে কেন জানি বন্ধুমহলে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেল। রিগান নামে এক বিটকেলে বন্ধু একদিন অনীককে বলে বসলো, “কিরে দোস, মীম নাকি তোর বাসায় গেছিল?’ অনীক হ্যা’বাচক উত্তর দেয়ার পর রিগান বলে বসলো, ‘তা, তোদের মধ্যে তো সবকিছুই হইছে, নাকি?’ এই কথা শুনের অনীক এমন ক্রুব্ধ চোখে রিগানের দিকে তাকালো যে তখন কোনমতে সেখান থেকে কেটে পড়লো।

অনীকের এই বিষয়লো খুবই খারাপ লাগতো। মীমের সাথে পরিচিত হওয়ার পর সে কখনো মীমকে নিয়ে খারাপ কিছু ভাবেনি বা কখনো তাকে নিয়ে অনীকের মনে কোনদিন কামনা জাগেনি। কারণ, মীম যেমন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী একের সাথে এনগেজড, তেমনি অনীকও বেশ কিছুদিন ধরে ফিন্যাস ডিপার্টমেন্টের প্রথম বর্ষের একটা মেয়েকে ভালোবাসে – ইশরাত মারিয়া মেয়েটার নাম। তাকে অনীক সত্যই অন্তর থেকে ভালোবাসে। মারিয়াকে সে কয়েকদিন আগে প্রপোজও করেছে, মারিয়া হ্যা-না কিছুই বলেনি; কেবল বলেছে, ‘ঠিক আছে, আমি চিন্তা করে দেখি।’ নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ ভেবে আশাবাদী অনীক যে, মারিয়া আজ হোক, কাল হোক, তার হবেই। কারণ, মারিয়ার সাথে ক্যাম্পাসে দেখা হলে সে লাজুক চোখে অনীকের দিকে তাকায়। সে চোখে আগ্রহ আর আবেগ দুটোই দেখতে পায় অনীক।
আর এদিকে, মীমকে অনীক শুধু বন্ধুর মতোই নয়, নিজের বোনের মতো দেখে। একদিন সে মীমকে বললো, “দোস্ত, খুব খারাপ লাগে যে তোর নামে তো অনেকেই অনেক বাজে কথা বলে। এমনকি এক পোলা সেদিন তুই আমার বাসায় এসেছিলি বলে আমাকে খুব খারাপ কথা বলেছিল। মানুষ যে কেন এমন হয়?’
মীম শুনে একটুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকেই হেসে দিল, তারপর বললো, ‘আসলে আমি সবার সাথে ফ্রিলি মিশি তো। তাই হয়তো আমার সম্মন্ধে অনেকেই ভাবে, এই মেয়ে তো চাইলেই সব দিয়ে দিবে। আর আমার খোলামেলা আচরণ ওরা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না, কারণ ঢাবিতে ধর বেশিরভাগ স্টুডেন্টইতো তোর ঢাকার বাইরে মফস্বল থেকে আসছে; সেজন্য আমার মত এরকম কাউকে তারা বোধহয় দেখে অভ্যস্ত নয়। তা আমার সম্মন্ধে ওরা বাজে কথা বললে তোর এত খারাপ লাগে কেন রে?’
‘কেন আবার। দেখ মীম, তুই শুধু আমার অন্যতম কাছের বন্ধুই না। তুই তো আমার বোন রে মীম। তুই এমন একজন বন্ধু যে আমার বোনের মতো। আমি তোর ভাই হলে কি তোর নামে খারাপ কিছু বললে আমি সেটা সহ্য করে নিতাম?’
মীম কিছুক্ষণ মুগ্ধতা নিয়ে অনীকের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর বললো, ‘দোস্ত, তোকে চিনতে আমার ভুল হয়নি। তোর সাথে মিশেই মনে হয়েছিল এই দুনিয়াতে তুই-ই হতে পারিস আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। সত্যিই, ছেলেগুলো যদি তাদের মেয়ে বন্ধুদের এভাবে বোনের মতো ভাবতো, তাহলে দুনিয়াটা কতোই না সুন্দর হতো।’
মিষ্টি করে হেসে অনীক মীমের গাল টিপে আদর করে দিলো। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তখন ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের সিটে পাশাপাশি বসে ছিল।

(৩)
সেই মীম যে এভাবে হঠাৎ করে বিদেশে পাড়ি জমাবে, তা অনীক তো নয়ই, পুরো বন্ধুমহলের কেউই ভাবতে পারেনি। মীম একদিন এক আড্ডায় সবাইকে জানিয়ে দিলো, সে যুক্তরাষ্ট্রের একটা নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। সেখানেই সে গ্র্যাজুয়েশন করবে। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কেবল প্রথম বর্ষের পাঠই কেবল চুকিয়েছিল। তাই, এতে তার তেমন কোন বছর লস হবে না। আর ঢাবির সেশনজট তো বিদেশে নেই। এমনও হতে পারে- একবছর পর পড়ালেখা শুরু করে সে ঢাবির সহপাঠীদের আগেই গ্র্যাজুয়েশনের পাঠ চুকিয়ে ফেলেছে। মীমের আমেরিকার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়ার খবরে সবাই আনন্দিতই হল প্রথম প্রথম। কিন্তু, বন্ধুমহলের সবার মন খারাপও কম হল না। কারণ মীম তাদের ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে সবার চেয়ে অনীকেরই মন খারাপ ছিল বেশি। চলে যাওয়ার আগে মীমমে বন্ধুরা সবাই মিলে একটা ফেয়ারওয়েল দিলো। মীমকে জড়িয়ে ধরে মেয়ে বন্ধুগুলোর কয়েকজন কেঁদেই দিলো। আর রবিনসহ কয়েকজন মীমের হাত ধরে আকড়ে কিছুক্ষণ বসে থাকলো। সবচেয়ে বেশি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বসে ছিল অনীক। সে কেবল একপাশে বসে থেকে বিষণ্ণ চোখে সবকিছুই দেখতে লাগলো। হঠাৎ মীম একপাশে এসে প্রায় অনীকের কানে কানে বললো, ‘দোস্ত কালকে সন্ধায় ছবির হাটে আমার সাথে দেখা করিস।’
আগামীকাল সন্ধায়ই মীমের আমেরিকাগামী ফ্লাইট। তাই অনীক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ‘তোর ফ্লাইট না আগামীকাল সন্ধায়?’
‘আরে, আমি যেটা বললাম সেটা কর’, এই কথা বলে আবার মীম অন্য বন্ধুদের দিকে নজর দিলো। একসময় মীম সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ধানমণ্ডিতে তার বাসার দিকে চলে গেল।
মীমের ব্যাপার-স্যাপার কিছুই মাথায় ঢুকলো না অনীকের। সে সেই রাতেই মীমকে ফোন দিলো, জিজ্ঞাসা করলো যে সত্যিই দেখা করতে চায় কিনা, মীম তাকে নিশ্চিত করলো ব্যাপারটা। অনীক জিজ্ঞাসা করলো, ‘তাহলে তোর ফ্লাইট কবে?’
‘ফ্লাইট তো আগামীকাল সন্ধায়ই’, শুনে অনীক চুপ করে থাকলো। তাকে চুপ থাকতে দেখে মীম বললো, ‘দোস্ত, সাক্ষাতে সব বলবো,’ এই কথা বলে সে ফোন রেখে দিলো।

(৪)
পরদিন বিকাল থেকেই অনীক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসে রইলো। সন্ধ্যা নামলো ধীরে ধীরে। অনীক মীমের ফোনের অপেক্ষায়। সে আসলেই বুঝতে পারতেছে না যে মীম আসলে কেন তার সাথে দেখা করতে চাইছে। আর কেনই বা বলেছে আজকে তার ফ্লাইট। প্রচণ্ড আগ্রহ আর কৌতুহল নিয়ে অনীক মীমের ফোনের অপেক্ষায়। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের কালো নামতেই হঠাৎ মীমের নম্বর থেকে ফোন এল অনীকের সেলে। ত্রস্ত হাতে সে ফোন রিসিভ করলো। সেই পরিচিত বন্ধুর ফোন, যে তাকে ছেড়ে আজ দূরে চলে যাচ্ছে। মীম তাকে সোহরাওয়ার্দীর ছবির হাটে আসতে বললো। দ্রুত অনীক সেখানে চলে এলো। এসে দেখলো, সে মোল্লার ক্যান্টিনের সামনে বসে আছে। ওর পরনে জিন্স, আর লেডিস টপস। আর হাতে একটা সামান্য ব্যাগ ছাড়া আর কিছু নেই। আর আর একটা জিনিস দেখলো অনীক, যা মীমের হাতে আগে দেখেনি। বড় মাপের একটা ব্যতিক্রমী ডিজাইনের ঘড়ি। কিন্তু, এরকম ঘড়ি যে কারও হাতে থাকতে পারে ভেবে অনীক সেদিকে খুব একটা নজর দিলো না। সে সরাসরিই মীমকে বললো, ‘দোস্ত বলতো, ঘটনাটা আসলে কি? তো কথাবার্তা আজ কাজকর্ম তো আমার কিছুই মাথায় ঢুকতেছে না?’
‘দোস, আমার সাথে আয়’, এই কথা বলে মীম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভিতর ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো। মাথার উপরে পূর্ণিমার চাদের মতই বড় একটা চাঁদ জ্বলজ্বল করছিল; আর অনীক যেন চন্দগ্রস্থের মতই মীমের পিছু পিছু গেল। বেশ খানিকটা দূরে স্বাধীনতা স্তম্ভ আর তার আকাশ ছোঁয়া আলোর শিখা। এই রাতের আধার, চাঁদ ও কৃত্রিম আলোয় সামনে এগিয়ে চলা মীমকে তার খুবই রহস্যময়ী কেউ বলে মনে হল। যেন এই পৃথিবীর কেউ বলে এখন আর মনে হচ্ছে না তাকে। শিখা চিরন্তনের সামনে একটা নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে মীম বসে পড়লো। তারপর অনীককে হাত নেড়ে ডাকলো। কৌতুহলে ফেটে পড়া অনীক দ্রুত তার পাশে বসে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। অনীককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মীম বলা শুরু করলো,
‘জানি, তুই খুব অবাক হচ্ছিস। এবারে তোকে সব বুঝিয়ে বলবো।’
অনীক আগ্রহ আর বিস্ময় নিয়ে মীমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মীম বলতে লাগলো,
‘দোস, তুই একদিন বলেছিলি না যে আমি এই জগতের কেউ নাকি; আমি আসলেই এই দুনিয়ার কেউ না।’
‘তুই কি ঠিক আছিস দোস্ত? সত্যিকার অর্থে তোর মত মেয়ে এই দুনিয়ায় পাওয়া কঠিন। তাই বলে এইটা কেমন কথা যে তুই এই দুনিয়ারই কেউ না?’
‘বুঝছি, কিছু প্রমাণ না দেখালে তুই বিলিভ করবি না। এক কাজ করতো, তোর ব্যাগ থেকে একটা বই বের কর।‘
অবাক হয়ে অনীক তাকিয়ে ছিল। মীম তাকে আবারও বইটা বের করতে তাড়া দিল। আগত্যা অনীক ব্যাগ থেকে একটা মিডিয়াম সাইজের বই বের করল।
‘ধর এটা হচ্ছে একটা স্ক্রীণ। আর আমার হাতে যে ঘড়িটা দেখতেছিস, মনে কর এটা একটা প্রজেক্টর, যদিও এর আরও ফাংশন আছে।‘
এই কথা বলে মীম তার ব্যাগ থেকে একটা ধাতব কাঠি বের করলো। এরপর চললো সেটা দিয়ে ঘড়িটার স্ক্রীণে কিছুক্ষণ টেপাটেপি। অনীক অবাক হয়ে দেখলো, ঘড়িটা যেন আধুনিক একটা স্মার্টফোনের মতই একটা জিনিস। তবে, এই ধরণের যন্ত্রের কথা সে আগে কখনো শোনেনি, দেখে তো না-ই।
মীম বইটা নিয়ে মাটির উপর রাখলো। তারপর, তার উপরে ঘড়িটা লম্বভাবে ধরলো। অনীক অবাক হয়ে দেখলো ঘড়িটা থেকে একটা আলোকরশ্মি বের হয়ে বইয়ের উপর পড়লো; আর পড়ার সাথে সাথেই বইয়ের উপর বিভিন্ন একটা চলমান ভিডিও দেখা যেতে লাগলো। সেখানে একজন বয়স্ক লোকের ছবি দেখা গেল। তার গায়ে সাদা রংয়ের একটা অপরিচিত বস্তুর পোশাক। সে কথা বলতে লাগলো বাংলাতেই,
'প্রিয় পৃথিবীবাসী, আমরা আপনাদেরই মত মানুষ। আমরা আপনাদের প্যারালাল ইউনিভার্সের অধিবাসী। আমরা অনেক অনেক চেষ্টার পর প্যারালাল ইউনিভার্সের আপনাদের সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছি। আপনাদের দুনিয়ায় আমাদের পাঁচজন নভোশ্চর পাঠিয়েছি। আপনি এই ভিডিওটা দেখছেন তার অর্থ আমাদের একজন অভিযাত্রী আপনাকে আমাদের সম্পর্কে সবই খুলে বলেছে। আমাদের গ্রহের নাম একিন্টন। আমাদের গ্রহের সব মানুষদের পক্ষ থেকে আপনাকে শুভেচ্ছা, অভিনন্দন ও ভালবাসা জানাচ্ছি।’
বয়স্ক লোকটির কথা শেষ হতেই ‘পর্দায়’ বিভিন্ন ছবি ভেসে আসলো। এমন কিছু মানুষের আর এমন কিছু ঘরবাড়ির ছবি দেখা গেল, যার সাথে পৃথিবীর মানুষ ও ঘরবাড়ির বেশ খানিকটাস পার্থক্য রয়েছে। তারপর এমন কিছু পশুপাখি আর উদ্ভিদের ছবি দেখা গেল, যা অনীক অত্যন্ত কখনো দেখেনি। একটু পরেই মীম ‘প্রজেক্টর’টা বন্ধ করে দিলো।
‘প্রথমেই যার কথা শুনলি, তিনি আমাদের গ্রহের মহাকাশ সংস্থার প্রধান। আর তার সাথে সাথে তো আমাদের গ্রহের বিভিন্ন জিনিস দেখতেই পেলি। এখন কি দোস্ত, কিছু কিছু তোর মাথায় ঢুকছে?’
অনীক কি বলবে, ভেবে পেল না। তার মনে হল, সে একটা অদ্ভূত ঘোরের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু, মীম তো এমন মেয়ে নয় এতসব কিছু বানিয়ে বলবে। তবুও সে জিজ্ঞাসা করলো, ‘আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না রে। কিন্তু, তুই আমাকে বোকা বানানোর জন্য বা সারপ্রাইজ দেবার জন্য আমার সামনে কোন সায়েন্স ফিকশন মুভির ক্লিপিংস দেখাচ্ছিস না তো?’
মীম হেসে দিল অনীকের কথা শুনে। তারপর বললো, ‘বুঝছি, তোকে আরও প্রমাণ দেখাতে হবে। আচ্ছা, তুই ভিডিওতে যে সব মানুষের ছবি দেখলি, তাদের চুলের রঙ কি দেখেছিস, বলতো?’
‘মনে নেই ঠিক। তবে, মনে হল চুল বেশ রঙ্গিন…।’
‘হুম রঙ্গিন, তবে যে সেই রঙ্গিন না। আমাদের গ্রহের মানুষের চুল সাত রঙের। যাকে তোরা বলিস রামধুনুর রঙ।‘
এই কথা বলে সে একটা অদ্ভুত কাজ করলো। সে তার মাথার চুলের নিচে হাত ঢুকিয়ে একটা টান দিলো উপরের দিকে। আর যেটা ঘটলো, সেটা দেখে অনীক আতকে উঠলো। মীমের হাতে উঠে এলো তার নরম। সিল্কী চুলের পুরো গোছা। তার নিচে দেখতে পেল চোট ছোট করে ছাঁটা চুল। চাঁদের আলো আর স্বাধীনতা স্তম্ভের আলোকচ্ছটায় সে স্পষ্ট দেখতে পেল মীমের চুলগুলো – সেগুলো রঙ্গিন। সে মীমের মাথায় হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখলো; খুব কাছে থেকেই সে দেখতো পেল সপ্তবর্ণা চুলগুলো। মীম তাহলে তার সপ্তবর্ণা চুলগুলো কাল একটা পরচুলা দিয়ে ঢেকে রেখেছিল।
অনীকের শরীরের মধ্যে একটা অদ্ভুত আবেগ বয়ে গেল। সে মীমকে দুই হাত দিয়ে মীমের দুই কাঁধ আঁকড়ে ধরলো। তারপর বললো, ‘আমার তোর সাথে পরিচয়ের পরই মনে হয়েছিল, তুই অন্য আর দশটা মেয়ের চেয়ে অনেক অনেক আলাদা। কিন্তু তুই যে সত্যি সত্যি এই দুনিয়ারই কেউ না, সেটা বুঝবো কি করে রে?’
সে মীমকে ধরে এভাবেই কিছুক্ষণ বসে থাকলো। মীমের কথায় তার চমক ভাঙ্গলো।
‘দোস, তোকে বলেছিলাম না আজকেই আমার ফ্লাইট। তার মানে কিন্তু, আমি আজকেই চলে যাচ্ছি। আর এই দুনিয়ায় আমি আছি বড়জোর মিনিট দশেক। তারপরেই আমি আমাদের ইউনিভার্সে ফিরে যাবো।’
‘তুই আমাদের বাংলা ভাষাটা এত ভাল করে শিখলি কেমন করে? আর তোদের অভিযানের জন্য আমাদের বাংলাদেশই বা বেছে নিলি কেন?’ জিজ্ঞাসাস করলো অনীক।
‘ভাল প্রশ্ন করেছিস, দোস্ত। আমাদের মহাকাশ সংস্থা থেকে পৃথিবীতে অভিযানে এসেছি মোট পাচজন। অন্য চারজন অন্য চার দেশে আছে। আর বাংলাদেশকে বেছে নেয়া হয়েছে কারণ এই দেশের মানুষের মধ্যে অনেক বেশি বৈচিত্র, এই দেশের মানুষেরা অনেক আবেগি। এইসব আমাদের গবেষণায় কাজে লাগবে রে। আর পৃথিবীতে আমাদের এই অভিযানে আসতে আমাদের পৃথিবীর সময়ের মোট ৬০ বছর খরচ হয়ে গেছে। এখান থেকে আমাদের দুনিয়াতে ফিরে যেতে আরও ৬০ বছর লাগবে। সেজন্য, সবকিছু আমাদের খুব ভালভাবে প্ল্যানিং করতে হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে আমি ঢাবিতে পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হয়েছিলাম, পৃথিবীর মানুষ আর তাদের সংস্কৃতিকে বোঝার জন্যই।
অবাক হয়ে অনীক প্রশ্ন করলো, ‘তাহলে তোর বয়স কত?’
‘বেশি না। পৃথিবীর হিসেবে মাত্র ১৭৫ বছর। অবশ্য আমাদের গড় আয়ু পৃথিবীর হিসাবে ৪৫০ বছর।‘
‘বুড়ি কোথাকার,’ কপট রাগ দেখালো অনীক। তারপর বললো, ‘আমি তোকে কতটা মিস করবো, তুই কি জানিস?’ কথাটা বলতে গিয়ে অনীকের গলা ধরে এল। সে আলতো করে মীমের মাথাটা নিজের মুখের কাছে টানলো। মীমের কপালে একটা চুমো দিলো। তারপর কপালে কপাল, নাকে নাক লাগিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো। সে দেখলো মীমের চোখেও জল, তার চোখের মতই। মীমও আলতো করে অনীকের কপালে চুমু দিলো। বললো, লাভ ইউ দোস্ত। তোকে আমিও অনেক মিস করবো, ভাই আমার।’
একটা বিরতি দিয়ে সে বললো, আমি জানি তুই আর তোর ফ্যামিলি খুব কষ্টে চলিস। আমি চলে যাওয়ার আগে তোর নামে বেঙ্গল ব্যাঙ্কে একটা একাউন্ট খুলে তোর নামে লাখ দশেক টাকা রাখার ব্যবস্থা করেছি। তুই এখন নির্ঝঞ্ঝাটে পড়ালেখা চালাতে আর তোর ফিউচার প্ল্যান একসিকিউট করতে পারবি।’
বিস্মিত অনীক বললো, ‘তুই এসব করতে গেলি কেন, পাগলি। আমার কি নিজের টাকা কামানোর যোগ্যতা নেই?’
‘আমি জানি তোর আত্মসম্মানটা একটু বেশি। কিন্তু, তুই যে কঠিন একটা ডিপার্টমেন্টে পড়িস, সেখানে থেকে তোর রেজাল্ট ভাল করতে হলে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাটা দরকার। সেজন্যই আমি এটার ব্যবস্থা করে গেছি। কারণ আমি বুঝতে পেরেছি, এই পৃথিবীতে মানুষ টাকাকেই সবচেয়ে বেশি ভ্যালু দেয়, যদিও আমাদের দুনিয়ায় মানুষগুলো এরকম স্বার্থপর নয়। কিন্তু, এই দুনিয়ায় মানুষ তোকে মুখে অনেক কিছুই করবে। কিন্তু, কেউ তোকে একটা টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চাইবে না। মারিয়াকে পেতেও তো তোর কিছুটাকা খরচ করতে হবেই, তোর ফিন্যান্সিয়াল ব্যাকআপ যে স্ট্রং এটা তো বোঝাতে হবে ওকে, তাই না? তোর মোবাইলে এসএসএস করে আমি ঐ একাউন্টের ডিটেইলস একটু আগেই কিন্তু পাঠায়ে দিসি, দোস্ত।’
অবাক হয়েই কেবল তাকিয়ে রইলো অনীক। তারপর বললো, ‘আমার আর কোন সন্দেহই নেই যে তুই এই দুনিয়ার কেউ নয়। এই দুনিয়ার, বিশেষ করে এই দেশের কোন মেয়ে তার বন্ধুর জন্য এত কিছু নিঃস্বার্থভাবে কখনোই করবে না।’
‘আরে, তোর বন্ধু হিসেবে, তোর বোন হিসেবে যদি এটুকুই না করতে পারি...।’ বললো মীম।
তারপর বললো, ‘আমার যেতে আর বেশি দেরী নেই দোস্ত। তোদের আমি বলেছিলাম না যে আমার ফিয়াসেঁ আমেরিকায় থাকে। তার মানে ও কিন্তু, আমাদের গ্রহতেই থাকে। অল্প কিছুক্ষণের জন্য আমি তোর সাথে ওকে মিট করিয়ে দেব। তবে, ও সত্যিকারভাবে নয়, ভার্চুয়ালভাবে এই গ্রহে আসবে।‘
এরপর মীমের আঙ্গুল আবারও তার ঘড়িতে খেলে যেতে লাগলো। মীম এবার হাতটা সোজা করে ধরলো। ঘড়ি থেকে একটা সবুজ রশ্মি বের হয়ে কিছুটা সামনে গিয়ে একটা মানুষের আকৃতিতে রুপ ধরলো। অনীক দেখতে পেলো একটা সাদা পোশাক পরা খুব সুদর্শন ছেলের প্রতিমূর্তি তার সামনে দাঁড়িয়ে। তাকে সে বলতে শুনলো, ‘হাই অনীক, আমি সানিতসো। আমি জেনটিলা, তোমরা যাকে বলো মীম, তার পার্টনার। জেনটিলা তোমার কথা অনেক বলেছে। তোমাকে সরাসরি দেখার লোভ সামলাতে পারছি না। আমাদের ইউনিভার্সে তোমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলাম। একসময় আশা করি তোমাকে আমাদের গ্রহে নিয়ে আসতে পারবো। তুমি আমাদের হৃদয়ে আমাদের একজন ভাল বন্ধু হিসেবে সবসময় থাকবে।’
এবার মীম ঘড়িটা অনীকের দিকে ধরলো। ও বললো, ‘অনীক, এবার তুই সানিতসোকে কিছু বল।’
‘আমি জানি না কি বলবো। আমি মনে করি আমরা সবাই এই সৃষ্টি পরিবারের সদস্য। তোমার আমন্ত্রণ আমি গ্রহণ করলাম। জানিনা, কবে তোমার সাথে সামনাসামনি আর মীমের সাথে আমার কবে দেখা হবে। তোমাদের আমি সত্যিই অনেক মিস করবো।’
মীমের আঙ্ঘুল আবার ঘড়িটাতে খেলে গেল। সানিতসোর মূর্তিকে সে তার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে দেখলো, মুখে চমতকার একটা হাসি নিয়ে। সেই অবস্থাতেই তার মূর্তিটি অপসৃত হলো।
মীম এবার করুণ চোখে যেন অনীকের দিকে তাকালো। বললো, দোস্ত, আমার যাবার সময় হয়েছে। আমাকে বিদায় দে।‘
অনীক মীমকে দুই হাতে আকড়ে ধরলো। মীমও তাকে জড়িয়ে ধরলো। একটা অসম্ভভব রুপবতী মেয়েকে সে জড়িয়ে ধরেছে কোন শংকোচ, কোন কামবোধ ছাড়াই ছাড়াই। মীম আর অনীকের দুজনের চোখেই জল। অনীক মীমের কপালে আবার চুমু খেল। মীমের দুই চোখেও তার চুম্বন পড়লো। মীম বললো, ‘লাভ ইউ দোস্ত।তোকে আমি সসসময় মনে রাখবো।
‘আর কি করবি?’ চোখে পানি নিয়ে মৃদু হেসে বললো অনীক।
‘আমার আর সানিতসোর প্রথম সন্তান হলে তোর নামে রাখবো, বললো মীম।
‘আর আমিও আমার প্রথম সন্তানের নাম তোর নামে রাখবো। ওর নাম হবে জেন’, বললো অনীক।
মীম এবার অনীককে ছেড়ে তার ঘড়ি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। তারপর অনীককে বললো, যাইরে দোস।‘ এই কথা বলে সে সামনের দিকে হেঁটে গেল। সামনেই গিয়ে সে স্বাধীনতা স্তম্ভের সামনে গিয়ে দাড়ালো। করুণ মুখে সে অনীকের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে থাকলো। হঠাত উপর থেকে এক ঝলক আলো এসে মীমরুপি জেনটিলার উপর পড়লো। তারপর সে দেখতে পেলো, কিছুক্ষণ আগে মীমরুপি জেনটিলা যে জায়গাটিতে ছিল, সেই জায়গাটি দেখা গেল ফাঁকা। এত দ্রুত ব্যাপারটা ঘটে গেল যে, আশেপাশের লোকজন একে স্বাধীনতা স্তম্ভ বা এর কোন অংশ থেকে আলোর বিচ্ছুরণ হিসেবেই মনে করলো।

অনীক বেশ খানিক্ষণ অবাক হয়ে, আর কিছুটা বিষণ্ণতার সাথে সেইদিকে তাকিয়ে রইলো। স্বাধীনতার স্তম্ভটি যেন অনীক আর মীমের বন্ধুত্বের প্রতীক হয়েই ঊর্ধ্বাকাশে আলোক রশ্মি ছড়িয়েই চলেছে।

0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ