নিউইয়র্কে রাস্তার পাশে ভ্যান গাড়িতে "জায়রো" নামের একটি জনপ্রিয় হালাল খাবার বিক্রি হয়। বিচ্ছিন্নভাবে এখানে ওখানে বাঙালি মালিকানাধীন এমন অনেক ভ্যান গাড়ি আছে, যেখানে সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করেন বাংলাদেশী যুবকেরা। চোখের সামনেই গরম গরম বানিয়ে দেয়া হয় পাঁচ ডলারের এই খাবারের বক্স। গত সপ্তাহে দুপুরের কোন এক সময়ে খাবার অর্ডার দিয়ে অন্য অনেকের সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। তুমুল ব্যস্ততা কর্মজীবী যুবকটির। খুব দ্রুততার সাথে হাসি মুখে একে একে সকলকে সিরিয়াল অনুযায়ী খাবার দিচ্ছিলেন। একদিকে রাইস কুকারে রাইস ঢেলে দিচ্ছেন। অন্যদিকে চিকেন, ওনিয়ন, গ্রিন পেপারস প্রোসেসিং করছেন গরম চুলায়। বুঝা যাচ্ছে কাজটুকু পরিশ্রমের হলেও তিনি আনন্দের সাথেই করছেন। এবং তা আরো উপভোগ্য করতে টেপ রেকর্ডারে উচ্চ ভলিওমে বাংলা গান ছেড়ে রেখেছেন। নিজের কাজকে, চারপাশের পরিবেশকে আনন্দময় করে তোলার এই যে মানসিকতা, বিষয়টি মুগ্ধ করে আমায়। যেহেতু আমার আগে অনেকেই সিরিয়ালে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে, তাই আমি সবজি কেনার উদ্দেশ্যে সুপারমার্কেটের দিকে ছুটছি। অনেকদূর পর্যন্ত যেতে যেতে শুনছিলাম রেকর্ডারে বেজে যাওয়া গান,
বুকেরও ভিতরে আন্ধার কুটিরে
তুমি ওগো চান্দেরও বাতি ...
চোখেরও মনিতে শয়নে-স্বপনে
আছো তুমি দিবসও রাতি ...
গ্রোসারি সেরে আবারও সেই ভ্যান গাড়ির দিকে ফিরছি খাবার পিকআপ করতে। খানিক দূর থেকেই কানে ভেসে আসে গান,
এপারে থাকিবোওওওও...
এপারে থাকিবো, ওপারে থাকিবো
যাবো না দূরে সরিয়া, বন্ধু পরজনমেও মরিয়া...
অসাধারন সব রোমান্টিক বাংলা গান। দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের এই দেশে কঠোর পরিশ্রমী টগবগে এক যুবক সকাল থেকে রাত্রি অবধি হাসিমুখে কাজ করছেন দেশেরই গান শুনে, বিষয়টি চমৎকার। একরাশ ভালোলাগার আবেশ নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরি।
এই শহরে মা দিবস ছিল যেদিন, রাস্তার দুইধারে ফুলের পসরা নিয়ে বসেছেন অনেক বিক্রেতা। শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, নানান রকম ভিনদেশি মানুষজন ফুল কিনছেন মায়ের জন্যে। মায়ের প্রতি এইদিন সকলের আবেগ অনুভূতিতে যেন ভিন্নতা নেই। সর্বত্র উৎসবের পরিবেশ। রমযান উপলক্ষে কেনাকাটা করতে সেই বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় যাই। "জায়রো" অর্ডার দিয়ে অপেক্ষমান অনেকের সাথে দাঁড়িয়ে আছি। সম্ভবত সকলেই যুবকের প্রতিদিনের চেনাজানা কাস্টমার। কাজের ফাঁকে তিনি গল্প করছিলেন। একজন জানতে চাইলেন, ছুটি করেন কবে ? খাবারের বক্স এগিয়ে দিয়ে বিল নিতে নিতে বললেন, ছুটি নিয়া কী করবো, পরিবার তো দেশে, তাছাড়া একদিন ছুটি করা মানে একশো ডলার লস। তিনি আবারো আপন মনে কাজ করে চলেছেন। চামচের টুংটাং শব্দ, ধোঁয়া উঠা খাবার, প্যাকেটে নিচ্ছেন, উপর সস দিয়ে অপেক্ষমানদের দিকে প্যাকেট এগিয়ে দিচ্ছেন। বিল বুঝিয়ে দিয়ে আমি ফিরছি অদূরে পার্ক করা গাড়ির দিকে। ভ্যান গাড়িতে গান বেজে চলছে,
কতদিন দেহিনা মায়ের মুখ
হুনিনা সেই কোকিল নামের কালা পাহির গান
হায়রে পরাণ, হায়রে পরাণ...
সেদিন আমরা অনেকেই যখন ফেসবুকে ছবি দিচ্ছিলাম, মা'কে নিয়ে সুখের কিংবা দুঃখের স্মৃতিচারণ করছি্লাম, তখন বিদেশ বিভূঁইয়ের ব্যস্ততম দিনে একজন প্রবাসী তাঁর কর্মব্যস্ত সময়ে নিরবে মায়ের গান শুনছেন, মা'কে মনে করছেন। গান শুনতে শুনতে তিনি হয়তোবা স্মৃতির জানালা ধরে মায়ের কাছে ফিরবেন, পরিবারের কাছে ফিরবেন, কাস্টমারদের সামনে হাসির আড়ালে কান্না লুকাবেন। হয়তোবা। কিন্তু আমি ভাবছি অন্যকথা। একজন মানুষ, যার কিনা পরিবার কাছে নেই বলে ছুটির দিন কিংবা আনন্দময় ঘুরে বেড়ানোর দিন, অর্থহীন। সময় নষ্ট না করে বাড়তি উপার্জন এবং পরিবারকে অর্থ পাঠানোর মাঝেই যার সকল আনন্দ নিহিত। দূরের অস্তমিত সূর্যের ন্যায় দিনভর আলো বিলিয়ে পরন্ত বেলায় নিজে ডুবে যাওয়া মানুষ। দেশে সেই মানুষটির পরিবার কিংবা প্রিয়জনেরা হয়তো কোনদিনই জানবে না প্রাপ্ত ডলারের বিপরীতে লুকিয়ে থাকা ঘাম, শ্রম, কষ্ট কিংবা দীর্ঘশ্বাসের এইসব গল্প।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
২০টি মন্তব্য
ইঞ্জা
আপনার প্রবাসী জীবনের গল্প এক একটি আলাদা অনন্য অনুভূতি দেয়, কখনো হাসায়, কখনো কাঁদায়, আজ পড়লাম এক পরিশ্রমী সংগ্রামী যুবকের কথা, খুব ভালো লাগলো আপু।
রিমি রুম্মান
মাঝে মাঝে এমন গল্প নিয়ে আসবো, আশা করি। অনেক ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্যে।
ইঞ্জা
আপু, আপনার গল্পের জন্য আমি অপেক্ষায় থাকি এই সত্য।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
প্রবাস জীবনের বাস্তব এবং তীগ্ন অভিজ্ঞতায় ছিলাম বেশ কটি বছর।লেখাটি খুব ভাল লাগল।
রিমি রুম্মান
লেখাটি ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগলো। এমন মন্তব্য অনুপ্রেরণা যোগায়। অনেক ধন্যবাদ।
মোঃ মজিবর রহমান
আপনার লেখায় প্রবাস জিবনের অনেক লুকানো, হাসি, কষ্ট, ভালোবাসা, মনের গহীনে যে দেশের পরিবার পরিজনের জন্য অরথউপারজনের যে শ্রম দেয় তা আমরা দেশি কখনই বুঝি তা তুলে ধরেছেন এবং আমরা বাস্তবেও বিদেশে কি কষ্ট করে তা বুখতে চাইনা। তো জিবনে যে যেভাবে পারে আনন্দ উপভোগ করা একটি কিন্ত কম নয় তা বেড়িয়ে , গান শুনে যেভাবেই হোক না কেন? আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ আপু।
রিমি রুম্মান
চারপাশে ঘটে যাওয়া এমন ঘটনা নিয়ে লিখবো নিশ্চয়ই আরো। সাথে থাকছেন তো ? শুভকামনা…
মোঃ মজিবর রহমান
সঙ্গে আছি আপু। (y)
মৌনতা রিতু
চমৎকার করে অনুভূতিগুলো বলে গেলে আপু। গানগুলো তখন তোমাকে অন্যরকম আনন্দ দিচ্ছিলো। হয়তো আবেগপ্রবন হচ্ছিলে বার বার। চোখের কোনায় পানি ছিলো জমে।
তোমার লেখায় দৃশ্যগুলো ভেসে উঠলো যেনো চোখের পাতায়।
রিমি রুম্মান
সত্যি বলতে কী, গানগুলো আগে রেডিওতে শুনেছিলাম, দেশে। এই ভীনদেশে , তাও আবার খোলা রাস্তায় উচ্চ ভলিওমে গানগুলো শুনে বেশ ভাল লেগেছিল। 🙂
খসড়া
প্রবাসী বন্ধু একদিল যখন বললো এখানে কেউ কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখে না।
বুকের মাঝে যে তাল কেটে গেল তা আর জোড়া লাগেনি।
রিমি রুম্মান
এখানে সত্যিই এমন মমতায় কপালে হাত রাখা হয়না কারো। সবাই ব্যস্ত, যান্ত্রিক।
জিসান শা ইকরাম
দেশের বাইরে যারা থাকেন, তারাই সবচেয়ে মিস করেন দেশকে, দেশের মানুষকে।
যখন আমি বিদেশে যাই, দেখি প্রায় প্রতিটি বাংগালীই বাংলাদেশের বাংলা গান শুনেন, অথচ দেশে বসে আমরা শুনি হিন্দি, ইংরেজী গান।
পরিশ্রমী ঐ যুবকের প্রতি অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা।
রিমি রুম্মান
সেই মূহুর্তে নিজেকে মনে হয়েছিল বাংলাদেশে আছি। আমাদের ইডেন কলেজের সামনে এক মামা চটপটি বিক্রি করতো এমন সব সিনেমার গান শুনে। বহু বছর পর আবার এমনটি দেখলাম। ভাল লাগলো।
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু তোমার লেখাটা পড়ার পর, বুকের ভেতর থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো।
ভালো থেকো। -{@ (3
রিমি রুম্মান
আত্নীয় পরিজনহীন এই দূরদেশে মানুষ কতভাবেই না নিজের আনন্দ খুঁজে নেয়, তাই না, নীলাদি ?
নীলাঞ্জনা নীলা
ঠিক বলেছো রিমি আপু।
এছাড়া কেউ তো হাসিটুকু তৈরী করে এনে দেবেনা। নিজেকেই তৈরী করে নিতে হয়।
আপু আমাদের এখানে একবার এসোনা, খুব তো দূরে থাকিনা।
তৌহিদ ইসলাম
প্রবাস জীবনে প্রত্যেকেই অনেক কঠোর পরিশ্রম করে। তা আমরা দেশে থেকে সহজে উপলব্ধি করতে পারিনা অনেকেই। সুন্দর ভাবে প্রকাশ করেছেন আপু। শুভকামনা রইলো।
রিমি রুম্মান
অনেক ধন্যবাদ, ভাইয়া। ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, আনন্দে থাকুন। শুভকামনা।
তৌহিদ ইসলাম
ধন্যবাদ আপু