নীলশির; হাঁস প্রজাতির এই পাখি প্রথম দেখি ২০১৭ সালে রাজশাহীর পদ্মার চরে। তখন ছবি তুলতে পারিনি। পিয়ং হাঁসের ঝাঁকে লুকিয়ে ছিল। তাও আবার অনেকটাই দূরে! ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে খুঁজতে খুঁজতে কোথায় যে হারিয়ে গেল আর খুঁজে পেলাম না।

নীলশির দেখার পর থেকেই আমি অভিভূত। জানতে পারলাম টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রতি বছর দেখা যায়। পরের বছর হাওরে গেলাম। পাখিটির দেখা পেলাম না। এভাবে ২০১৯ সালেও গেলাম। তখনও দেখা পেলাম না। ২০২০ সালে মার্চ মাসের ৮ তারিখ আবার গেলাম। কিন্তু সেবারও পাখিটির সন্ধান মিললো না। অনেকে বললেন, সময় মতো যেতে না-পারায় পাখিটির দেখা পাইনি। যে কারণে ধরেই নিয়েছিলাম আর কোনো দিন পাখিটির দেখা পাবো না। পাখিটির ছবি তোলার ইচ্ছের পেছনে মূল কারণ ছিল- এরা গৃহপালিত হাঁসের পূর্বপুরুষ নীল মাথার সুদর্শন বুনো হাঁস। এরা মূলত পরিযায়ী হাঁস পাখি। অধিকাংশ পাখি আসে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে।

অভিজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে এবছর জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে টাঙ্গুয়ার হাওরে গেলাম। রোয়ার খালে যত প্রজাতির হাঁস পাখি ছিল সবগুলো দূরবীন দিয়ে দেখা শুরু করলাম। কোথাও নীলশির খুঁজে পেলাম না। পরে লেইচ্ছামারা খালে ঢুকলাম। সেখানেও তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। দেখা না পাওয়ায় মনটা বিষণ্নতায় ভরে গেল। অথচ এক সপ্তাহ আগেও বেশ কয়েকজন ফটোগ্রাফার নীলশিরের ছবি তুলেছেন। সারাদিনের পরিশ্রমে শরীর ক্লান্ত। সেদিনের মতো কাজ শেষ করে হাওর বিলাসে ফিরে এলাম।

রাতে একজনকে ফোন দিলাম। ওর কাছে পাখিটির লোকেশন জেনে নিলাম ভালো করে। পরের দিন আবার নৌকা নিয়ে লেইচ্ছামারা বিলে প্রবেশের পরপরই লালসিঁথি হাঁসের ঝাঁকে এক জোড়া অন্য প্রজাতির হাঁস দেখতে পেলাম। আমি গত তিন বছর ধরে যাকে খুঁজছি সে এখন আমার চোখের সামনে। শরীর ও মন উত্তেজিত হয়ে উঠল! নিজেকে সামলে নিয়ে অনবরত ক্লিক করলাম। বিভিন্ন ফ্রেমে বেশ কিছু ছবি তুললাম। কথায় আছে ধৈর্য্য ধরলে অনেক কিছুই মেলে। আমার ধৈর্য্য ধরা সার্থক হলো।

পাখিটির নাম নীলশির হাঁস। অনেকে ‘বৈরাগী হাঁস’ বলেও চেনেন। নীলশির হাঁস অ্যানাটিডি গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত প্রায় ৫৭ সে.মি. দৈর্ঘ্যের এবং ১২০০-১৫০০ গ্রাম ওজনের বড় আকারের হাঁস। ছেলে ও মেয়ে হাঁসের চেহারায় ভিন্নতা আছে। প্রজননকালে ছেলে হাঁসের গায়ের রং গাঢ় ধুসর হয়। মাথা ও ঘাড় সবুজ বর্ণের। বুক বেগুনী-বাদামি। গলা সাদা। কালো পালকের লেজ উপরের দিকে বাঁকানো। ডানায় নীল; পা কমলা রঙের। প্রজননকাল ছাড়া ছেলে হাঁস দেখতে অনেকটাই মেয়ে হাঁসের মতো। মেয়ে হাঁস দেখতে বাদামি বর্ণের ওপর কালো দাগ বা ডোরা থাকে। চোখ বাদামী। ঠোঁট কালচে সবুজ বা হলুদ। ঠোঁটের আগা হলুদ ও গোড়া কালো। পা ও পায়ের পাতা কমলা-হলুদ বা প্রবাল লাল বর্ণের হয়।

নীলশির হাঁস অগভীর হ্রদ, নদী, হাওর ও বিলে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায়। সাধারণত দল বেঁধে থাকে। মাঝে মাঝে দলছুট হয়ে যায়। অন্যান্য প্রজাতির হাঁসের ঝাঁকে দেখা গেলেও এদের চলন ও স্বভাবে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। মাথা পানিতে ডুবিয়ে খাবার খোঁজে। এদের খাবার তালিকায় রয়েছে জলজ লতাপাতা, বীজ, শামুক জাতীয় অমেরুদণ্ডী প্রাণী, ব্যাঙাচি, মাছের রেণু বা পোনা ও কেঁচো।  খাবারের উপর নির্ভর করে এরা একই জায়গায় দীর্ঘদিন থাকে। খাবার সংকট হলে জায়গা পরিবর্তন করে। এপ্রিল-জুলাই মাসে প্রজননকালে পুরুষ হাঁস ভারী ইস্পাতের ঘর্ষণের মতো নিচু স্বরে ডাকে। প্রজননকালে নিজ দেশে চলে যায়। সাইবেরিয়ায় পানির ধারে ঘাস, লতাপাত ও কোমল পালক দিয়ে নিজেরাই বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়ে হাঁস ৬-১০টি ডিম পাড়ে। ২৬ দিনে ডিম ফোটে। মেয়ে হাঁস পাখি ডিমে একাই তা দেয়।

নীলশির হাঁস বিশ্বে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের বণ্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত।

বাংলা নাম: নীলশির হাঁস বা বৈরাগি হাঁস।
ইংরেজি নাম: Mallard
বৈজ্ঞানিক নাম: Anas platyrhynchos (Linnaeus 1758)

ছবিগুলি সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড় থেকে তোলা।

0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ