সুজলা , সুফলা , শস্য-শ্যামলা আমাদের এই প্রিয় স্বদেশভূমি বাংলাদেশ , এর একটি ইউনিয়ন , নাম সাতনালা । এই সাতনালা ইউনিয়নের দুই প্রভাবশালী ব্যক্তি , নাম আবেদ আলী এবং শমসের ভুইয়া । চেয়ারম্যান হিসাবে একবার জয়ী হন আবেদ আলী , আরেকবার হন শমসের ভুইয়া । বংশানুক্রম এবং প্রভাব , এই দুই কারনে এখানে এই দু’জন ছাড়া আর কেউ নির্বাচিত হতে পারেননা । গত প্রায় ২৫/৩০ বছর ধরে এরকম-ই হচ্ছে । একজন ব্যক্তি পরপর দুইবার নির্বাচিত হয়েছেন এরকম হয়নি কখনও । চেয়ারম্যান থাকাকালীন সারাদেশে গতানুগতিক ইউপি চেয়ারম্যানদের কার্যক্রম যা হয় , ইনারা তার ব্যতিক্রম নন ।

দশটি গ্রাম নিয়ে বিশাল এই ইউনিয়নটি । শিক্ষিত , অশিক্ষিত অনেক মানুষের বাস এখানে । এখানে কিছু সচেতন ব্যক্তি আছেন , যারা গ্রামগুলির ভালো চান । অর্থাৎ এখানে চেয়ারম্যান , সদস্য , কেউ দুর্নীতি না করুক , সুষ্ঠুভাবে বিচারকাজ পরিচালিত হোক , সরকারী বরাদ্দ সঠিকভাবে নিয়ম-নীতি অনূযায়ী ব্যবহৃত হোক , দরিদ্র গ্রামবাসীগন কোনভাবে যাতে বঞ্চিত না হোন । কিন্তু দুই চেয়ারম্যানের কেউ-ই তা হতে দেননা । আগে লুট-পাট হত কম , কিন্তু যত দিন যাচ্ছে , টেস্টরিলিফ , কাবিটা প্রভৃতি নানারকম বরাদ্দের প্রায় পুরোটাই লোপাট হয়ে যাচ্ছে । সারা ইউনিয়নের সচেতন ব্যক্তিগন আলাদাভাবে মানূষজনের সাথে বিষয়গুলি নিয়ে কথা বলেন , কিন্তু কিছুই হয়না । সুবিধাবাদী গোছের অনেকে ভাগ পেয়ে চুপ করে যান ।

এসব সার্বিক বিষয়সমূহ নিয়ে আজ পঞ্চবটি জূনিয়র হাইস্কুলের একটি কামরায় মিটিং-এ বসবেন আজিজ নামের মাঝবয়সী এক ব্যক্তির নেতৃত্বে কিছু ব্যক্তি । জনাব আজিজ উপজেলা সদরের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন এবং তিনি দেশ-সমাজ নিয়ে সবসময় ভাবেন । কিছু মানূষ আছেন এই সমাজে , যারা চান অসুস্থ সকল প্রবনতা এ-সমাজ থেকে অপসারন হয়ে যাক ; প্রতিভাত হোক নতূন সূর্য , য্রে সুযের্র  আলোকে মুছে যাবে  সকল অন্যায় - অবিচার - অত্যাচার  । এ-ধরনের মানূষ হচ্ছেন আজিজ ।

মিটিং শুরু হয়েছে । আরও আছেন চামাগ্রাম গ্রামের দোকানদার মিজান , শিক্ষক মাঈনূল এবং আরো অনেকে । মাঈনূল বলেন , ভুতনাথ বিদ্যালয়ের মাঠভরাটের কাজ না করেই চেয়ারম্যান টাকা তুলে নিয়েছে । দরিদ্র ভ্যানচালক এবং ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র ইব্রাহীম বলে , লিচুতলা গ্রামে দেখলাম , চেয়ারম্যানের লোক ভিজিএফ কার্ড বরাদ্দ দিতে টাকা তুলছে । মিজান বলেন , আমাদের বাজারের পাশ দিয়ে যে খালটা গেছে , সেটার পাশে রিটেনিং ওয়াল দিতে ইঞ্জিনিয়ারকে ঘুষ দেয়ার নাম করে চেয়ারম্যানের লোক টাকা তুলেছে দোকানদারদের নিকট থেকে । আরো অনেক অভিযোগ মিটিং-এ উত্থাপিত হল । ধীর-স্থিরভাবে সব শোনার পর আজিজ বললেন , দেখেন অভিযোগেরতো কোন শেষ নাই ভাই । কিন্তু কথা হল , এসবের শেষ কেমন করে হবে , তা আমাদেরকে ভাবতে হবে । আমরা ভোট দেই , নির্বাচিত করি এবং এই দুইজন ব্যক্তির বদলে কাউকে নির্বাচিত করে আনতেওতো পারিনা অন্য কাউকে । তৃতীয় যে-ই দাঁড়ায় , তার-ই জামানত বাজেয়াপ্ত হয় ।

তাহলে আর কেন এই মিটিং ডাকা ? প্রশ্ন করেন একজন ।

আজিজ আবার শুরু করেন । আমার মতে সমাধান হচ্ছে , আমাদেরকে সংগঠিত হতে হবে এভাবে যে , চেয়ারম্যান যেই হোক , তাকে চাপে রাখতে হবে সকল সময় । এজন্য প্রতিটি গ্রামে আমাদের সংগঠন থাকতে হবে । প্রতিটি গ্রামে ১০ জন ব্যক্তি সহকারে হতে পারে এই কমিটি । তাতে শিক্ষক , মাদ্রাসা শিক্ষক , মসজিদের ইমাম , সচেতন বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন যুবক-যুবতী , ছাত্র-ছাত্রী সমন্বয়ে গঠিত হবে এই কমিটি । কমিটির কাজ হবে , যখন-ই চেয়ারম্যান-মেম্বারের কোন অপকর্ম দেখা যাবে , তখন-ই প্রতিবাদ করতে হবে ভালোভাবে এবং বিষয়টির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ-বিষয়ের আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটানো চলবেনা । আবার যখন অপকর্র্মের  সমাপ্তি ঘটবে , তখনই এই সংগঠনের কাজ শেষ হয়ে যাবে । মোট কথা , এই সংগঠনের রাজনৈতিক কোন উদ্দেশ্য থাকা চলবেনা অর্থাৎ চেয়ারম্যান / মেম্বার নির্বাচন করার অভিলাষ থাকা চলবেনা ।

ছাত্র ইব্রাহীম সচকিতভাবে জানতে চান , যেমন ?

ধরেন , চাল দেওয়া হচ্ছে গরীব মানূষজনকে । সেখানে আমাদেরকে যেতে হবে এবং নিরীক্ষা করতে হবে চাল কম দেয়া হচ্ছে কি-না । কম দেয়া হলে প্রতিবাদ করতে হবে ; তাতেও না হলে বাধ্য করতে হবে সঠিকভাবে দিতে ।

কিভাবে বাধ্য করবেন ?

প্রথমে সংগঠনের সদস্যগন বাধ্য করবে , তাতে না হলে যারা চাল নিচ্ছেন , তারাসহ বাধ্য করতে হবে ।

আর তাতেও না হলে ? ধরেন , চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে বিতরন হচ্ছে , তখন ?

দেখেন ভাইসব , চেয়ারম্যান , মেম্বারদেরকে ভয় করা আমাদের অভ্যাসে পরিনত হয়েছে , এটা বদলাতে হবে । হা , তারা শক্তিশালী , তবে তাদেরকে শক্তিশালী কিন্তু আমরাই বানিয়েছি । আমরা ভোট দিয়ে তাদেরকে জনপ্রতিনিধি বানিয়েছি , আমরা তাদেরকে সন্মান করি এবং করবোও । কিন্তু সেই শ্রদ্ধা , সন্মানের বদলে তারা যদি গরীবকে শোষন করে , তবে গরীবের উচিত প্রতিবাদী হয়ে ওঠা , প্রতিবাদ করতেই থাকা । এই বিষয়ে কোন ছাড় দিলে তারা গরীবকে আরো শোষন করবে । তাই , কথা হচ্ছে যে , কোন রকম ভয়-ভীতি না করে নিয়মমত চাল দিতে চেয়ারম্যানের সামনে হলেও তাকেও বাধ্য করতে হবে । চেয়ারম্যান বাধ্য না হলে আশ-পাশের স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের ডেকে আনতে হবে এবং এভাবে বাধ্য করার চরম পর্য্যায়ে নিয়ে যেতে হবে । আশা করা যায় , আর কিছু করতে হবেনা ।

মিটিং শুনে চলে এলাম স্যার ; বলে ঘরে ঢুকলেন বছর তিরিশ বয়সী যুবক সামাদ । সামাদ রাজশাহী ইনভার্সিটি থেকে অনার্স পাশ করে বেকার অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন বাড়ীতে । অবশ্য সম্পুর্ন বেকার নন তিনি । মৎস্য চাষের  কিছু কাজ করেন যৌথভাবে একটি পুকুর লিজ নিয়ে । সেখানেও সমস্যা । স্থানীয় মেম্বার অন্যায়ভাবে ভাগ চায় ; এজন্য ক্ষুব্ধ তিনি ।  একটুপর তিনি বললেন , আচ্ছা স্যার , পিআইও অফিসে খোজ নিয়ে জেনেছি , আমাদের ইউনিয়নে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক ক্লাব , যুবলীগ অফিস মেরামত , ঈদ্গাহ মাঠ উন্নয়ন , আমরা মুজিব সেনা ইত্যাদি  কিছু প্রতিষ্ঠানের  নামে গম / নগদ টাকা তুলে নেয়া হয়েছে । কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলির কোন অস্তিত্বই তো নাই । এটা কেমন হল ?  (চলবে)

0 Shares

৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ