খাঁ খাঁ রৌদ্রের দুপুরবেলা

তৌহিদুল ইসলাম ৬ আগস্ট ২০২০, বৃহস্পতিবার, ০৯:০৩:৫৯অপরাহ্ন গল্প ৩৫ মন্তব্য

নিশিকে বলেছিলাম আজ আসবো। কিন্তু গত তিন চারদিনের কাঠফাটা রোদে বেরোতে ইচ্ছে করছেনা। সে প্রতিদিন দুপুরে একবার করে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছে আজ আসছো তো? আমি বরাবরেই বলি হ্যা হ্যা, ঠিক বিকেলেই চলে আসবো কিন্তু ঐ বলা পর্যন্তই। যাওয়া আর হচ্ছেনা আমার।

নিশি যখন ছোট্টটি ছিলো তখন থেকেই তার শিশুসুলভ অঙ্গভঙ্গি দিয়ে আমাকে হাসানোর অন্তহীন প্রচেষ্টা চালু রেখেছে। কিছু বললেই ফিক করে হেসে ওঠে আর তার হাসিতে যে কেউ হাসতে বাধ্য। যেন আমাকে হাসানো তার একমাত্র কাজ। এ পৃথিবীতে তার জন্মই হয়েছে আমার মন ভালো রাখার জন্য।

অনেকগুলি কারনেই আসলে আমি নিশিদের বাসায় যাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। তার বাসায় একবার ঢুকলে এক দুপুর সময় না পেরোলে বের হওয়াই মুশকিল। প্রত্যেক সদস্য আমার সাথে যতক্ষণ আলাদাভাবে কথা শেষ করবেনা ততক্ষণ নিস্তার নেই। সে আমার যতই কাজ থাকুক কেউ কোন অজুহাত শুনতে নারাজ।

এড়িয়ে যাবার এই ব্যাপারটা কি করে যেন নিশি বুঝতে পেরেছে। আমি তাঁকে এড়িয়ে চলছি ঠিক তা নয় তবে মন সায় দিচ্ছেনা। নিশির মা'র চোখমুখের ভাষা ইদানীং আমার কাছে বড্ড রহস্যময় মনে হচ্ছে। কিসের যেন আহ্বান! নিশির দাদী আমাকে কি যেন বলতে চান। তাঁর ধারণা সে সংসারের ছায়া হিসেবে আমাকেই দেখতে চায় সবাই। হয়তো এই ব্যাপারটা তার গলায় এসে আঁটকে আছে, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছেননা।

ক্লাস থ্রীতে আমাদের নতুন স্কুলের প্রথমদিন যে ছেলেটি আমাকে চুইংগাম দিয়ে মেয়েদের চুলে জট লাগিয়ে জব্দ করা শিখিয়েছিলো সে রবিন, নিশির বাবা। এটা আশির দশকের কথা অথচ স্কুল জীবনে রবিনের সাথে আমার দুষ্টুমিমাখা সেসব স্মৃতি এখনো চোখে ঝলমল করে। রবিনের পরিবারের সবাই আমাকে তাদের একজন অঘোষিত সদস্য করে নিতে দ্বিধা করেনি। নিশি আমার পাশে যতক্ষণ থাকবে রবিনের এসব দুষ্টুমির কথা শোনাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে উঠলো।

আমি নিশির ফুফু সারিকাকে মনে মনে পছন্দ করতাম। কলেজ জীবনে যেদিন সারিকার চোখে কিশোরী উদ্দীপনা দেখেছিলাম তখন থেকেই। সারিকা বুঝতে পারতো কিন্তু আমার সাথে যখন যেখানে চোখাচোখি হতো আমি দৃষ্টি সংবরন করে নিতাম। বড্ড লাজুক স্বভাব আমার! এটা সারিকাকে আনন্দ দিত। তাদের বাসায় দুষ্টুমিষ্টি মজা করতে একটুও পিছপা হতোনা সে।

সারিকা আমার মনখাঁচা ছেড়ে উড়াল দিলো অন্য খাঁচায়। বিদায়ের দিন বরের গাড়িতে ওঠার আগে আমার দিকে ছলছল চোখে নির্বাক তাঁকিয়ে ছিলো। হয়তো আমাকে বলেছিলো গর্দভ! ভালোবাসার কথা বলে দিতে হয় সেটাতো বুঝিনি। সারিকা অন্য ঘরে চলে যাবে এ ভাবনা আমার মাথাতেই আসেনি।

সারিকার বিয়ের পরে আমি দেবদাস হয়ে ফেরারি আসামীর মত দিগ্বিদিক ঘুরে আবার থিতু হয়েছি সে রবিনেরই প্রচেষ্টার ফসল। ভাইয়ের মত দেখতো আমাকে। রবিনের বিয়েতেও কত মজা করেছি আমি। অথচ বিয়ের একবছরের মাথায় সবাইকে অকুলপাথারে রেখে সে চলে গেলো। স্পষ্ট মনে আছে জীবনের কাছে হেরে যাওয়া রবিনের সেদিনটাও ছিলো ভাদ্রের খাঁ খাঁ তপ্ত দুপুরবেলার সময়।

রবিনের বউকে আমি তার নাম ধরেই ডাকতাম। রবিনকে চিরনিদ্র‍্য শায়িত করে তাদের বাসায় আসতেই রবিনের মা আমাকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন এক দুপুর। সেই একদুপুর এখনো আমার পিছু ছাড়েনি। তপ্ত দুপুরবেলার ঘামে ভেজা চিটচিটে আঁঠালো জামার মত গায়ে সেপ্টে আছে। স্মৃতিময় কাঠফাটা রোদ্দুর!

রবিনের মৃত্যুর কিছুদিন পরে নিশির জন্ম হয়। জন্মের পর থেকেই সে আমাকে আব্বু বলে ডাকতো। কিন্তু একটু বড় হয়ে যখন রবিনের কথা জেনেছে তখন থেকে আর আব্বু বলেনা। তবে অন্য কিছু বলেও সম্বোধন করেনা। আমাকে শুধু তুমি বলে ডাকে। তুমি আসছো তো! তুমি যাবেতো! আমার ঐটা লাগবে, বাসায় পৌঁছে দিতে পারবেতো! এসবই তার সম্বোধনের বাহার! এদের মায়ার টানে আমি জীবনে থিতু হতে পারিনি। দূরে কোথাও বেশিদিন থাকতে পারিনা বলে ভালো চাকুরীও আমার কপালে জুটলোনা।

ইদানিং আমার খুব অভিমান হচ্ছে নিশির প্রতি। তার মা, দাদী, ফুফু সবার প্রতি। সবচেয়ে বেশী রবিনের প্রতি। রবিন তুই চলে গিয়েছিস আর আমাকে ছয় বছর ধরে একলা রেখে গিয়েছিস কাঠফাটা চৌচির এক মাঠের মাঝখানে। তুই ইচ্ছে করেই এমনটা করেছিস না রে? ছোটবেলায় করা খেলার মতন! প্রতিবার হেরে গিয়ে তুই আমাকে বড্ড জ্বালাতিস।

নিশি আবারো কল দিচ্ছে আমি ধরছিনা। আসলে কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা। এই প্রখর রৌদ্রদুপুরে রিংটোনের শব্দে বুকের ভিতরটা খাঁ খাঁ করে ওঠছে আমার। রবিনের দুষ্টুমির কথা শোনার জন্য অন্যপ্রান্তে নিশি অনবরত কল দিয়েই চলেছে।

0 Shares

৩৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ