অর্ধ শতাব্দীর ও বেশি সময় পার হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তার কবিতার রহস্যময়তা আজো কাটেনি; যতো বেশি রহস্যঘন হয়েছে তার অভিব্যক্তি ততোই মহিমান্বিত হয়েছেন; তিনি কবি জীবনানন্দ দাস। কবিতার লাইনের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে কবি মনের প্রতিচ্ছবি। কিভাবে তিনি তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে অনুভব করতেন অথবা পরিবেশের সাথে তার মিথষ্ক্রিয়া (Interaction) কেমন ছিলো তা ফুটে উঠেছে কবিতায়! এটা অনেকটা চরিত্র সৃষ্টি করে তার মাধ্যমেই কবির নিজস্ব অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রয়াস। চরিত্রগুলো কবির ইচ্ছা অনুযায়ী কথা বলে, আচরণ করে। কবিতায় উঠে আসে তার মনের গভীরতম অনুভূতি, আকাঙ্ক্ষা; যার খোঁজ হয়তো কবির সচেতন মনও রাখেনা। তাই কবির লেখাই হয়ে উঠে তার মনের আয়না।
মনের মানুষ কিংবা প্রেয়সী যাই বলা হোক না কেন, তাকে পাবার জন্য কবি অপেক্ষা করেছেন অনেক সময়। কুড়ি বছর পার হয়েছে, কখনো পঁচিশ বছর পার হয়েছে; অপেক্ষাকে মনে হয়েছে তার কাছে অন্তহীন! মিলনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও, শেষ পর্যন্ত অনেক কবিতায় মিলন হয়নি তার ভালোবাসার মানুষের সাথে। হতে পারে এটা কবির তীব্র মিলন আকাঙ্ক্ষা ও বারংবার প্রত্যাখ্যাত হওয়া থেকে আসা অন্তর্দ্বন্দ (conflict), যা কবির অচেতন মনে সংশয় তৈরী করেছিলো! আরেক ক্ষেত্রে অন্তর্দ্বন্দ কাজ করেছে, অনেক সময় সক্রিয় ভাবে আকাঙ্ক্ষা পূরণের চেষ্টা না করে মহাকালের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে শুধুই অপেক্ষা করেছেন। হয়তো প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়কে কাটানোর জন্য এটাই তার নিজস্ব ডিফেন্স হিসেবে কাজ করেছে। তিনি অপেক্ষা করেছেন আর তার চারিপাশকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। মানবীর প্রতি অনুভূতি ধীরে ধীরে প্রকৃতির প্রতি অনুরাগে পরিণত হয়েছে; একসময় তিনি প্রকৃতিকে মানবীর মতোই ভালোবেসে ফেলেছেন। তার কবিতায় বহুবার গভীর নিঃসঙ্গতার অসহনীয় কষ্ট তাকে আঁকড়ে ধরলে, তিনি বারবার প্রকৃতির কাছে ছুটে গিয়েছেন! কারণ প্রকৃতির কাছে প্রত্যাখ্যানের ভয় নেই। প্রকৃতির চাঁদ আর তারা, ইঁদুর- পেঁচারা, জ্যোৎস্নায় ধানক্ষেত, নক্ষত্রের বেগ, হলদে ঘাস, ভেজা শিশির, বৃক্ষ বারবার এসেছে তার কবিতার ছায়ায়। কবি ব্যক্তিজীবনে ছিলেন প্রচন্ড নিঃসঙ্গ এক মানুষ। তবু প্রত্যাশা নিয়ে পার করেছেন সময়, বলেছেন-“জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার-তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার!” কথিত আছে কবি প্রেমে পড়েছিলেন। কিন্তু সমাজ সংস্কারের জটিল হিসাবে তা তখন সম্ভবপর ছিলোনা। বলেছেন-“তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে; /তাহাদের হৃদয়ের বোন/ বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়”। কে জানে তার কথাই এখানে লিখেছেন কিনা!

জীবনানন্দ দাস ছিলেন অনেক বেশি চুপচাপ, অন্তর্মুখী ধরনের নিপাট ভদ্র মানুষ। তিনি অনেক লাজুক প্রকৃতির স্পর্শকাতর মানুষ ছিলেন আর নিজেকে নিজের ভিতর গুঁটিয়ে রাখতেই ভালোবাসতেন। কিন্ত চিন্তা ও কল্পনায় তিনি বিশ্বজনীন ছিলেন। তার লেখায় উঠে আসা বিশ্বজনীনতায় তিনি নিজেকে দেখেছেন ভেসে বেড়ানো এক নাবিক হিসেবে, যিনি কিনা কবিতার মধ্যে দিয়ে সমগ্র ইতিহাস ও পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করার ইচ্ছা পোষণ করেছেন। তাই তার কবিতায় বারবার ফিরে এসেছে “নাবিক” বিষয়ক কথা, বিদর্ভ নগর, বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগত।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে শিল্প সাহিত্যে জীবনানন্দের সমসাময়িক যুগ আন্দোলিত হয়েছিলো ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বকে কেন্দ্র করে। মূলত স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে আমাদের অবচেতন মনের যে প্রকাশ এবং যে মন আমাদের সচেতন যুক্তিবাদী মনের নিয়ন্ত্রণে থাকেনা, এই ব্যাপারটি তখনকার সাহিত্য জগতকে নাড়া দিয়েছিলো ব্যাপক ভাবে। চর্চা হচ্ছিলো সুরিয়ালিস্টিক সাহিত্যের। জীবনানন্দের কবিতা গুলোতে ফুটে উঠেছে এই ছাপ। তার লেখার গভীরে উঁকি দিলে খুঁজে পাওয়া যায়- বিংশ শতকের এক আধুনিক মননশীলতার মানুষকে যিনি অধিকাংশ সময় দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত ও উদ্বিগ্ন থাকতেন। প্রচন্ড রকমের স্পর্শকাতর ছিলেন তিনি। যদিও অন্তর্মুখী মানুষ হওয়ায় আশেপাশের মানুষ তার মনের আঁচ পেতোনা। কিন্তু জীবনের নানা ঘটনা,ঘাত প্রতিঘাতের প্রতি তার প্রতিক্রিয়ার দলিল হয়ে উঠেছিলো কবিতাগুলো। তিনি বাস্তবের ঘটনার মাঝে নিসর্গ ও প্রকৃতির বর্ণনা মিশিয়ে পরিচিত পৃথিবীকে এক রহস্যময় জগতে পরিণত করতে চেয়েছেন। তার অচেতন বা অবচেতন মনকে প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি ফ্রয়েডের তত্ত্ব দিয়ে প্রভাবিত হয়েছেন। কবিতার লাইনে লাইনে একটা স্বপ্নময় অবস্থা তৈরী করার জন্য অতীত-বর্তমান, জীবন-মৃত্যু, বাস্তব-কল্পনাকে মিশিয়েছেন বাধাহীন ভাবে। কারণ স্বপ্নে স্থান-কালের কোন নির্দিষ্ট নিয়ম থাকেনা আর স্বপ্নে নিজের অচেতন মনের ছবি পাওয়া যায়। বস্তুত এজন্যেই তার লাইনগুলো হয়ে উঠেছে “চিত্ররূপকল্পময়”। হয়তো তিনি তার চরম বিষন্নতা ও দুঃশ্চিন্তাকে কাটাতেই এরকম কল্পনার আশ্রয় নিতেন! “বনলতা সেন” কবিতায় তিনি লিখেছেন-
“আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন”
এইখানে আমরা এক “ক্লান্ত” মনের সন্ধান পাই, যে হাজার হাজার মাইল হেঁটে চলেছে শুধু একটু শান্তি ও স্থিরতার আশায়! অবশেষে কখনো তার দেখা পেলেও সেই শান্তি জীবনে স্থায়ী হয় না। দুদণ্ডের পরেই তা হারিয়ে যায় হয়তো! এই ক্লান্তি আর অশান্তির একটা মূল কারণ ছিলো হয়তো স্ত্রী লাবণ্যপ্রভা দাস এর সাথে কবির অসুখী বিবাহিত জীবন; যার মূলে ছিলো দুজনের ব্যক্তিত্বের সংঘাত। তার স্ত্রীর সাথে এই দূরত্ব কখনোই কমে নাই; কবি একসময় শান্তির আশা ছেড়ে দিয়েছেন। তার জীবনে শুধু একাকীত্ব ও বিষণ্ণতা ভর করেছে। তিনি হয়েছেন নির্জনতম কবি। এই একাকীত্ব ও নিরাশা থেকে তিনি পৃথিবীর অদ্ভুত ডায়নামোতে মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে ভেবেছেন। তার মনে হয়েছে মহীনের প্রস্তর যুগের ঘোড়াগুলি যেমন একটানা ঘাস খেয়ে চলে তেমনই মানুষের টিকে থাকা অনেকটা জৈবিক চাহিদা কেন্দ্রিক। “ঘোড়া” কবিতায় লিখেছেন-“মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জোছনার প্রান্তরে,/প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন--এখনও ঘাসের লোভে চরে”।

মনের মধ্যে জমা প্রবল দুঃশ্চিন্তা থেকে কল্পনায় এক সময় হতে অন্য সময়ে হতো ঘুড়ে বেড়াতেন তিনি। জীবনের চলমান অবস্থা নিয়ে চলা দুঃশ্চিন্তায়, তার লেখায় একই সাথে বর্তমানে থেকে বারবার অতীতের দিকে তাকিয়েছেন আর ভবিষ্যতের কথা ভেবেছেন। এটাই তার কাছে নিজস্ব বাস্তবতা (Reality)। বলেছেন মেসোপটেমিয়া, ব্যাবিলন, পিরামিড, আসিরীয় স্রমাজ্ঞী, আন্দালুসিয়ার অশ্বারোহীর কথা। বোধ হয় ঐতিহাসিক অতীতের কথা ভেবে নিজের ভবিষ্যতকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা কমাতে চেয়েছেন বারবার। বলেছেন -“আমারে দেখেছে সে যে আসীরীয় সম্রাটের বেশে/ প্রাসাদ-অলিন্দে যবে মহিমায় দাঁড়ায়েছি এসে-/ হাতে তার হাত”।

তার লেখায় বিষাদময় আবহের (Melancholia) ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। চারিপাশ থেকে পাওয়া গভীর দুঃখবোধ, সুপ্ত মনোকষ্টকে প্রকৃতির সাথে মিশিয়েছেন তিনি অসাধারণ কাব্যিক কৌশলে। তার কবিতায় বারবার ফিরে আসা “অন্ধকার, ধূসর, মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা” শব্দগুলো হয়তো তারই ইঙ্গিত দেয়। পাঠকের মনেও সঞ্চারিত হয় একধরনের মেলানকোলিয়া আর তার থেকে উঠে আসে দীর্ঘশ্বাস! “আট বছর আগের একদিন” কবিতায় লিখেছেন-“ এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি!/ রক্তফেনা মাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি/ আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার/ কোনদিন জাগিবেনা আর”। এটা হতে পারে তিনি এমন কারো আত্মহত্যা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছিলেন যে তার বিষণ্ণতার ভার আর নিতে পারছিলোনা। আবার এমনো হতে পারে তার মনের গভীরে বিষণ্ণতা ক্রমেই গাড় হচ্ছিল আর জন্ম দিচ্ছিলো মৃত্যু অথবা আত্মহত্যার চিন্তার! তিনি বলতে পেরেছিলেন-“শেষ ট্রাম মুছে গেছে, শেষ শব্দ, কলকাতা এখন জীবনের জগতের প্রকৃতির অন্তিম নিশীথ”। অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক ও অন্তর্মুখী এই মানুষটি তার লালিত বিষণ্ণতাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন নিজের ভিতরে। ১৯৫৪ সালের ১৪ই অক্টোবর কবি যেদিন ট্রাম দুর্ঘটনায় পড়লেন, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত এই প্রশ্নের সমাধান হয় নাই যে, ট্রামের মতো ধীর-গতি সম্পন্ন যান দুর্ঘটনাতেও মানুষের মৃত্যু হয়? হয়তো হয়; জীবনানন্দ তার প্রমাণ!

কৃতজ্ঞতাঃ বিভিন্ন সময়ে পড়া অনেক বই ও প্রবন্ধ, যাদের নাম ও উদ্ধৃতি এখন মনে নেই! এবং ছবি কৃতজ্ঞতা ইন্টারনেট।

(লেখাটি আগে একবার প্রকাশিত হয়েছিল অন্যখানে*)

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ