কল্প-গল্পঃ ট্র্যাপড ইন দ্যা কোড

অলিভার ২১ ডিসেম্বর ২০১৪, রবিবার, ০৫:০৬:০২অপরাহ্ন গল্প ১১ মন্তব্য

 

ইমন রায়হান ইউনিভার্সিটির পার্ট চুকিয়ে প্রতিষ্ঠিত একটা ডেভেলপার কোম্পানিতে ইন্টার্ন হিসেবে যুক্ত হয়, পরে মাস কয়েক বাদে নিয়মিত প্রোগ্রামার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় তাকে। কোম্পানিটি একটি প্রতিষ্ঠিত গেম মেকিং কোম্পানি। ইতোমধ্যে তাদের নিজস্ব কনসোল এর কয়েকটি ভার্সন বাজারে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় এইবার আরও আকর্ষণীয় ফিচার সমৃদ্ধ এবং আরও বাস্তবিক অনুভূতি দেবার লক্ষ্য নিয়ে নতুন কনসোল এবং গেম ডেভেলপের জন্যে সিদ্ধান্ত নেয়। ইমন সেই ডেভেলপার গ্রুপের একজন। তার কাজ ছিল প্রোফাইলিং তৈরি করা। গেমের বিভিন্ন প্রোফাইল এবং তাদের ক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতা তৈরি করাই ছিল আসল কাজ। কাজটা খুব সহজ মনে হলেও এতটা সহজ নয়। প্রতিটা ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রতিটা চরিত্রকে তার নিজস্ব ক্ষমতা, চাল চলন, আচার-ভঙ্গিমা, আর্টিফিশিয়াল বুদ্ধিমত্তা আর এর সবকিছুর উপর সীমাবদ্ধতা দিতে হবে। কোনটা যেন আবার কোনটার থেকে পিছিয়ে না থাকে কিংবা একই ধরনের কয়েকটা ক্যারেকটারের মধ্যে যাতে ভিন্নতা থাকে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয় প্রতিনিয়ত।

মোটামুটি কাজ ভালোই চলছিল। কাজের ফাঁকে গ্রুপ মিলে জম্পেশ আড্ডা, শিডিউল ছাড়াই হুট করে সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া, পিকনিক-পার্টি এই সবই নিয়মিত চলছিল। এরই মাঝে ঘনিষ্ঠতা হয় গেম ইঞ্জিন ডেভেলপার ইরণের সাথে। ইরন বয়সে ইমন থেকে কিছুটা জুনিয়র হলেও কাজে এবং দুষ্টামিতে খুবই পটু কিন্তু একটু চাপা স্বভাবের। এই কারণেই ইরনের বিশেষ কোন বন্ধু নেই। তার সাথে যারা কাজ করে তারাও পারতপক্ষে ইরনকে এড়িয়ে চলে। প্রায় পার্টিতে কিংবা পিকনিকে ইরণ এক কোনায় চুপটি মেরে বসে থাকে, বাকি সবাই অন্যদিকে যার যার মত আনন্দে ব্যস্ত। ব্যাপারটা প্রথম কয়েকদিন নজরে না আসলেও পরে বেশ ভালোভাবেই নজরে পড়ে ইমনের। সরাসরি কিছু না বলে একটু খোঁজ খবর নিয়ে তারপর একদিন এক পিকনিকে তার সাথে গিয়ে বসে কিছু সময় কাটায়, হালকা টুকিটাকি কিছু কথাও হয়। এইভাবেই তাদের বন্ধুত্বের শুরু হয়। এরপর কাজের সময়টা বাদ দিয়ে প্রায় সবসময়ই একত্রে দেখা যায় তাদের। কাজ এবং থাকার সুবিধার জন্যে দু'জনে মিলে একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া নেয় অল্প কিছুদিন পরে।

শুধু বাইরের আলাপ আলোচনাই নয় কাজের অনেক আলাপও চলতো সমান তালে। কিভাবে এবারের গেম ইঞ্জিনটা ডেভেলপ করা হচ্ছে আর কোন কোন নতুন পর্যায়ে এইটাকে ব্যবহার করা সম্ভব আর প্লেয়ার গুলির প্রোফাইলিং এই ইঞ্জিনের সাথে কতটুকু যায় কিংবা আরও কত বিস্তৃত করা যায় এই নিয়েও ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা চলতো। এবং আলোচনা থেকে বেশ অনেক জিনিস উঠে এসেছিল তাদের কাজে। ফলাফল, শেষ কাজটা আগের সবগুলি কাজের থেকেও বেশি সুনাম অর্জন করে এবং আর্থিক ভাবে কোম্পানি তাদের লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৩ গুন লাভ করে। যদিও এটা তাদের একার সফলতা নয়, তারপরও সবাই বুঝতে পারে এই একত্রে কাজ করার ফলাফল স্বরূপ তাদের এই প্রাপ্তি।

এর পরের প্রজেক্টে নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাদের প্রোজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে পদন্নোতি দেয়া হয়। এবার দায়িত্বের সাথে সাথে স্বাধীনতাটাও অনেক বেশি চলে আসে তাদের হাতে। নিজেদের মত রুলস তৈরি করা আর গেমিং ইঞ্জিনকে সেই রুলস অনুসারে ডেভেলপ করা তাদের নেশায় পরিণত হয়। সমান তালে কাজ এবং নেশা মিটিয়ে চলছিল তারা। পরপর কয়েকটা কনসোল ভার্সন এবং গেইম তাদের দ্বারা তৈরি হয় আর কোম্পানি তাতে সুনাম এবং ব্যবসায়িক ভাবে ঈর্ষনীয় অবস্থানে উঠে আসে। ধাপে ধাপে আরও বড় হয় তাদের কাজে পরিসর।

একদিন কথায় কথায় ইরণ জানায় সে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের একটা গেমিং ইঞ্জিন তৈরি করতে চায়। এমন একটা ইঞ্জিন যাকে আসলে এইসব রুলস দিয়ে ঘিরে রাখা সম্ভব নয়। ইমন পুরোপুরি তখনও তার কথাটা বুঝতে পারে নি। হয়তো নতুন প্লান মনে করে শুনছিল কেবল। কিন্তু কদিন বাদে যখন সত্যি সত্যি তাকে নতুন প্রোজেক্টের জন্যে ক্যারেক্টার তৈরির অনুরোধ করে বসে ইরণ তখন বুঝতে পারে সে আসলে হেলাফেলা করছিল না, হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিরিয়াস ছিল ঐ ব্যাপারে। এইবার ইমন ইরণের কাছে ডিটেইলস জানতে চাইলো, বোঝার চেষ্টা করলো ঠিক ধরণের ইঞ্জিন সে তৈরি করতে যাচ্ছে। উত্তরে ইরণ যা বলল তাতে অন্য কেউ হরে স্রেফ তাকে 'পাগল' বলে আখ্যা দিতো।

এটাও কি সম্ভব! শতভাগ রিয়েলিটির মত একটা ইঞ্জিন তৈরি করা কি আদৌ কোন প্রোগামিং এর কাজ?!? কিন্তু কোন কথাই শুনতে রাজী নয় ইরণ। তার কথা আমাদের স্পেস যেমন সকল ফিজিক্সের সূত্র আর কেমিস্ট্রির বিক্রিয়ার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে ঠিক একই রকম ভাবে এই ধরাবাঁধা সূত্রগুলি বসিয়ে এবারের ইঞ্জিন তৈরি করে চায় সে। আর যেহেতু ইঞ্জিনটা তাদের ক্লাউড স্টেশনে থাকবে তাই প্লেয়ার নিজের মতন নিজেকে প্রোফাইলিং করে তারপর এই ইঞ্জিনে অংশগ্রহণ করবে।

ইমন এইবার আসলে একটু বেশি পরিমাণে ধাক্কা খেল। সাধারণত যারা গেম খেলে তারা সবাই আক্রমণাত্মক ভাব নিয়েই তাদের প্রোফাইলিং করে, কিংবা বেশ ক্ষেত্রের প্রয়োজনে বেশ পারদর্শী চরিত্র নিয়েই সবাই খেলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। যদি একটা পৃথিবীর সবাই পারফেক্ট এবং একই মানের একই কাজের উপযুক্ত হয় সেখানে পুরো বিষয়টার কোন পয়েন্ট থাকে না। ব্যাপারটা ইরণকে বলতেই সে হেসে উঠলো। উত্তরে বলল-
- তুমি এখনো আমার প্লানটা বুঝতে পারো নি ইমন। আমি একটা নতুন পৃথিবীর কথা বলছি। পৃথিবী, যেখানে শুরু থেকেই নিজের পছন্দমত প্রোফাইলিং করা যাবে কিন্তু সে শুরুতেই সব পেয়ে যাবে না। ধীরে ধীরে তাকে সব দক্ষতা অর্জন করতে হবে। তাদের গল্পের শুরুটাও আমাদের মতই হবে। ধীরে ধীরে নিজেদের ম্যানুপুলেশন করে তাদের সংখ্যা বাড়বে। চাইলেই হাজার হাজার গেমার হুট করে এন্ট্রি নিতে পারবে না। তাদের অপেক্ষা করতে হবে এই গেমসটাতে অংশগ্রহণ করার জন্যে।

পুরো আকাশটা ভেঙ্গে পড়লেও ইমনের কাছে এই মুহূর্তে সেটা বিস্ময়ের কারণ হতো না যতটা না এখন এই মুহূর্তে হচ্ছে। নিশ্চিত ইরণ পাগল হয়ে গেছে, নয়তো সে তার সাধারণ চিন্তাশক্তি হারিয়েছে। ইমন তাকে এই কথাটাই সরাসরি বলল। কিন্তু কথা শুনে ইরণ ক্ষেপে গেলো না, দমেও গেলো না। সে শুধু বলল, সে তার মত কাজ শুরু করে দিয়েছে যদি তাকে বন্ধু হিসেবে সহায়তা করতে চায় তো ভালো। না হয় নিজেই পুরোটা গুছিয়ে নিবে।

হাজার উদ্ভট হোক, বন্ধুকে তো আর মানা করতে পারে না। আর এতদিন ধরে যেই চমৎকার কাজ গুলি তারা করে এসেছে তার বিপরীতে এখন তো কোনভাবেই পিছপা হওয়া সম্ভব না। তাই শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছার ইচ্ছাতেই কাজে নেমে পড়ল ইমন। শুরুতে বেশ ঝামেলা মনে হলেও আসলে কাজটা ততটা ঝামেলার নয়, সেটা আস্তে আস্তে বুঝতে পারলো। যখন মোটামুটি একটা পর্যায়ে নিয়েই এসে পড়েছিল তখন আসল বোমটা ফাটাল ইরণ। বিশাল এক পরিবর্তন করতে হবে প্রোফাইলিং এ। ব্যবহারকারী কেবল ইচ্ছে করলেই সব ধরণের বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারবে না, তাদেরও বাস্তবতার মত পরিবার থেকে কিছু প্রোফাইল নিয়ে আসতে হবে কিংবা পারিবারিক কমন কিছু বৈশিষ্ট্য এমনিতেই যুক্ত হবে নতুন প্রোফাইল গুলিতে। আর অবশ্যই তাদের পরিবার হিসেবে কিংবা পরিবারের সদস্য হিসেবে এই গেমটাতে আসতে হবে। নয়তো হুট করে প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরের মত তারাও এন্ট্রি পাবে না এই ভার্চুয়াল দুনিয়ায়।

এবার আর মেজাজ ধরে রাখতে পারল না ইমন, ইচ্ছা মত ঝাড়ল ইরণকে। এটাই যদি করার হতো তাহলে কাজ গুছিয়ে আনার আগেও বলা সম্ভব ছিল। কিন্তু তখন ইরণ টু শব্দটাও করেনি, আর যখন করছে তখন ইমনের কাজের প্রায় ৯০ ভাগ সম্পন্ন। এখন তার এই নতুন শর্ত প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে আবার গোঁড়া থেকে সব সাজাতে হবে। একরকম ঝগড়া-বাগড়া করেই বেরিয়ে এলো। ওদিকে প্রায় বছর কয়েক দেশে যাওয়া হয়না ইমনের। এইটা বাদে মেজর কোন কাজও নেই। রিফ্রেশমেন্টের জন্যে দেশে যাবার প্লান করলো সে। মনে মনে ভাবল তাকে ছাড়া যখন পুরো প্রজেক্টের কাজ ইরণের করতে হবে তখন সে নিশ্চই বুঝতে পারবে কত বড় পাগলামো করছিল সে। মনে মনে আরও আশা করল যে, দেশে থেকে ঘুরে এসে দেখবে এইসব পাগলামি ঝেড়ে বাদ দিয়ে নতুন কনসোল ডেভেলপ করার প্লানিং করছে ইরণ। যদিও খুব ভালো করে জানে এইসব কিছুই করবে না এই চুপচাপ থাকা উদ্ভট ছেলেটা। উল্টো হয় তাকে ফোন করে করে, কনফারেন্স আর লাইভ ভিডিও চ্যাট করে জ্বালাবে নয়তো আরও জটিল কিছু পাকাবে এই ক'দিনে। তবুও ইমন আর অপেক্ষা করল না, ২ দিন বাদেই দেশে যাবার টিকিট কনফার্ম করে প্লেনে চড়ে বসল।

দেশে ফিরার সপ্তাহ ২ পরও যখন ইরণ তাকে নক করলো না তখন মোটামুটি নিশ্চিত হল যে ইরণ এই প্রোজেক্ট বাদ দিয়েছে, আর চাপা স্বভাবের কারণে এটা স্বীকার করছে না। তাই ২ সপ্তাহ পর ইমনই তাকে ফোন দিল। ইরণ ফোন রিসিভ করলো ঠিকই কিন্তু তাকে যেন ঠিক চিনতে পারলো না। বেশ কয়েকবার করে নাম বলার পর ইরণের মনে পড়ল কে এই ইমন। ব্যাপারটা ইমনকে কষ্ট দিলেও ইরণের খামখেয়ালিপনার জন্যে মনে রাখল না। খোজ খবর নেবার এক পর্যায়ে ইমনই জানতে চাইলো তার প্রজেক্ট সম্বন্ধে। ইরণ কিছু একটা লুকানোর মত করে বলল, "এখনো চেষ্টা করছি। তবে ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না।" শেষ লাইনটায় ইরণের হতাশা আর অনিশ্চয়তা কিছুটা ধরা পড়ল। তারপর সংক্ষিপ্ত কথা শেষ করে ইরণকে নিজের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে ফোন রাখল ইমন।

দেশে এসে প্রায় অনেকটা সময় নষ্ট করল। তবে এটাকে ঠিক নষ্ট বলা যাবে না, পরিবার থেকে এতদিন দূরে থাকার পর এই সময়টুকুও অল্পই মনে হয়েছে তার নিজের। সবাই মিলে এইখানে ঐখানে ঘুরাঘুরি, আত্মীয়দের বাসায় গিয়ে দেখা করে আসা, বেশ কিছু পর্যটন স্থানে পরিবার সহ ঘুরে আসার মত আরও অনেক কাজে দেখতে দেখতে সময়টা ফুরিয়ে এলো। ওদিকে নতুন কনসোল সম্বন্ধে ব্রিফিং করার সময় এগিয়ে এসেছে, তাই চাইলেও আর থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। চলেই আসতে হল অবশেষে। কিন্তু এসেই এত বড় শকড হবে তার ধারণা মাত্র ছিল না।

ইরণ একজন কলিগকে খুন করে তারপর আত্মহত্যা করেছে!!!

এটাও কি সম্ভব! সে কারও সাথে মিশত না, তেমন কারও সাথে যোগাযোগও নেই তার তাহলে হুট করেই কিভাবে সে এই কাজ করতে পারে। তার চেয়েও বড় ব্যাপার, ইরণ কখনোই এমন আক্রমণাত্মক ছিল না। মারামারি, খুন, রাহাজানি এইসব খবর পর্যন্ত এড়িয়ে চলত। তাহলে এইটা কি করে সম্ভব হয়‍!!!

এর উত্তর অজানাই থেকে যায়। ফরেনসিক এবং পুলিশ বিভাগ তেমন কোন তথ্য কিংবা মোটিভেশন এর পেছনে দিতে পারে নি। শুধু জানিয়েছে দিন কয়েক ইমি নামের মেয়েটার সাথে দেখা গেছে তাকে। তারপর কোন কারণে তাদের সেই ভাড়া নেয়া ফ্লাটে দুজনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। "ইরিনা ইমি" বেশ বড় ধরণের ইলেকট্রিক শক পাওয়ার কারণে মারা যায়। ঠিক একই পরিমাণ শক ইরণও গ্রহণ করে বলে রিপোর্টে ধরা পড়ে। কিন্তু তারপরও মারা যায় নি। বরঞ্চ তার থেকে আরও ২ দিন পর সিলিং এ ঝুলে আত্মহত্যা করে।

কোন কারণ নেই, তারপরও ইমন নিজেকে দোষারোপ করতে থাকে এই ঘটনার জন্যে। সে ঐ সময়টাতে দেশে না গেলে, ইরণের ঐ উদ্ভট প্রজেক্টের সাথে থাকলে হয়তো এই সব কিছুই হতো না। কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তেমন কিছুই আর করার নেই। কোম্পানির কাজের মধ্যে নিজেকে পুরোপুরি ডুবিয়ে দিলো। কিন্তু ধারাবাহিক ফলাফলের মত এইবারের কনসোল তেমন আকর্ষণীয় হল না। ব্যবসায়িক ভাবে তেমন ক্ষতি না হলেও প্রকৃত অর্থে যেই পরিমাণ লাভ আশা করেছিল তার ধারের কাছেও এবার যেতে পারেনি।

এরপর নিজেকে বেশ গুটিয়ে নিয়ে আসে ইমন। কাজে ইস্তফা দিয়ে নিজের এপার্টমেন্টেই শুধু সময় কাটাতে লাগল। সে ইরণের কাজগুলিকে দেখতে শুরু করলো। একেবারে শুরু থেকে প্রজেক্টের কাজ দেখে যেতে লাগল। আগে তেমন খেয়াল না করলেও পরে খেয়াল করলো ইরণ তার প্রোজেক্ট বন্ধ করেনি। তাদের নিজস্ব ক্লাউড কম্পিউটিং এ ফাইল গুলি এখনো সচল। শুধু সচলই নয় কিছু একটা আলাদা প্যাটার্ন নিজেই নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু ঠিক কি এইভাবে নিজেকে বার বার সামনে নিয়ে আসছে, কেনই বা প্রায়োরিটি বার বার পরিবর্তন হচ্ছে তার সঠিক কোন ফ্লো সে দেখতে পারছে না।

সপ্তা কয়েক বাদে জিনিসটা নজরে আসে ইমনের। তার প্রোফাইলিং সিস্টেম এখানে এড করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেখানে অনেক বড় ধরনের একটা পরিবর্তন আছে। আর পরিবর্তন টুকু করেছে ইমি নামের মেয়েটি, যে কিনা তার দলেই প্রোফাইলিং এর কাজ করত। এবার ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় ইমনের কাছে। ইরণ আসলে প্রোজেক্ট কখনোই বাদ দেয়নি। সেদিনের সেই হতাশাটা কৃত্রিম ছিল, কারণ তার কাজ সে এরই মাঝে অন্য একজনকে বুঝিয়ে দিয়েছে। আর যাকে বুঝিয়েছে সেই মেয়েটার অবস্থান ঠিক তার পরেই ঐ কোম্পানিতে। নতুন করে মেয়েটা এক ধরণের প্রোফাইলিং করেছে, যেটাকে আধুনিক পরিবার এবং আধুনিক প্রসূতি ব্যবস্থা হিসেবেই চিহ্নিত করা যায় খুব সহজেই। এখানেও মানুষের মৌলিক চাহিদা এবং ধারণার মত দুজন প্যারেন্ট প্রোফাইল থেকে একজন চাইল্ড প্রোফাইল তৈরি হবে। আর সেই চাইল্ড প্রোফাইল একই সাথে দুই প্যারেন্ট প্রোফাইল থেকে যেমন বৈশিষ্ট্য অর্জন করবে, ঠিক তেমনি ইউজারের চাহিদা মত বৈশিষ্ট্য যুক্ত হতে থাকবে সাথে সাথে।

বলা যায় একটা সম্পূর্ণ পৃথিবী তৈরি করে ফেলেছিল ইরণ। এবার শুধু একে লাইভ ইভেন্ট আকারে কিছু ঘটনা কিংবা স্ক্রিপ্টের ভেতর দিয়ে চালিয়ে দেখার বাকি। যখন ইমন এই সব কাজ দেখে উত্তেজনায় কাঁপছিল ঠিক তখনই ভিজুয়াল ইমেজে ইরণের উপস্থিতি হয় ঘরটার মধ্যে। এটা একটা ত্রিমাত্রিক ব্যবস্থা যা তারা কনফারেন্স করার সময় ব্যবহার করতো। যদিও অফিসিয়াল সুবিধার মধ্যে এটা একটা, তবুও ব্যক্তিগত ব্যবহারের অনুমতি কেবল ইমন আর ইরণ পেয়েছিল সি.ই.ও'র পরে।

ত্রিমাত্রিক ইরণ বলতে থাকলো-

ইমন আমি দুঃখিত। কারণ আমি তোমার অনুমতি ছাড়াই তোমার কাজটি ইমিকে দিয়ে দিয়েছি। এবং যখন তুমি এই মেসেজটি দেখছ, তখন আমি আর সরাসরি তোমার কাছে ক্ষমা চাইবার অবস্থায় নেই।

ইমন আমি জানতাম তুমি এই পর্যন্ত এসে একে লাইভ করার চেষ্টা করবে। কিন্তু ভুলেও এই কাজটি করতে যাবে না। কারণ ইতোমধ্যে আমি একটা সিম্যুলেশন চালিয়েছি। তুমি আমার এই থ্রিডির ঠিক নিচের ফ্লোরের কার্পেট এবং টাইলস সরালেই সেটির পরিণাম দেখতে পাবে।

তুমি শুরু থেকেই বলে আসছিলে এটা অত্যন্ত উদ্ভট একটা প্রজেক্ট। এবং অনেক ভাবেই আমাকে নিরুৎসাহিত করেছিলে। কিন্তু আমি তখন একটা মোহে আটকে গিয়েছিলাম। বলতে পারও এটা আমার ছোটবেলার স্বপ্নের একটা অংশ বিশেষ। যখন আমি আমার বাবা-মা'কে একসাথে একটা এক্সিডেন্টের মধ্যে হারিয়ে ফেলি ঠিক তখনই এই ইচ্ছাটা আমার মনে আসে। যেখানে আমরা প্রাকৃতিক নিয়মে বড় তো হবো ঠিকই, কিন্তু অসময়ে কেউ হারিয়ে যাবো না।

কিন্তু আমার ধারণায় এটা কখনোই আসে নি যে প্রকৃতিকে আর যাই হোক হাজার কোটি লজিকে একে মোড়ানো সম্ভব না। আমি যেহেতু এটাকে লাইভ সিম্যুলেশন করতে চেয়েছিলাম তাই সরাসরি আমাদের মস্তিষ্কের নিউরন সিগন্যাল এবং তাতে সংরক্ষিত তথ্য চাচ্ছিলাম। আমি চাইছিলাম ইমি আমাকে সহায়তা করবে এই কাজে। সব ঠিক ঠাক চললেও ইমি তার মস্তিষ্ক এবং নিউরন শেয়ার করতে রাজী হচ্ছিল না। শেষে একরকম মরিয়া হয়েই তার ইচ্ছার বিপরীতে আমি তার মস্তিষ্ক স্ক্যান করি। তার প্রতিটা সিগনাল আমি ক্যাচ করতে সক্ষম হই ৩ দিন সময় ব্যয় করে। একই সাথে নিজের মস্তিষ্কের স্ক্যান কপি তৈরি করি।

কিন্তু কিছু একটা গোলমেলে হয়ে যায় সেখানেই। ইমির স্ক্যান শেষে প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রবাহ হতে থাকে তার মস্তিষ্কে। যেন শেষ পর্যায়ে এসে সে তার ডাটা গুলি দিতে অসম্মতি জানাচ্ছিল। কেউ অবচেতন অবস্থায়ও এতটা শক্তিশালী হয় সেটা তুমি নিজে না দেখলে কখনো বিশ্বাস করতে পারবে না ইমন। শেষ অবধি আমাকে আরও বৈদ্যুতিক প্রবাহ বাড়াতেই হল বাধ্য হয়ে। সাক্ষাত শয়তান হয়ে গিয়েছিলাম আমি। একবারও মেয়েটার জন্যে মায়া লাগেনি আমার, অথচ আমি জানতাম আর ৫ভোল্ট বাড়ালেই মেয়েটা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। যাই হোক ইমিকে শেষ পর্যন্ত পুড়ে যেতে হয়নি। তবে মেয়েটা একদম শান্ত হয়ে গেলো নিমিষেই।

তুমি বিশ্বাস কর আমি চেষ্টা করেছিলাম। আমি চেয়েছিলাম যাতে কোন ক্ষতি না হয় মেয়েটার। কিন্তু মেয়েটার জেদের কারণে আমাকে এমন পিশাচের মত হতে হয়েছে। তখনও আমার ভেতর কোন অনুতপ্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। বিশ্বাস কর, নিজের হাতে সুইচ টিপে মানুষ হত্যা করলাম কিন্তু সেটাকে কোন অপরাধই মনে হচ্ছিল না। কারণ আমি তাকে ঠিকই বাঁচিয়ে রেখেছি।

হ্যাঁ, আমার প্রোগ্রামে এখন ইমি আর আমি বন্দী অবস্থায় আছি। তুমি খুব ভালো করে খেয়াল করবে দুইটি ফাইল বার বার করে নিজেদের প্রায়োরিটি পরিবর্তন করছে। কিন্তু কেন, কিভাবে এইসবের কোন উত্তর, কোন লজিক নেই।

যাই হোক, এবার সিমুলেশনের কথায় আসি। আমার উন্নতমানের যেই পোর্টেবল সুপার কম্পিউটারটাতে এক্সেস ছিল সেটাতে এই প্রোগ্রামটা হোস্ট করি। আমি জানি এটা নিরাপদ, কারণ এটার সাথে বাইরের নেটওয়ার্কের কোন রকম সংযোগ নেই। প্রায় ১ দিন প্রোগ্রামটা রান করার পর ব্যাপারটা নজরে আসে। তোমার কথাই সত্যি, এই পুরো প্রজেক্ট পয়েন্ট লেস। যেখানে কোন চাহিদা নেই সেখানে এই ধরণের পৃথিবীর কোন প্রয়োজনই নেই। আমি এত পরিমাণ মল, কমপ্লেক্স আর এত পরিমাণ সুসজ্জিত লোভনীয় জিনিস সেখানে দিয়ে রেখেছিলাম যে তুমি আমাদের দেশের প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত এই ধরণের জিনিস বাস্তবে পেলে লাফিয়ে উঠবে।

কিন্তু ঘটনা তার সম্পূর্ণ বিপরীত কিছু হয়েছে। বেশ অনেকটা সময় ঘোরাঘুরির পর ইমি আর আমি দুজনেই দুটি এমুনেশন শপে যাই। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় এমুনেশন নিয়ে পুরো এলাকা তা ছড়িয়ে দেই। যেহেতু সর্বোচ্চ ক্ষমতা রয়েছে তাই নিউক্লিয়ার ব্যবহারেও তাদের কোন মানা ছিল না, আর আমিও কোন বাধা দেই নি।

দেখতে দেখতে ২৪ ঘণ্টা শেষ হবার আগেই তারা পুরো ভার্চুয়াল পৃথিবীটা ধ্বংস করে দেয়। তবে তার আগে ইমি আমাকে সেখানে খুন করে। কিংবা বলতে পারো খুন করার চেষ্টা করে। কারণ সেখানে তো এক্সিডেন্টলি কেউ মারা যেতে পারে না। তাই ইমির আঘাতে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি ঠিই, কিন্তু মারা যেতে পারি নি।

হ্যাঁ, এখন যেই ফাইল দুইটির তুমি বার বার প্রায়োরিটি পরিবর্তন হতে দেখছ সেই দুইটিই আসলে আমাদের প্রোফাইল। আমার করা পুরো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও আমাদের কোন পরিবর্তন হয়নি। আমরা এতে আটকে গেছি। আর এখান থেকে সরাসরি মুক্তি দেবার কোন পদ্ধতিও নেই। আমাদের মস্তিষ্কের সাধারণ সিগন্যাল থেকে প্রাপ্ত ডেটা এনালাইসিস করে যখন আমাদের সকল নিউরনের মৃত্যু ঘটবে বলে উপাত্ত দিয়েছে, ঠিক সেই সময় পরেই আমাদের আক্ষরিক অর্থে মৃত্যু কিংবা প্রোগ্রাম টার্মিনেট হবে। এর আগে কখনোই এটা করা সম্ভব নয়।

এরপর যেমন করে হুট করে মেসেজ শুরু হয়েছিল তেমনি হুট করেই মেসেজের সমাপ্তি। ইমন পুরাই বোকা বনে গেলো এই মেসেজ শুনে। তারপর সত্যি সত্যি পোর্টেবল সুপার কম্পিউটারের এক্সেস দেখতে শুরু করলো। সত্যিই সেখানে কিছু নেই তবুও বেশ সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন লক্ষণীয়। আর এই পরিবর্তনটাও প্রোগ্রামের পরিবর্তনের মতই ঘটছে।

পুরো দুই ঘণ্টা মাথায় হাত চেপে বসে রইলো ইমন। কারণ এতক্ষণে আসল ক্ষতিটা হয়েই গেছে। সে আসার পর ঐ সার্ভারে নতুন গেম আপলোড করা হয়েছিল। এবং গেমের সফল টেস্টিং শেষে ঐ ডাটা নিয়ে মূল গেম সার্ভারে আপলোড করা হয়েছে। আর মূল গেম সার্ভারই মূলত এই গেমের ডিস্ট্রিবিউশন, পয়েন্ট সংরক্ষণ, অনলাইন গেমার প্রোফাইল আপডেট এবং তাতে পূর্ণ পরিবর্তন করতে সক্ষম। আর এখানে যদি ইরণের সেই প্রোফাইল দু'টি চলে গিয়ে থাকে তাহলে এই মুহূর্তে আর কিছুই করার নেই তার। কারণ প্রতিটা গেম কনসোলে এই প্রোগ্রাম কপি হয়েছে। প্রতিটা অনলাইন স্টোরে এই গেমের কপি সংরক্ষণ হয়েছে এবং তাদের এনক্রিপশন অনুযায়ী এগুলি সিকিউরডও করেছে নিজেদের।

ঠিক এই ভয়টা মনে নিয়ে যখন তাদের মেইন সার্ভার চেক করতে বসল ফলাফলটা ঠিক তাকে গালে চাপড় দিল। তার ধারণাই সত্যি। অন্তত আগামী ৩০ বছর এই প্রোগ্রাম দুনিয়ার প্রতিটি নেট কানেক্টেড সার্ভার, পিসি, মোবাইল এমনকি কনসোলে সংরক্ষিত থাকবে। পুরো হার্ড ড্রাইভ মুছে দিয়েও একে কিছুই করা সম্ভব হবে না। আর পুরো পৃথিবীর ব্যাকআপ পাওয়ার কখনোই অকেজো হবে বলে মনে হয় না। অন্তত হলেও মোবাইল আর কনসোল মেমরিতে এই দুটি ভার্চুয়াল স্বত্বা বেঁচে থাকবে।

মানুষের হাজার কোটি বছর ধরে খোঁজ করা কাঙ্খিত অমরত্বের একরকম উপায় পাওয়া গেলো ঠিকই, কিন্তু তা সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়ে...

 
══════════════════════════════════════
●●●● সংশোধন সহযোগিতায় কৃতজ্ঞতাঃ বর্ষা আপু ●●●●

0 Shares

১১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ