করোনা- ডায়েরী-(০২)

মুক্তা ইসলাম ২ মে ২০২০, শনিবার, ০৩:৪৩:০৫পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১১ মন্তব্য

গত দুদিন ধরে করোনা সংবাদের পোস্টের পাশাপাশি ফেসবুক ভরে গেছে কেয়ার রিএক্ট কে পেয়েছেন আর কে পায় নি, তার হিসেব নিয়ে। আমার অবশ্য কেয়ার রিএ্যাক্ট নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। কারণ পাওয়া, না পাওয়া দুটোই আমার কাছে এখন সমান সমান। কতকিছুই তো এই জীবনে পাবার কথা ছিল। তা থেকে কিছু পেয়েছি আর অনেক কিছুই না পাওয়ার লিস্টে তুলে রেখেছি। তার হিসেব তো কোনদিন করে দেখিনি। হিসেবের খাতাটা খুললে বোঝা যাবে আমার না পাওয়ার লিস্ট কতটা দীর্ঘ লম্বা ছিল। যাইহোক সেসব কথা নাহয় অন্য আরেকদিন হবে। আপাতত কেয়ার রিএ্যাক্টের পাওয়ার হিসেব ভুলে গিয়ে নিজের কেয়ার নিচ্ছি। গত পরশু রাত থেকে জ্বর আমার। জ্বরের তাপমাত্রা ছিল ১০৩ ডিগ্রি। সেইটাকে বারবার ভেজা কাপর দিয়ে শরীর মুছিয়ে, ঔষধপত্র, আর বিশ্রাম দিয়ে ৯৮ এ নিয়ে এসেছি। এখন কিছুটা সুস্থ অনুভব করছি।

সাস্থ্যই যে সকল সুখের মূল এটা এক রাতের জ্বরে আমি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। সারাটা রাত গেছে, একটা সকাল গেছে, সারাটা দিন গেছে চোখে আমার এক ফোটা ঘুম নেই। এখনও দুচোখে কোন ঘুমের রেখা নেই। এমনিতেও আমি সুস্থ্য অবস্থায়ও কমই ঘুমাই। এর জন্য নিজেকে মাঝে মাঝে আমার নিশাচর প্রাণী বা ভূত- প্রেতও মনেহয়। আজ ভয়ও পেয়েছিলাম মারাত্মক।

ফেসবুকে কে আসে, আর কে যায় আজকাল আর কিছুই টের পাই না। মা বরবটির ভর্তা বানিয়েছিল রাতে তাই দিয়ে মজা করে অল্প কয়টা ভাত খেয়েছিলাম। আপাতত পেট আর মন দুটোই আমার শান্তি।

আজ ৪৭ দিন হল ঘরে বসে আছি। আমার জন্মের পরের ৪৭ দিন ছাড়া সম্ভবত একটানা এতো দীর্ঘ সময় কোনদিন আমি বাসাতে শুয়ে বসে কাটাইনি। ক্লাস এইটে থাকতে আমার এপেন্ডিসাইটিস অপারেশন হয়েছিল। হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাওয়ার পরপরই আমি টোটো করে পুরো পাড়া ঘুরে বেড়িয়েছি। আমাকে আত্মীয় স্বজনরা কি দেখতে আসবে। আমিই নিজেই তাদের বাড়ী চলে গেছিলাম আমার নিজেকে দেখাতে। তখন সবার মুখে একটাই কথা ছিল,

“তুই না অসুস্থ ?”

“তুই না অসুস্থ ?”

নিজের অসুস্থতায় কখনো বাসায় ঘাপটি মেরে বসে থাকিনি। অথচ আজ থাকছি। কারণ গোটা পৃথিবী আজ অসুস্থ। যদিও বড় হওয়ার পর বাসায় থাকতে আমার আর তেমন খারাপ লাগে না। ঘর গুছাই, মায়ের সাথে রান্নায় হেল্প করি, ফেসবুকে আর ব্লগে প্রিয় কিছু লেখকদের লেখালেখি পড়ি, পড়াশোনা করি, নিউজ দেখি এসব কাজেই সময় কেটে যায়। কিন্তু সেই থাকাটাও সাধারণভাবেই থাকা ছিল। তার পিছনে বিশেষ কোন কারণ বা নিয়ম ছিল না। কোন বাধ্য- বাধকতা ছিল না। কোন ভয় বা আতংক ছিল না। গত ৪ মাস যাবৎ পুরো পৃথিবীতে করোনা মহামারির তাণ্ডব চলছে। একটু একটু করে গ্রাস করে নিচ্ছে গোটা মানবজীবনকে। বিপন্ন করে তুলছে স্বাভাবিক জীবন যাপন করাকে। তাই এখনের ঘরে থাকার কারণটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

নভেল করোনার মরন ফাঁদ থেকে বেঁচে থাকার জন্যই সবাই এখন যে যার যার মত আশ্রয় নিয়েছি নিজ বাসায়। টেলিভিশন আর ফেসবুক খুললেই সর্বপ্রথম চোখে পড়ে দেশে আজ নতুন কতজন করোনায় আক্রান্ত হলো। দেশে আর দেশের বাইরের বিভিন্ন দেশে কতজন করোনা আক্রান্তে মারা গেল। রোজ মৃত্যুর খবর শুনতে শুনতে এখন মৃত্যু অনুভূতি শূন্যের কোঠায়। নিজেকে শ্বান্তনা দেয়ার কোন ভাষা খুঁজে পাই না। অন্তর শক্ত পাথর হয়ে গেছে। অন্ধকারে পথিক যেমন পথ হারালে সে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। তেমনি করোনা মোকাবেলায় অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাই না। নিজ ঘরে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই আমাদের। দেখতে দেখতে মৃত্যু এখন আমার বাড়ীর দুয়ারেও। তবে টানা ৪৭ দিন ঘরে থেকে একটা উপকার হয়েছে। হাতে অনেকটা সময় পাওয়ায় নিজের জড়া-জীর্ণ আত্মাকে শুদ্ধ করে নেয়ার সুযোগ হয়েছে। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করার সুযোগ হয়েছে, যা নিজের মধ্যে এতোকাল লুকিয়ে ছিল নিজেরই অজান্তে।

তবুও করোনা বিদায় হোক,

মানব জীবন সুন্দর হোক।

এই প্রত্যাশায় বুক বাঁধি।

0 Shares

১১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ