প্রাচ্যের রাণী প্রকৃতির রাণী রূপ লাবণ্যে পাহাড় পর্বতমালা সাগর নদী পরিবেষ্টিত অপরূপ সৌন্দর্য্যের লীলভূমি বন্দর নগরী চট্টগ্রাম অনেক আগেই তার রূপ লাবণ্য জৌলুশ হারিয়ে বিবর্ণ, অপরিকল্পিত একটি বিশাল গ্রামে পরিণত হয়েছে। এখন  বিগতযৌবনা চট্টগ্রাম সামান্য বৃষ্টিতে বছরে কয়েকবার জলবদ্ধতায় পানির নিচে তলিয়ে যায়। ডুবে যায়। মশার কামড় খাওয়া নগরবাসীর নিত্য অনুষংগ। এবারের বর্ষায় মশাবাহিত ডেংগু এবং চিকনগুনিয়া আক্রান্ত হওয়ার শংকা উদ্ভেগ আতংক নিয়ে নগরবাসী দিন গুজরান করছে। তারচেয়েও সবকিছুকে ছাপিয়ে প্রাণঘাতী বৈশ্বিক মহামারী  করোনাভাইরাস চট্টগ্রামে চিকিৎসা সুযোগ সুবিধা আর ব্যবস্থাকে ক্রমাগত বিপর্যস্ত এবং হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। মোটা দাগে বলতে গেলে চট্টগ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। নেই সুচিকিৎসার সুষ্ঠু, সুন্দর,  সুপরিকল্পিত, সম্বন্নিত ব্যবস্থাপনা এবং পরিকল্পনা।

দিন দিন চট্টগ্রামে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধি  পাচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে মানুষের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস,  ক্যান্সার,  জটিল কিডনি রোগী, কিডনি ডায়ালেসিস, লিভারের রোগ, হাফানী বা শ্বাসকষ্ট,  দন্ত রোগ, বাত ব্যাথা,প্যারালাইসিস সহ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ ব্যাধি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে সর্দি কাশি ভাইরাল ফিভারসহ আরও কিছু হটাৎ দেখা দেওয়া রোগ ব্যাধি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় স্থানীয় প্রাইভেট ক্লিনিক এবং সরকারি হাসপাতালগুলো জটিল আর সাধারণ রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের ন্যুনতম চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে না। ক্লিনিকের  প্রভাবশালী মালিক, বি এম এ'নেতা, রাজনীতিবিদ  এবং প্রভাবশালী ব্যাক্তিরা মিলে মানুষের এই স্বাস্থ্য ঝুঁকির দুঃসময়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। আপনি পূর্বের জটিল রোগ বা নতুন কোনো রোগ ব্যাধি নিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিক বা সরকারি হাসপাতালে গেলে তারা করোনাভাইরাস সনাক্তের রিপোর্ট চাইছে। এখানে অনেক হটাৎ অসুস্থ হয়ে, সাধারণ জ্বর সর্দি কাশিতে ভোগে ক্লিনিকে যাচ্ছে তারা তো সবাই করোনা রোগী নয় বা করোনা উপসর্গেও  ভুগছেন না। তারপরেও করোনাভাইরাস সনাক্তের রিপোর্ট না থাকার কারণে প্রাইভেট ক্লিনিক এবং সরকারি হাসপাতালের দরজা থেকেই মুমূর্ষু, মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদের অমানবিক, নিষ্ঠুর, নির্মম এবং নির্দয়ভাবে ভর্তি না করে, চিকিৎসা সেবা না দিয়ে বিদায় করে দেওয়া হচ্ছে।ইছাক ব্রাদার্সের এম ডি মরহুম ইউনুস সাহেব  হৃদরোগ নিয়ে প্রাইভেট এবং সরকারি হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেছেন। আওয়ামী লীগ ও বি এন পি'র অনেক নেতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ওয়ার্ড কাউন্সিলর সহ অনেক নামি-দামী মানুষ হাসপাতাল আর ক্লিনিকে ঘুরে ঘুরে চিকিৎসা সুযোগ সুবিধা না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। সমাজের এসব বিশিষ্টজন, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষকসহ উচ্চ শ্রেণির এসব মানুষের যখন এমন অসহায় অবস্থা সেখানে গরীব দুঃখী অসহায় মানুষের চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা কতটুকু পাচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে দুর্ভোগ ভোগান্তির বিভিন্ন কাহিনী প্রতিদিন প্রিন্টিং এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সততার সঙ্গে  প্রকাশ এবং প্রচার হয়ে আসছে। তবুও এ বিষয়ে কারো ঠনক নড়ছে না।
মরার ওপর খাড়ার গা হচ্ছে চট্টগ্রামে প্রয়োজনীয় জীবনরক্ষাকারী ঔষধের পাশাপাশি  সাধারণ ঔষধ নাপা, নাপা এক্সট্রা, বিভিন্ন এন্টিবায়োটিক এবং ডেটল, স্যাভলন, মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, পিপিই,  হ্যান্ড স্যানিটাইজার সহ বিভিন্ন  চিকিৎসা সুরক্ষা সামগ্রীর দুষ্প্রাপ্যতা এবং আকাশচুম্বী দাম যা সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবা ও সুযোগ পাওয়ার অন্তরায় এবং ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।  প্রশাসন বিভিন্ন ঔষধের দোকানে অভিযান চালিয়ে ঔষধের অহেতুক মূল্যবৃদ্ধি, নকল ও ভেজাল ঔষধ, উচ্চমূল্যের ও নকল স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী বিক্রির জন্য বিভিন্ন অংকের জরিমানা করছে। অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে অক্সিজেন নিয়েও দুঃখজনক ভাবে অসাধু সিন্ডিকেট চক্র খুবই সক্রিয়। ছয় সাত হাজার টাকার সিলিন্ডারের দাম নাকি চব্বিশ হাজার টাকা। পাশাপাশি অক্সিজেন সিলিন্ডারের কৃত্রিম সংকটও তারা সৃষ্টি করেছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং শ্বাসকষ্টের রোগীর চিকিৎসায় অক্সিজেন খুবই জরুরি। এ সুযোগে দাম বৃদ্ধির বেদনাদায়ক অপততপরতার  পাশাপাশি অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে  কতিপয় ব্যসায়ী ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন বিভিন্ন ক্লিনিক এবং হাসপাতালে সরবরাহ করছে যা শ্বাসকষ্টে ভুক্তভোগী রোগীর জীবনরক্ষা ও স্বাস্থ্যের জন্য  মারাত্মক ক্ষতি এবং স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণও বটে। এক তথ্য থেকে জানা যায়, মেডিক্যাল গ্রেডের অক্সিজেনের ঘনত্ব ৯৯.৯ শতাংশ যা রোগীর জন্য  একটি  নির্ধারিত  মানদন্ড।অপর দিকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের ঘনত্ব হচ্ছে ৬৫ শতাংশ যা খুবই নিম্নমানের। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, রোগীর ওপর  প্রয়োগকৃত অক্সিজেনের গুণগত বা পরিমাণগত হেরফের হলে রোগী নানান ধরনের জটিল স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। রোগীর ফুসফুসে ক্ষত তৈরি হতে পারে। তিনি অন্ধ হয়ে যেতে পারেন। তার মধ্যে অবসাদগ্রস্ততা বা ঝিমুনি ভাব তৈরি হতে পারে। তিনি অসংলগ্ন আচরণ করতে পারেন।অথচ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক, স্বাস্থ্যঝুঁকি পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও অর্থের মোহে পড়ে মানুষ যেন মানবতা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি, মানবিক মূল্যবোধ ধর্মীয় বিশ্বাস আর অনুশাসন  সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে অসত এবং অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে। মানুষের মানবিক, নৈতিক, সামাজিক অবক্ষয় রীতিমতো অর্থলোভী নীতি বিবর্জিত অমানুষে পরিণত করেছে।
গত ১৪ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৫০৮৪ জন এবং দুঃখজনকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে ১১৮ জন।অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে নমুনা পরীক্ষা করানোর জন্য মানুষকে মারাত্মক  দুঃখ দুর্দশা দুর্ভোগ ও ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। পাশাপাশি নতুন করে যোগ হয়েছে রিপোর্ট পেতে  বিলম্ব এবং দীর্ঘসূত্রতা। গত ১৫ জুনের দৈনিক আজাদীর এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গত ১২ দিনেও নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পায়নি রোগীরা। আরও জানা যায় ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে কয়েক হাজার নমুনার ভয়াবহ জটের সৃষ্টি হয়েছে। জট কমাতে তিন হাজার নমুনা ঢাকায় পাঠানো হয়েছে সেগুলোর রিপোর্ট কবে আসবে সংশ্লিষ্ট কেউ তা জানেনা। আরেক সূত্র থেকে জানা যায় চট্টগ্রামে শিল্প কারখানার অক্সিজেন মেডিক্যাল গ্রেডে রূপান্তরিত করার সঙ্গে বড় কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান সহ ৪০টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়েছে যারা নকল এবং মানহীন অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি করছিল। আরও দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট শুধু ফার্মেসি ও দোকানগুলোতে সীমাবদ্ধ নেই, অন লাইনেও রয়েছে তাদের বাজার।
মানুষের জীবন ধারণের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার একটি হচ্ছে জনগণের দ্বার গোড়ায় চিকিৎসা সেবা পৌঁছে দেওয়া। জনসাধারণের চিকিৎসা সেবা পাওয়া জন্মগত মৌলিক সাংবিধানিক এবং নাগরিক অধিকার। অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে চট্টগ্রামবাসী তাদের ন্যায্য এবং মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চিকিৎসা সেবা ও সুযোগ পাওয়ার জন্য মানুষ হাসপাতাল আর ক্লিনিকের দুয়ারে দুয়ারে মাথা ঠুকে মরছে। করোনা উপসর্গ নিয়ে এবং উপসর্গহীন রোগীরা প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে হাসপাতালের দুয়ারে, এম্বুল্যান্সে, ঘরে ঘরে মারা যাচ্ছে। মেয়রসহ অনেকেই উদ্যোগ নিচ্ছেন তা বিচ্ছিন্নভাবে, এখানে সম্বন্নয়ের প্রকট অভাব রয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই  চট্টগ্রাম এখন করোনাভাইরাস আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগী। মানুষ স্বাস্থ্যসেবা চায়, বাচার জন্য স্বস্তির সঙ্গে নিস্বাস নিতে চায়। অতএব সংশ্লিষ্ট সকল মহল সম্বনিত, সুষ্ঠু, সঠিক, কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে যথাসময়ে  চট্টগ্রামবাসীর স্বাস্থ্যসেবা সুনিশ্চিত করুণ। নিশ্চিত করুণ বিনা চিকিৎসায় কেউ যেন মারা না যায়। পাশাপাশি কেউ যেন হয়রানি, দুর্ভোগ দুর্দশা, মানসিক কষ্ঠ এবং ভোগান্তিতে না পড়ে সেব্যাপারেও সজাগ সতর্ক এবং মনোযোগী হওয়া উচিৎ  । সংশ্লিষ্ট সবার মনে রাখা উচিৎ চিকিৎসা সেবা দয়া নয়, জনসাধারণের মৌলিক অধিকার।

0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ