এক দরিয়ার গল্প।

রিতু জাহান ২০ ডিসেম্বর ২০১৫, রবিবার, ১১:৫৫:০১অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৪ মন্তব্য

এই বার নিয়ে তৃতীয়বার চেষ্টা করছি লেখার যদি শেষ হয়।
দরিয়া বেড়ে উঠেছিলো এক রক্ষনশীল মুসলিম বাড়িতে আশ্রিত হয়ে। গ্রামের নাম আদাঘাট, রামপাল থানা, বাগেরহাট জেলা। নামকরা মুন্সিবাড়ি। পাশেই মাতব্বর বড়ি। দরিয়া ও তার মা, বাবা, ভাই, এক বোন সহ গরিব আত্নীয় সূত্রে বেড়ে উঠেছিলো ঐ তথাকথিত রক্ষনশীল মুন্সি বাড়িতে। যে মুন্সি বাড়িতে রেডিও, টিভির বালাই ছিলো না। মেয়েরা জোরে কথাও বলে না। দরিয়া তাই কড়া শাসনেই বড় হয়েছিলো। রত্না ছিলো দরিয়ার খেলার সাথি। রত্না, মুন্সিবাড়ির ছোট কাকার মেয়ে। রত্না বুঝতো না মানতেও চাইতো না, কেন জোরে কথা বলা যাবে না, কেন বাইরের পুকুরে নামা যাবে না। রত্না তাই দাদা বাড়িকে বরাবরই অপছন্দ করতো। অথচ ঐ বাড়ির ছেলেরা, মেয়েরা আজ কতো শিক্ষিত!
দরিয়াকে নিয়ে শৈশবে তাই বনেবাদাড়ে ছুটে বেড়াত রত্না।কোন গাছে গাব পেকেছে, কোন গাছের পেয়ারা মিষ্টি, কোন পুকুরে হাতড়ে ভালো মাছ ধরা যায়, সব খুঁজে ফিরত এই দুজন। দরিয়াকে সবাই একাজ ওকাজ করতে ডাকত। দরিয়া যেন কাজ গুলো তাড়াতড়ি সেরে ফেলতে পারে, রত্না চুপ করে দরিয়ার ভাগের কাজ করে দিতো। ছিড়া জাল হাতে কতো যে দাবড়ানি খাইছে এইটা নিয়ে রত্না।
এক সময় সব থেমে গেলো। মানুষ হতে হবে ভালো স্কুলে পড়তে হবে তাই গ্রামে থাকা চলবে না। গ্রামে যাওয়াও বন্ধ। দরিয়ার সাথে রত্নার ওখানেই সম্পর্ক শেষ। যোগাযোগ রাখবে সেই সময় কোথায়। হয়ত সেই সময় সেই আবেগও ছিলো না। মাঝে মাঝে গ্রাম থেকে কেউ এলে ওর খবর সোনা হতো। সেই মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় রত্না সবার কাছ থেকে দোয়া নিতে গ্রামে গিয়েছিলো। দরিয়কে দেখে অবাক হয়েছিলো। এতো সুন্দর হয়েছে মেয়েটা। রত্নার তখন একটু জড়োসড়ো ভাব। সেই কাঁধে হাত দেয়ার বয়স বা সম্পর্কের বিভেদটা ই সামনে ছিলো। তাই ওভাবে আর ওকে জড়িয়ে ধরা তো দূরের কথা হাতটাও ধরা হয়নি। এতো সুন্দর গায়ের রং দরিয়ার! মুখশ্রী ও তার দেখার মতো।
সেই দরিয়ার ঘর ছিলো। কিন্তু ঘরের বেড়া ছিলো না ভালো, দরজা ছিলো,দরজার লক ছিলো না। গরিবের ঘরে এতো সুন্দর মেয়ে হয়ত তাই কাল!
যে দরিয়া দৌড়ায়ে সবার প্রয়োজন মিটাতো। তাকে কি ভালোমতো রাখতে পারতো না ঐ মুন্সিবাড়ির মানুষ? মুন্সিবাড়ি, পাশে মাতব্বর বাড়ির হায়নার দল সারাক্ষণ তক্কে তক্কে থাকতো কখন এই ফুটফুটে মেয়েটিকে নষ্ট করবে। আচ্ছা কিছু মানুষ বলে ছোটবেলা থেকে ইসলামি শিক্ষা দিলে ছেলেমেয়েরা ভালোমানুষ হয়, পাপপুণ্যের হিসাব বোঝে। সত্যি কি বোঝে? জাগে এদের মানবতা বোধ? জাগে না!
প্রেম আসতেই পারে। প্রেম মানে বিশ্বাস। ভালোলাগা, ভালোবাসা।তাই দরিয়ার জীবনেও প্রেম এসেছিলো। ভালোবাসতে শিখেছিল। কিন্তু ধর্মীয় মূল্যবোধ বোধহয় ঐ শিখেছিল। ও কখনও তাই সীমা লঙ্ঘন করনি। অপেক্ষা করেছে এই প্রেমের একটা স্বীকৃতি হওয়া পর্যন্ত।
কিন্তু প্রেমিক রূপি জানোয়ারটা ছিলো মাতব্বর বাড়ির ছেলে। ও তো কখনোই ওকে স্বীকৃতি দিতে চায়নি। শুধু চেয়েছিল ওর শরীর। যখন কিছুতেই দরিয়াকে রাজি করাতে পারলো না, জানোয়ারটা ক্ষেপে গেলো। এক বৃষ্টিভেজা রাতে, চারিদিকে সন গাছের ঝোপের আড়ালে পরিত্যক্ত এক জায়গায় দরিয়াদের ভাঙা ঘর ছিলো। ওখানে গিয়ে দরিয়াকে ধরে নিয়ে আসলো। দরিয়ার মা তখন ঐ রক্ষনশীল মুন্সিবাড়ির কাজে। তারই বাড়ি আর মাতব্বর বাড়ির চার পাঁচজন মিলে দরিয়াকে সেই রাতে নির্যাতন করে মারলো। শুনেছি ওর ডান হাতটা ভেঙে দিয়েছিলো। মুখে কাঁদা ঠুসে দিয়েছিলো। বৃষ্টি ভেজা কাঁদা মাখা ওর নিথর শরীর পড়েছিলো। ওকে যখন নিয়ে যায়, ওর দাদি কিন্তু শুনেছিল, দেখেছিল, চিনেছিল। কিন্তু কোনো বিচার হয়নি। কে করবে বিচার। তখন ঐ মুন্সিবাড়ির ছেলে জামাতের এমপি যে।
যে দরিয়ার জন্ম ঐ মুন্সিবাড়ি, বেড়ে ওঠা ঐ মুন্সিবাড়ি, এর ওর ফরমায়েস খেটে তিনবেলা ভাত খেয়ে বড় ঐ মুন্সিবাড়িতে।অথচ ঐ মুন্সিবাড়িতে ওর লাশটিও দাফন হলো না। জানাজাও কেউ পড়ায়নি। কেন? দরিয়া কি অসুচি ছিলো? সরাসরি আল্লাই তো বৃষ্টি নামিয়ে ওকে গোসল দিয়েছিল। দরিয়া আমার কাছে পবিত্র।দরিয়া তুই যেখানে থাক জানি ভালো আছিস। ভালো থাকিস।
আজও ঐ দরিয়ার কবর খাল পাড়ে আছে। রত্না আর কোনোদিন দাদাবাড়ি যায়নি।
তবুও মাঝে মাঝে এ রকম কারো মৃত্যু দেখলে দরিয়ার মুখটা মনে পড়ে।
এটা কিন্তু সত্যি ঘটনা।

0 Shares

৪টি মন্তব্য

  • জিসান শা ইকরাম

    সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখাটি পড়ে খারাপ লাগছে
    দরিয়াদের পক্ষে দাঁড়ানোর মত কেউ নেই আসলে
    এরা যুগ যুগ ধরে এমনি ভাবেই মৃত্যুকে বরন করে
    সমাজপতিরা এদের কুলটা বানিয়ে ফেলে।

    দরিয়ার আত্মা শান্তি পাক।

  • নীলাঞ্জনা নীলা

    আমরা মানুষ, আমাদের ধর্ম মানবতা। কিন্তু মানবতাকে ক’জন মানুষ স্থান দেয় সম্মানের সাথে? অনেক অনেক দরিয়া এভাবে মরছে রোজ। বেঁচে থাকলে দোররা খাচ্ছে। মাটিতে আধা পুঁতে পাথর নিক্ষেপে রক্তাক্ত হচ্ছে। ভাগ্য ভালো দরিয়া বেঁচে নেই। তা নইলে সমাজ ওকে এমন জায়গায় পৌঁছে দিতো, যেখানে পতিতা হিসেবে ওর পরিচয় হতো।

    মৌনতা রিতু সত্যি এভাবেই তুলে ধরুন। আছি পাশে। -{@

  • শুভ মালাকার

    আমার মতে, “স্রষ্টার সৃষ্ট কোন ব্যাক্তি/প্রাণী বা বস্তু যে কার্য না করলে তাকে ঐ ব্যাক্তি/প্রাণী বা বস্তু বলে আখ্যা দেওয়া যায় না, সেই কার্যকেই ধর্ম বলে” যেমন- এক খন্ড চৌম্বক যদি উত্তর মেরুর দিখে হেলে না থাকে তাহলে তাকে চৌম্বক বলে না (উত্তর দিখে হালে থাকাই হল চৌম্বকের ধর্ম)। তাই, মানুষের মধ্যে যদি মনুষ্যত্ব না থাকে তবে তাকে আর মানুষ বলা যায় না। সুতরাং ঐ মুন্সিবাড়ির লোকেরা যতই ধর্মের নিয়ম অনুসরন করুক না কেন উনারা কোন ভাবেই ধার্মিক হতে পারেন না, কারন ঐ নির্যাতন টি তাদের দারাই করা হয়েছিল আর মাতব্বর বাড়ির লোকেরাও সমান অপরাধের অপরাধী।

    দরিয়ার আত্মার শান্তি কামনা করি।

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ