আমাদের দেশে নির্যাতিত পেশার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রিক্সা চালকদের। আমরা তাঁদেরকে সম্মানের সাথে সম্বোধন করি না বরং কথা বলি তুঁই তোকারি করে। আবার রিক্সা চালকদের মধ্যে এমনকিছু ঘাড় ত্যাড়া আছে যাঁদের আচার আচরণ, দেহভঙ্গী, বাচনভঙ্গি, কথাবার্তা অশোভনীয় এবং অনেকটা বেয়াদবির পর্যায়ে চলে যায়। দশবার বললেও একবার উত্তর দেয়না। মাঝে মধ্যে মনে হবে আপনি যে একজন মানুষ তা যেন সে স্বীকারই করতে চাইছেনা সে। তাঁরা নির্বিকার আর উদাসীনভাবে ঠাই বসে থাকবে, তাঁদের মর্জিমাফিক তাঁরা চলবে। আপনার পক্ষে রাগ সম্বরণ করা অনেক সময় সম্ভব না হলেও করার কিছু থাকেনা। তাঁদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক আবার বিপথগামী, নেশাগ্রস্থ, জুয়ারি এবং এদের অনেকেই ২/৩ টি পর্যন্ত বিয়ে করে থাকে। কিছু কিছু রিক্সা চালক মানুষ এবং যাত্রীদের সাথে প্রতারণা করে, অযৌক্তিক এবং বেশী ভাড়া দাবী করে থাকে। চালক আর যাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ঝগড়া বিবাদ, বচসা, হাতাহাতি, সংঘর্ষ সম্ভবত রিক্সা চালক আর যাত্রীদের সাথেই হয়ে থাকে।
আমরা সব দোষ রিক্সা চালকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে হবেনা। তাঁরা প্যাডেল মেরে উঁচু নিচু সমান্তরাল রাস্তায় মাথার ঘাম পায়ে ঝরিয়ে যাত্রীদের বহন করে থাকে। তাঁদের দুঃখ কষ্ট পরিশ্রম আমরা হৃদয় দিয়ে, মানবিকতা দিয়ে, নৈতিকতা দিয়ে অনুভব করিনা। আমরা রিক্সায় বসে আছি আর এই গরমে তাঁরা ঘর্মাক্ত হয়ে তপ্ত রোদে, প্রবল ঝড় তুফান বৃষ্টিতে, জলমগ্ন শহরের কোমর সমান পানিতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে। জীবন ধারণের জন্য, পৃথিবীতে পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য কি এক নিষ্ঠুর আর অমানবিক পরিশ্রমই না তাঁরা করে যাচ্ছে। তাঁদের কি আমারা তাঁদের ন্যায্য এবং প্রাপ্য পারিশ্রমিক দিচ্ছি নাকি ঠকাচ্ছি। আমরা খেটে খাওয়া গরীব দুঃখী রিক্সা চালকদের সাথে ২ টাকা, ৫ টাকা, ১০ টাকার জন্য তাঁদের সাথে ঝগড়া ঝাটিতে লিপ্ত হচ্ছি। তাঁদেরকে ঠকাতে চেষ্টা করি, তাঁদেরকে ৫/১০ টাকা দিতে কার্পণ্য করছি আর হোটেল রেস্তোরাঁয় বয় বেয়ারাদের, বিয়ে বাড়ীতে, মেজবানে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে হাত ধোয়ার জন্য গরম পানি দিলে বা অন্য কোন কাজ করিয়ে তাঁদেরকে টিপস দিতে কার্পণ্য করিনা, সেলুনে নর সুন্দরদের টিপস দেই কিন্তু রিক্সা চালককে দুই টাকা দিতে আমাদের বিবেকে বাঁধে। বিভিন্ন সামাজিক, পারিবারিক বা বিয়ের অনুষ্ঠানে অনেকক্ষেত্রে আমরা প্রতিযোগিতা করে টিপস দিয়ে থাকি।
কয়েক দিন আগে একটা কাজে বাইরে গিয়েছিলাম যাওয়ার সময় মাঝ বয়সী রিক্সা চালককে যে ভাড়া দিয়েছিলাম আসার সময় অন্য এক বৃদ্ধ চালককে একই ভাড়া দিলাম। নামার সময় দেখি রিক্সা চালক উপরের দিকে হাত তুলে আমিন বললেন। এবং জিজ্ঞেস করলাম চাচা ভাড়া ঠিক আছে তো! ঠিক না অনেক বেশী হয়ে গেছে। অথচ আগের রিক্সা চালক একই ভাড়া পেয়ে কিছুই বলেনি। বৃদ্ধ চালককে দেখে কেমন জানি মায়া লেগে গেল তাঁকে অল্প কিছু টাকা দিতে চাইলে নিতে চাইছিল না, জোর করে দিলাম। চলার পথে এরকম যুবক বুড়ো অনেক রিক্সা চালকদের শোকরিয়া আদায় করতে দেখেছি, দোয়া করতে দেখেছি। আবার তাঁদের অন্যায় আচরণ অন্যায্য দাবীর জন্য তাঁদের সাথে বিবাদ বিস্মবাদ হয়নি তাও নয়। তাঁদেরকে অনেক সময় গাল মন্দ করেছি, স্বগত উচ্চারণ করে ভেবেছি দরদাম ঠিক করে রিক্সায় উঠলে ক্ষতি কি ছিল।
আমাদের অর্থাৎ যাত্রীদের মধ্যে যেমন ভালো মন্দ আছে, মানুষকে ঠকানোর মতলব আছে ঠিক তেমনি রিক্সা চালকদের মধ্যেও ভালো মন্দ রয়েছে। অতএব আমাদের উচিৎ পরিশ্রমী এই মানুষগুলোর ন্যায্য পারিশ্রমিক বা ভাড়া তাঁদের ঘাম শুকানোর আগেই দিয়ে দেয়া উচিৎ। মানুষের প্রতি সদয় এবং সদ্ব্যবহার করা উচিৎ হউক না সে রিক্সা চালক। বলা হয়ে মানুষের সাথে সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে বংশের পরিচয় পাওয়া যায়।
ছবিঃ সংগৃহীত ।
১৪টি মন্তব্য
অনন্য অর্ণব
অবহেলিত পেশার মানুষগুলোকে নিয়ে আমাদের ভাবার সময় কই ? অথচ আমরা যারা শিক্ষিত সমাজের লোক আমরা ইকোসিস্টেম জানি, চেইন অব সোসাইটি জানি যা ঐ রিকশা শ্রমিকদের জানার কথা নয়। অথচ কি আশ্চর্য আমরা জেনে বুঝেই সোসিয়াল চেইনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ্উপাদান কে অগ্রাহ্য করি, অবহেলা করি সময়ে সময়ে তাদের অধিকার ক্ষুন্ন করি। এটা অন্যায়।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আপনার গুরুত্বপূর্ণ এবং চমৎকার মতামতের জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আমাদেরও একই প্রশ্ন — “অবহেলিত পেশার মানুষগুলোকে নিয়ে আমাদের ভাবার সময় কই” ?
সুস্থ আর ভালো থাকবেন।
সৌবর্ণ বাঁধন
রিকশাচালকদের দোষ বেশি দেখাটা ঠিক হবেনা। তাদের আচরণ হয়তো সমাজের বৈষম্যের প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হয়। কেউ বঞ্চিতদের শ্রেণীতে পড়ে গেলে অন্যদের প্রতি সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ে। এটাই হয়তো স্বাভাবিক। সুন্দর লেখা।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আপনার সময়োপযোগী মতামতের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ঠিকই বলেছেন — “কেউ বঞ্চিতদের শ্রেণীতে পড়ে গেলে অন্যদের প্রতি সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ে। এটাই হয়তো স্বাভাবিক”।
শুভ কামনা রইলো।
দালান জাহান
রিক্সা চালকদের মধ্যে দুধরনের মানুষ লক্ষ্য করা যায় এটা সত্য। অনেক লোভী প্রতারক রিক্সা চালক পেয়েছি। আবার অনেক নিষ্ঠাবান সৎ রিক্সা চালকও পেয়েছি। আমি সবসময় কপটদের অপছন্দ করি এবং সৎদের প্রতি আমার উদারতা ঢেলে দেই। প্রতিটি মানুষকেই সর্বোপরি সম্মান করা উচিত। সুন্দর পোস্ট লিখেছেন। ধন্যবাদ
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আপনার সুন্দর মতামতের সঙ্গে একমত — “আমি সবসময় কপটদের অপছন্দ করি এবং সৎদের প্রতি আমার উদারতা ঢেলে দেই। প্রতিটি মানুষকেই সর্বোপরি সম্মান করা উচিত”।
ধন্যবাদ ভাই।
আলমগীর সরকার লিটন
বেশ মানবিক প্রকাশ এরকম মানবিক সবার থাকত তাহলে সবকিছু পরিবর্তন করা যেতো কবি দা অনেক শুভেচ্ছা রইল
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
মানবিক না হলে কী তাঁকে মানুষ বলা যায়। শুভ কামনা রইলো ভাইয়া।
সাবিনা ইয়াসমিন
রিক্সা চালক আর রিক্সা যাত্রীর আচরণ সব সময়ে, সব ক্ষেত্রে একইরকম হয় না। ভালোমন্দ উভয়ের মাঝেই বিদ্যমান। রিক্সাওয়ালারা অনেক সময়ে বাড়াবাড়ি করে, আবার কিছু যাত্রীদেরও ততোধিক বাড়াবাড়ি করে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে দেখা যায়।
শুভ কামনা 🌹🌹
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আসলে আপু আমাদের সকলের মধ্যে সহনশীলতার , সহমর্মিতার অভাব প্রকট। শুভ কামনা রইলো।
ছাইরাছ হেলাল
আমরা আর একটু মানবিক হলেই অনেক সমস্যার সমাধানের কাছাকাছি যেতে পারি।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আসলে ভাইয়া আমরা মানবিক হতে পারি না। আমাদের মধ্যে নৈতিকতাবোধও কাজ করে না। ধন্যবাদ ভাইয়া।
হালিমা আক্তার
সব পেশার মধ্যে ভালো মন্দ আছে। আবার যাত্রীদের মধ্যেও ভালো মন্দ দুই বিরাজ করে। সব সময় চেষ্টা করি মানবিক হওয়ার। কোন বিষয়ে বাড়াবাড়ি একদম পছন্দ নয়। মানুষ হিসেবে সবাইকে সম্মান করে চলা উচিত। শুভ কামনা রইলো।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আপু আপনি সঠিক বলেছেন — “মানুষ হিসেবে সবাইকে সম্মান করে চলা উচিত”। আমরা মানুষকে সম্মান দিতে জানিনা। আমাদের মানবিক মূল্যবোধগুলো ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ধন্যবাদ আপু।