হালাল রুজির মূল উদ্দেশ্যই হলো সমাজে ন্যায়বিচার, শান্তি, শৃঙ্খলা, সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব, সাম্য, নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ এবং সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্তুসামগ্রী আহার করো, যেগুলো আমি তোমাদের রুজি হিসেবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় করো আল্লাহর, যদি তোমরা তাঁরই বন্দেগি করো”। {সুরা বাকারা, আয়াত-১৭২}। বর্তমান সমাজে আমরা দেখি, হালাল খাদ্যের সন্ধানে সবাই ব্যতিব্যস্ত অথচ সবার আগেই ধর্মীয়ভাবে হালাল রুজি নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, হালাল রুজি রোজগারের ব্যাপারে অনেকেই উদাসীন। এ ব্যাপারে ধর্মীয় রীতিনীতিকে না মানা বা উপেক্ষা করার বিষয় সুস্পষ্ট। ফলে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ধনী এবং গরীবের ব্যবধান প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। পাশাপাশি বিশৃঙ্খলা, অনৈতিক কর্মকাণ্ড, পেশী শক্তির ব্যবহারের কারণে সমাজে অস্থিরতা, দুর্বৃত্তায়ন, ভারসাম্যহীনতা প্রকটভাবে দৃশ্যমান। একথা অনস্বীকার্য যে, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা চিকিৎসার মতো পাঁচটি মৌলিক চাহিদার প্রয়োজন রয়েছে। আর জীবনের নানাবিধ চাহিদা পূরণের জন্য আমাদেরকে বিভিন্নভাবে জীবিকার অন্বেষণ করতে হয়। জীবিকার মাধ্যমে জীবনের চাহিদাসমূহ পূরণ করার জন্য তথা রুজি রোজগারের জন্য মানুষ ব্যবসা বাণিজ্য, চাকুরী, মুজুরীসহ বিভিন্ন ধরণের কাজ বা পেশা বেঁচে নিয়ে থাকে। আপনি ব্যবসা বাণিজ্য,  চাকরি বাকরি, মুজুরী যাই করুণ না কেন আপনার আয় শতভাগ হালাল হতে হবে। এবং হালাল আয়ের বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক সজাগ থাকার পাশাপাশি ধর্মীয় রীতিনীতি ও অনুশাসন কঠোরভাবে মানতে হবে। কাজের ক্ষেত্রে আপনাকে নিয়ম নীতি, সততা, শৃঙ্খলা, নিয়োগকারীর সন্তুষ্টি অর্জন করার পাশাপাশি দায়িত্ব কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সজাগ এবং সতর্ক থাকতে হবে। কর্তব্যকর্মে অবহেলা, ফাঁকি দেয়া, অযথা শ্রম-ঘণ্টা অপচয় করা, কোম্পানির স্বার্থের ওপর ব্যাক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া যাবে না। দুর্নীতি,  স্বজনপ্রীতি, উৎকোচ বা উপহার গ্রহণ করে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কোম্পানির যেকোন ধরণের আর্থিক বা অন্য কোন ক্ষতি বা সুনামহানী করা যাবেনা। প্রতিষ্ঠানের হিসাবের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সততা শতভাগ নিশ্চিত করা নৈতিক দায়িত্ব। অনেকেই কর্মস্থলে হাজির না থেকে কয়েকদিন পর পর গিয়ে একসাথে হাজিরা দিয়ে মাস শেষে যে বেতন ভাতা নেন তা হারাম রুজি হিসেবে বিবেচ্য হবে।

ইসলাম ব্যবসাকে হালাল করেছে আর সুদকে করেছে হারাম। ব্যবসার ক্ষেত্রে সুদ নেয়া দেয়া ইসলামের দৃষ্টিতে অবৈধ। ওজনে কম দেয়া, খাদ্যে ভেজাল দেয়া, দাম বৃদ্ধির জন্য মজুদদারি, সর্বোপরি সিণ্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে মূল্যবৃদ্ধি ইসলামে নিষিদ্ধ এবং অত্যন্ত গর্হিত কাজ। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় খাদ্যে কাপড়ের রঙ,  মোবিল, ইউরিয়া সার, ফরমালিন সহ বিভিন্ন ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয় যা মানবদেহের বিভিন্ন স্পর্শকাতর অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্থের পাশাপাশি বিকল পর্যন্ত করে দিচ্ছে।  এমনকি তা মানুষকে মৃত্যুর মুখে পতিত করছে। তাছাড়া অনেকে মেয়াদ উত্তীর্ণ খাদ্য দ্রব্য, জীবন রক্ষাকারী ঔষধ বিক্রি করে হারাম আয়ের নেশায় মত্ত রয়েছেন। রাস্তা ঘাট ব্রিজ দালানকোঠা ইত্যাদি নির্মাণের সময় সঠিক মানের সরঞ্জাম ব্যবহার নিশ্চিত না করে উৎকোচের মাধ্যমে বা অন্যায্য সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে ব্যাক্তি বা রাষ্ট্রের ক্ষতি করে ব্যাক্তিগতভাবে যা পাচ্ছেন তা হারাম। উৎকোচের মাধ্যমে যোগ্য ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে অদক্ষ বা অযোগ্য লোক বা প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিয়ে যা পকেটস্থ করবেন তা হালাল রুজির অন্তর্ভুক্ত হবে না। সরকারের রাজস্ব, আয়কর এবং ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী যাকাত না দিলে সে আয় বৈধ আয় হিসেবে গণ্য হবে না। বাহুবলে, গায়ের জোর খাঁটিয়ে, অন্যায় প্রভাব বিস্তার করে, দখল করে সে স্থান বা প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসা থেকে আয় করে বিশাল অংকের মালিক হয়ে দানবীর শিল্পপতি, ধনী হয়ে তা থেকে দান সাদাকা, অনুদান আল্লাহ্‌র কাছে হালাল আয় হিসেবে কখনোই বিবেচিত হবে না। অবৈধ আয়, কর ফাঁকি, দুর্নীতি, কাজে ফাঁকি, অনিয়ম করে যে অর্থ সম্পদ অর্জন করছেন তা অবশ্যই অন্যায় এবং অবৈধ। তা দিয়ে হজ্জ করেন, যাকাত দেন, গরীব দুঃখীর মেয়ের বিয়েতে সাহায্য সহযোগিতা করেন, রাস্তা, মসজিদ, মাদ্রাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ বিভিন্ন সদকায়ে জারিয়া করলেও আখারেতে মহান আল্লাহ্‌র কাছ থকে তাঁর বিনিময় পাবনে না। তবে সমাজে আপনি দানবীর, সমাজসেবী, শিক্ষানুরাগী, শিল্পপতি, ধণাঢ্য ব্যবসায়ীর তকমা পাবেন। মানুষের শ্রদ্ধা ভালবাসা পাবেন যা দুনিয়াবী সুখ শান্তি প্রশান্তির বিষয় হবে মাত্র। আখেরাতে কোনো কাজে আসবে না।

আমাদের দেশে অনেকে স্বেচ্ছায় কেউবা পরিবারের প্ররোচণায়, অন্যের সঙ্গে অশুভ প্রতিযোগীতা, লোভ-লালসা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, উচ্চাশা, ধনী হওয়ার অহেতুক তীব্র এবং উদগ্র আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছা, সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী ইত্যাদি বিশেষণে নিজেকে অধিষ্টিত বা প্রতিষ্টা করতে গিয়ে অসৎ পথে, অন্যায়ভাবে হারাম উপার্জনে প্রলুব্ধ হয়ে পড়ছে। যা অশুভ, অন্যায়, অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত, ধর্মীয়, নৈতিক, মানবিকভাবেও গ্রহণযোগ্য নয়। দুনিয়াবি বা লোক দেখানো অহমিকা মিথ্যে দম্ভ অহংকারে জন্য মানুষ বিপথে যাচ্ছে। মানুষ পরিণত হচ্ছে অমানুষে, শয়তানে, দানবে। ধর্মীয় রীতিনীতি, অনুশাসন, নৈতিকতা, মানবতা বিবর্জিত কর্মকাণ্ডে জড়াতেও অনেকে দ্বিধা পর্যন্ত করছে না। করছে না সঙ্কোচ। ভয় করছে না মহান আল্লাহ্‌কে এবং শেষ বিচার দিবসকেও। অনেকের চাওয়ার আর পাওয়ার যেন শেষ নেই। একটি মানুষের এক জীবনে কত শত কোটি টাকার প্রয়োজন যার কারণে মানুষ খুন করতে, অন্যের সম্পদ জবর দখল করতে, টেণ্ডারবাজী করতে, কাজ না করে কাজের টাকা হাতিয়ে নিতে হয়। দেশের বর্তমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মানুষ যেভাবে বেপোরোয়াভাবে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে পড়েছে তা ভাবতেই খুব কষ্ট হয়।

করোনাভাইরাসের মতো প্রাণঘাতী মহামারীর এমন দুঃসময়েও মানুষের জীবন রক্ষাকারী ঔষধ, বিভিন্ন সুরক্ষা সরঞ্জাম নকল ভেজাল করে অসাধু উপায় অবলম্বন করে মানুষের নিকট থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। ত্রাণ চুরি, সরকারী সাহায্যের টাকা তছরুপ করে গরীবের হক মেরে দিচ্ছে। আবার অনেকে এতীমের হক মেরে দিতেও কার্পণ্য করছে না। সবাই শর্টকাটে দুর্নীতি, দখলবাজী, টেন্ডারবাজী, নিম্নমানের কাজ করে অধিক বিল নিয়ে ধনী হওয়ার অশুভ  অনভিপ্রেত অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিযোগীতায় যেন মেতে উঠছে। আসুন মানুষের দুঃখ কষ্ট ভোগান্তি দুর্ভোগ দুর্দশাকে জিম্মি করে অমানবিক, অনৈতিক, অসৎ, অসাধু উপায়ে মানবতা বিবর্জিত হয়ে টাকা কামানোর সকল পথকে পরিহার করে সততা ন্যায় নীতি হক হালালের পথে রুজির তালাসে তৎপর হই। পরকালে আখেরাতে হিসেব নিকেষ প্রদানের জন্য নিজেদের আমলকে মজবুত করি। ধর্মীয় এবং মানবিক বিধিবিধান মেনে চলে আল্লাহ্‌র রাস্তায় নিজেদেরকে উৎসর্গ এবং সমর্পিত করি। হে মহান আল্লাহ্‌ তুমি আমাদেরকে সহজ সরল পথে পরিচালিত কর। অন্যায় জুলুম এবং হারাম আয় থেকে বিরত রাখো। তুমি আমাদেরকে হালাল রুজি এবং খাদ্যের ব্যবস্থা করে দাও। যাতে একটা সুখী সুন্দর মানবিক সমাজে আমরা বসবাস করতে পারি।

0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ