ঘোষণায় বাঙলা ও ইংরেজীতে, কম্পিত ও আবেগস্পন্দিত কণ্ঠে স্পষ্ট করে বলা হয়, যদিও খুবই অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলো, যে মুজিব জীবিত আছেন, তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। মুজিবের পক্ষে ঘোষণা পাঠ
করছেন একজন মেজর, যাঁর নাম মেজর জিয়া। কে মেজর জিয়া? তাঁর নাম তো কখনো শুনি নি।

একটি ঘোষণাপাঠের ফলে, তাঁর কাঁপাকাঁপা কণ্ঠের আবেগ, মুহূর্তেই তিনি এক নতুন নায়ক হিশেবে দেখা দেন। অনেক সময় হঠাৎ কেউ কেউ অসাধারণ হয়ে ওঠেন, এজন্যে লাগে সুযোগ ও আকস্মিকতা। কেউ হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ বা মুজিব বা আইনস্টাইন হয়ে উঠতে পারেন না, কিন্তু কেউ কেউ হঠাৎ মেজর জিয়া হয়ে উঠে সারা দেশকে আলোড়িত করতে পারেন। এটা হঠাৎ আকাশে মহাগোলমাল থেকে উদ্ভুত নক্ষত্রের মতো। কিংবদন্তি সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে মুহূর্তেই, আকস্মিকভাবে, ঐতিহাসিক সুযোগে; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বা মুজিব বা আইনস্টাইন হওয়ার জন্য লাগে দীর্ঘ সাধনা।

ওই কাঁপাকাঁপা, অনভ্যস্ত, স্খলিত বাঙলা ও ইংরেজি ঘোষণাটির আগে আমরা কি কেউ জানতাম কে মেজর জিয়া? তাঁর কণ্ঠস্বর ও ঘোষণা আমাদের সঞ্জীবিত করেছিলো, কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে কোনো ধারণা ছিলো আমাদের?
কোনো ধারণা ছিলো না, কিন্তু মুহুর্তেই ধারণা হয়ে যায়, আমরা কল্পনায় একজন অদম্য তরুণ মেজর ও যোদ্ধাকে দেখতে পাই। তিনি যদি বলতেন, ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান বলছি’, তাহলেও তিনি এতোটা দাগ কাটতে পারতেন না, আমরা হয়তো একজন ক্লান্ত বুড়ো মেজরের কথা ভাবতাম, যে পদোন্নতি পায় নি, দেহে শিথিল হয়ে গেছে, কেননা ওইটিই বাঙালিদের জন্য স্বাভাবিক ছিলো পাকিস্তানে; মেজর ও জিয়া, এ-দুটি শব্দের সমাবেশ খুবই উদ্দীপক ছিলো। তবে এটি ছিলো এক
ঐতিহাসিক আকস্মিকতা ও সুযোগ, যাতে একজন সাধারণ মেজর অসাধারণ যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন, সারা জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। কিন্তু তিনি অপরিহার্য ছিলেন না, কালুরঘাটের বেতারযন্ত্রীরা যদি অন্য কোনো মেজরকে পেতেন, তাকে দিয়ে ঘোষণা করাতেন, তাহলে তিনিই হয়ে উঠতেন কিংবদন্তি।

কালুরঘাটের বেতারযন্ত্রীরা একজন মেজরকে খুঁজছিলেন কেনো?
তাঁদের মনে নিশ্চয়ই অনেক ভাবনা ছিলো; তাঁদের হয়তো ধারণা হয়েছিলো একজন মেজরকে দিয়ে ঘোষণা করালে সেটা বৈদ্যুতিকভাবে কাজ করবে। করেছিলও তাই। মেজর জিয়া হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের আকস্মিক কিংবদন্তি। এটা আর কারো ভাগ্যে জোটে নি। এর পর মেজর জিয়া কোন যুদ্ধাঞ্চলের প্রধান ছিলেন, কতোটা যুদ্ধ করেছিলেন, আদৌ করেছিলেন কি না, কতোটা দক্ষতা দেখিয়েছিলেন, তা আর মূল্যবান নয়; তাঁর থেকে হয়তো অনেকেই বেশী যুদ্ধ করেছিলেন, অনেক বেশী দক্ষতা দেখিয়েছিলেন, অনেকেই তো বরণ করেছিলেন মৃত্যু; কিন্তু তাঁদের পক্ষে মেজর জিয়ার মতো কিংবদন্তি হয়ে ওঠা সম্ভব ছিলো না; তাঁরা কেউ কালুরঘাট থেকে ঘোষণার ঐতিহাসিক আকস্মিক সুযোগটি পান নি। কালুরঘাট সৃষ্টি করেছিলো মেজর জিয়াকেঃ একটি কিংবদন্তিকে।

কিংবদন্তির মূল্য রাজনীতিতে, ধর্মে সাধারণের কাছে অত্যন্ত বেশি, কেননা তা ইন্দ্রজাল ও অলৌকিকতার মতো। সাধারণ মানুষ সত্য দিয়ে যতোটা আলোড়িত উদ্বেলিত হয়, তার থেকে অনেক বেশি আলোড়িত হয় কিংবদন্তি ও ইন্দ্রজাল দিয়ে। মেজর জিয়া পরে মেজর জেনারেল হয়ে ছিলেন, তবে মেজর জেনারেল জিয়ার থেকে মেজর জিয়া অনেক বড়ো; মেজর জিয়া কিংবদন্তি, আর মেজর জেনারেল জিয়া সামরিক বাহিনীর একজন উচ্চ সেনাপতি মাত্র। তিনি যে পরে এতো কিছু হয়েছেন, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, রাষ্ট্রপতি, একটি রাজবংশই প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, তার মূলে রয়েছে কালুরঘাট; এবং প্রাণ দিয়ে তিনি কিংবদন্তিটি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।

ট্র্যাজিক নায়কেরা স্মরণীয় হয়ে থাকেন ট্র্যাজিক পতনের জন্যেই। মেজর জিয়া এরশাদের মতো বিদূষক ছিলেন না; তাহলে তিনি এখনো বিদূষকের মতো বেঁচে থেকে কৌতুক যোগাতেন। তিনি ছিলেন ট্র্যাজিক নায়ক, যদিও ক্ষুদ্র মাপের, গ্রিক নয় বাঙালির আকারের, একটি রঙ্গমঞ্চে যিনি হঠাৎ আবির্ভূত হয়েছিলেন; তাঁর উত্থান ও পতন ট্র্যাজিক নায়কের মতোই, যদিও তাঁকে অনেকেই নায়ক মনে নাও করতে পারে। মনে করতে পারে তিনি ছিলেন ছোটোখাটো নায়কের মুখোশপরা, ছদ্মবেশী, মুখোশের ভেতরে ছিলেন ভিন্ন রকম, যা সবাই দেখতে পায় নি।

সারা ১৯৭১-এ যতো কিছু ঘটেছে, বিশ্বে বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যতো সংবাদ পৌঁছেছে, যতো প্রচার হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা যতো সেতু উড়িয়ে দিয়েছে, যতো পাকিস্তানি জন্তু বধ করেছে, যতো বাঙালি নিহত
হয়েছে, যতো নারী লাঞ্ছিত হয়েছে, আর আমরা স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছি, তার সবটাই মুজিবের নামে। অন্য কোনো নামে এটা ঘটতে পারতো না; অন্য কোনো নাম থেকে এ-প্রেরনা উৎসারিত হতো না। বাঙলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে পৌঁছে দিয়েছিলেন মুজিব, বন্দী থেকেও তিনিই নিয়ন্ত্রণ করছিলেন মুক্তিযুদ্ধকে, তিনিই সৃষ্টি করে চলছিলেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।

মুজিবকে আমরা প্রচণ্ড সমালোচনা করতে পারি, কয়েক দশক ধরে তো কোটি কোটি বামন প্রাণভরে তাঁর সমালোচনা করছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে তিনি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, বাঙলাদেশের মহাস্থপতি। মুজিব ছাড়া হাজার হাজার জিয়া বা অন্য কেউ মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিলেও মুক্তিযুদ্ধ ঘটতো না, তখন সেটা হতো হাস্যকর হঠকারিতা ও পরিণতিতে শোকাবহ; মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে আসতো না, এবং বিশ্ব আমাদের পক্ষ নিতো না, সাড়া দিতো না।

এটা ঘটেছিলো মুজিবের জন্যই। মুজিব বাঙলাদেশের স্থপতি, মহাস্থপতি; তিনি সৃষ্টি করে চলছিলেন বাঙলাদেশকে। তাঁকে ছাড়া বাঙলাদেশের কথা ভাবাই যায় না।

সুত্রঃ ইন্টারনেট থেকে নেয়া । লেখাটি ভালো লেগেছে বলে শেয়ার দিলাম ।

0 Shares

৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ