সালাম সাহেবের বড্ড হাঁসফাঁস লাগছে, অধিক তৃপ্তি সহকারে খাবার গলাধঃকরণের পরে যে অবস্থা হয় ঠিক তেমন। ঈদের আগে হাতে এবার টাকা এসেছে বেশ কিছু। যাক তাহলে কোরবানিটা ভালই হবে এবার- এ ভাবনা থেকে অধিক খুশিতে দুপুরে বেশ আয়েশ করে খানাপিনা করলেন তিনি। কিন্তু অস্বস্তি লাগছে যে আজ কেন বুঝতে পারছেননা।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার জন্য চোখ মুদেছেন; ভাত ঘুম দেবার বৃথা চেষ্টা কিন্তু ঘুম আসছেনা। মনে খুশির জোয়ার, আজ কোরবানির গরু কিনতে হাটে যাবেন তিনি। শুয়ে শুয়ে ছোট ছেলেটার কথা মনে পড়লো তার। বাবা এবারে আমাদের কোরবানির গরুটা যেন সবচেয়ে বড় হয়। তার স্ত্রী মালিহা বলেছেন- এই শোনো, পাশের বাসার ভাবীরা কিন্তু গতবারের চেয়েও এবার বড় গরু কোরবানি দিচ্ছেন মনে রেখো।

আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে- একথা বলে সেদিন সালাম সাহেব চুপ করে ছিলেন। সামনেই কোরবানির ঈদ, হাতে টাকা পয়সা না থাকলে বড় গরু এবারে কেনা হবে না। কিছু উপরি টাকাপয়সার ব্যবস্থা করতেই হবে। জেলা শহরে ঠিক ঢাকা শহরের মতো আয় রোজগার নেই, তবুও যা আসে নেহাত কম নয়। শুধু মাথাটাকে চালু রাখতে হয়, চোখ কান একটু খোলা রাখলেই টাকা আসে হাতে।

অবশেষে আজ হাতে টাকা এসেছে। যদিও একজনকে কিছু সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে টাকাটা এসেছে, তবে তিনিতো তার উপকারই করেছেন। যার উপকার করেছেন সে খুশি হয়ে এই মোটা টাকা সালাম সাহেবকে উপহার দিয়েছেন; এতে দোষের কিছু নেই।

-চাচামিঞা গরু কত?
বেশ বড় মাপের নাদুসনুদুস এঁড়ে গরু দেখে পছন্দ হলো সালাম সাহেবের। হাটে তিন ঘন্টা ধরে গোবর মাড়িয়ে পূর্ব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণ হেঁটেছেন তিনি, কিন্তু গরু পছন্দ হয়নি। পছন্দ হয় তো দাম মিলেনা, দাম মিলেতো রঙ পছন্দ হয়না। যখনই গরুর কাছে যান- কানে বাজে ছোট ছেলে আর স্ত্রীর সেই কথাগুলো। নাহ! সম্মান বাঁচাতে আজ বড় গরু কিনতেই হবে। সমাজে তার একটা ইজ্জত আছে। গরুর পাশে দাঁড়িয়ে এসব ভাবতে ভাবতে বুকের সেই চাপা অস্বস্তিটা আবার যেনো চেপে ধরলো।

- এক লাখ দশ হাজার। গরুর মালিকের উত্তর।
অবশেষে এক লক্ষ টাকায় দফারফা করে গরু কিনলেন সালাম সাহেব।খুশিতে তার আগড়ুম বাগড়ুম অবস্থা। রাস্তায় যেই গরুর দাম জিজ্ঞেস করেছে বুক টান করে করে তিনি তাকেই বলেছেন -এক লাখ, এক লাখ!

গরু নিয়ে বাসায় এসেছেন তিনি। স্ত্রী, ছেলে সবাই গরু দেখে মহাখুশি। মহল্লায় এবার তাদের গরুই সবচেয়ে দামী। গরু রাখার ব্যবস্থা করতে মিলতে বেশ রাত হয়ে গেলো। রাতের খাবার খেতে বসে কিছু গিলতে পারছেননা সালাম সাহেব। বুকের সেই চাপা অস্বস্তিটা বেড়ে উঠেছে। সমস্যা হচ্ছে কিছু একটা। তার সামান্য অম্লের ধাত আছে, ওষুধ খাওয়া হয়নি আজ! ভুলেই গিয়েছিলেন।

এসব চিন্তার মাঝখানেই টিংটং করে কলিং বেলের আওয়াজে সামান্য বিরক্ত হলেন সালাম সাহেব। এত রাতে কে এলো? নিজেই দরজা খুলে দেখেন সেই গরুর মালিক আর একটি ছোট ছেলে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।

-কি ব্যাপার তোমরা? আমি কি টাকা কম দিয়ে এসেছি?
- না স্যার, এইডা আমার ছেলে পল্টু। গরুটাকে আপনার কাছে বেইচ্যা দেওনের পর থাইকাই খুব কান্নাকাটি করতাছে শেষবারের মতন ওরে দেখবো বলে। আসলে আমার দুইটা সন্তান- একটা পল্টু আর একটা নান্টু। আমার নান্টুরে আইজ আপনের হাতে তুইল্যা দিছি স্যার!

সব কথোপকথন দরজার ওপাশ থেকে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন মালিহা। বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলে উঠলেন- উহ! গরীবের কত ঢং, অসহ্য।

তাদের কথা শুনে সালাম সাহেব অবাক হলেন কিছুটা। গ্যারেজে রাখা কোরবানির গরুটির কাছে তাদের নিয়ে যেতেই বাপ ছেলে দু'জনেই গরুর গলা জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো।

- গরুটাকে সামনাসামনি দেখেই গরুর মালিক বলতে লাগলো - নান্টু! ওরে নান্টুরে ভালো থাকিস বাপ আমার; মনে কিছু নিসনা। কুরবানীর সময় খুব কষ্ট হইবো তর; ছুড়ি দেইখা ডরাইসনারে বাপ। আল্লাহ্‌ তর ভাগ্যে এইডাই লিখছিলো; সব গরুরেতো এই সম্মান দেয় নাই। তুই চইল্যা যাইবি তয় তর ভাই বল্টু আর এই বাপে কোনদিনও তরে ভুলবো না। ভালো থাকিস ব্যাটা!
সালাম সাহেব লক্ষ্য করলেন- গরুটার চোখদুটোও যেন অশ্রুতে একটু ভেজা ভেজা!

এসব শুনতে শুনতে সালাম সাহেবের চোখেও পানি চলে এসেছে। আহ! তিন বছর ধরে সন্তানের আদরে লালন করা গরুটিকে তারা আজ বিক্রি করেছে আমার কাছে, তাদের জন্য এ যে বড্ড শোকের ক্ষণ। গরুর মালিক আর তার ছেলে চলে যাওয়ার সময় সালাম সাহেব তাদের হাতে কিছু টাকা দিলেন খুশিমনে। পল্টুকে কিছু কিনে দিও আর কাল দুপুরে এসে খেয়ে যেও তোমরা কেমন? একথা বলে তাদের বিদায় দিলেন।

এবার সালাম সাহেব নিজেও অনুশোচনায় ভুগতে আরাম্ভ করলেন। কোরবানি কি আসলেই লোক দেখানো? সমাজে নিজেকে বড় দেখাতে উপরি ইনকামের পয়সায় যে কোরবানি তিনি দিতে চেয়েছিলেন সেই গরুতো অন্যের কাছে প্রিয় ছিলো। অথচ ছোটবেলা থেকে পাওয়া শিক্ষা - কোরবানি দিতে হবে সৎ উপার্জন থেকে এবং প্রিয় বস্তুকে সৃষ্টিকর্তার নিকট ত্যাগের মহিমায়, সেটি তিনি ভুলতে বসেছেন কি করে?

স্ত্রী মালিহাকে ডেকেও এসব বললেন তিনি। আর কথা বলতে বলতেই হঠাৎ মেঝেতে পড়ে গেলেন! মালিহার চিৎকারে আশেপাশের প্রতিবেশীরা অনেকেই ছুটে আসলেন সে সময়।

আজ ঈদের দিন, সালাম সাহেবের বাসায় শোকের ছায়া। গতকাল রাতে তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। হাসপাতালের আইসিইউ-তে ভর্তি আছেন। কাঁচের দরজার বাইরে থেকে ছল ছল নয়নে বিছানায় শোয়া বাবার দিকে চেয়ে আছে সালাম সাহেবের ছোট ছেলেটি।

মালিহার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে আগেই। তিনি ভাবছেন- আজ সবাই কোরবানি দিচ্ছে অথচ তারা এখন হাসপাতালে! কোরবানির গরু নিয়ে কত শখ ছিল ছেলেটার। তিনি নিজেও মনে মনে খুশিতে ভাসছিলেন- পাড়ার সবচেয়ে বড় কোরবানিটা আজ তাদের বাড়িতে হবার কথা ছিলো। কিন্তু বিধাতার লিখন খন্ডানো বড় দায়! মানুষের সাধ্য নেই তা খণ্ডানোর।

এবার মালিহা নিজেও অনুশোচনায় দগ্ধ হলেন। ছেলেটিতো ছোট, অবুঝ! কিন্তু তিনিতো মূর্খ নন। সময়ের তাড়নায় তিনি ভুলে গিয়েছিলেন কোরবানির মহত্ব। নিজের নাম জাহির করবেন বলে যে কোরবানি দিতে চেয়েছিলেন সেই লোক দেখানো কোরবানি উপরওয়ালাও সহ্য করলেন না!

মালিহা মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন- সালাম সাহেব সুস্থ হলে কোরবানির জন্য কেনা গরুটাকে তিনি কোরবানি দেবেন পরম যত্নে। লোক দেখানো মানসিকতায় নয়, মন থেকে নিজের প্রিয় পশুটিকে তিনি উৎসর্গ করবেন সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে।

এমন চাওয়াই হোক আমাদের সকলের। নিজের কোরবানির পশুর যত্ন নিন, পরম মমতায় তাঁর মাথায় একটুক্ষন হাত বোলান। মন থেকে একটু ভালোবাসুন তারপর কোরবানি দিন। ভালোবাসার জিনিস নিঃস্বার্থভাবে বিসর্জন দিতে পারা, ত্যাগ করা- এটাইতো কোরবানির মহত্ব।

আমাদের সবার মনে এই আত্মোপলব্ধি আসুক। ভাল থাকুন সুস্থ থাকুন। সবাইকে ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা রইলো।

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ