কতইবা বয়স তখন আমার! মাত্র তিন বছর বয়সে মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন অজানার দেশে, না-ফেরার দেশে। সে মায়াময়ী মুখটি সারা জীবন চেষ্টা করেও স্মরণ করতে পারি নাই। তাই ছবিটাও আঁকা সম্ভব হয় নাই। শুধু এতটুকু মনে আছে, ডাক্তার এসে মাকে দেখে একটা ইঞ্জেকশন পুশ করলেন। তার কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘরের মধ্যে সবাই কাঁদতে শুরু করলেন। কেউ একজন আমাকে কোলে নিলেন। এক সময় মায়ের জন্য রান্না করা দুধ-শাগু আমাকে খেতে দিলেন। মৌলভী সাহেব বাড়ির ঘাটায় গাছের শীতল ছায়ায় খোলা জায়গাটায় বসে লম্বা একটা সাদা কাপড় টুকরা টুকরা করে দিলেন। মাকে ঘরের পিছনে নিয়ে গেলেন কয়েক জন। তাকে গোসল করালেন। মৌলভী সাহেবের টুকরা কাপড় দিয়ে মাকে মুড়িয়ে দিল। বাড়ির উত্তর পশ্চিমকোণে নদীর ধারে কবর খুঁড়লেন। কবরের ভিতর পানি জমে আছে। থালা বাটি দিয়ে সেই পানি সেঁচে তার উপর কলাপাতা বিছিয়ে মাকে শুইয়ে দিয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দিল উপস্থিত সবাই।
আমি কী তখন কেঁদে ছিলাম? না সে কথা আমার মনে নেই। পরবর্তী দিনগুলো কীভাবে অতিবাহিত হয়েছে তাও বলতে পারব না। তবে একটি কথা মনে আছে, চাচী একদিন আমাকে কোলে নিয়ে যাচ্ছিলেন তাদের বাড়িতে। সেই মূহুর্তে বলেছিলেন কাঁদলে তোকে কোলে নিব না। সত্যি কী সেদিন আমি কেঁদেছিলাম? না স্মরণ করতে পারছি না। তবে আজ এবং যখনই সেই মুখটা স্মরণ করতে চেষ্টা করেছি তখনি যে কেঁদেছি তা হলফ করে বলতে পারি।
যখন কিছু কিছু বুঝতে শিখেছি পাড়ার ছেলে মেয়েদের সাথে তাদের বাড়িতে গেলে মায়ের আদর সোহাগ দেখে পিছনে থেকে কী পরিমান অশ্রু ঝড়িয়েছি সে হিসেব আমার জানা নেই। সে কান্না আমাকে সুখ দিয়েছে কি-না সেকথা বলতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারি এই অশ্রু ধারায় আমি কখনও ক্লান্ত হইনি বা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করিনি। বরং মাকে আবিস্কারের আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছি। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন আমার চোখের এই অশ্রু যেন জমে থাকে, আমি যেন ঝড়িয়ে যেতে পারি তার জন্য সৃষ্টি কর্তার নিকটা প্রার্থনা জানাচ্ছি।
তোমরা কী কেউ বলতে পার, মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ কেমন? মায়ের বুকে মাথা রেখে ঘুমানোর সুখের রঙ কী? অথবা মায়ের শাসন কী খুব কঠিন, অসহনীয়, না কী মমতায় ভরা বেহেস্তি সুখ?
জানি না আজ সকাল থেকেই মাকে কেন এত মনে পড়ছে এবং অশ্রুগুলো অধর পেড়িয়ে জিহ্ববায় লবনাক্ত ছড়াচ্ছে! বুকের ভেরত কেন এত তোলপাড় হচ্ছে। কেন আমার বুকটা এত ভারী লাগছে। কেন বারবার মুছেও অশ্রুধারাকে রোধ করতে পারছি না।
জীবনে কতবার আল্লাহর নিকটা প্রার্থনা করেছি, হে আল্লাহ্ একবার, শুধু একবার মাকে স্বপ্নে দেখাও। আমি যেন সেই মুখখানা স্মরণ করতে পারি, পারি আমার হৃদয়ের সেই কুঠিরে ধারন করতে যেখানে আমি ব্যতিত আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু সে আশা আজও আমার পূরণ হয়নি। তাই সেই অপূর্ণতাই একমাত্র সঙ্গী আমার, সাথে লোনাজল।
১২টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
কষ্টের লেখা মনে কেন চোখে জল আসতে বাধ্য।
কিছুই বলতে পারছিনা।
দাদু ভাই
@মোঃ মজিবর রহমান, ধন্যবাদ
আসলে কিছুই লিখতে পারিনা তাই নিজের কথাই লিখে দিলাম। ভাল থাকবেন।
শুন্য শুন্যালয়
মা আছে তাই জানিনা মা ছাড়া পৃথিবী কেমন?
লেখাটা পড়ে বুকে হাহাকার করে উঠলো ..
দাদু ভাই
@শুন্য শুন্যালয়,
যাহার যাহা নেই সে সেই জিনিস বেশী করে চায়। আমিও তার ব্যাতিক্রম নই ;(
জিসান শা ইকরাম
মায়ের শুন্যতা কল্পনাই করতে পারিনা । তিন বছরেই মাকে হারানো শিশুর কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে । মায়ের ছবি চলে আসুক আপনার মনে ।
এখনো আমি মায়ের কাছে থাকি দাদু ভাই ।
দাদু ভাই
@জিসান শা ইকরাম,
মায়ের যেন কোন অসুবিধা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। আল্লাহ তার রিওয়ার্ড দিবেন।
ছাইরাছ হেলাল
আপনার বেদনা কিছুটা হলেও বুঝতে পারি ।
অবশ্যই স্বপ্নে হলেও আপনি আপনার মায়ের দেখা পাবেন ।
দাদু ভাই
@ছাইরাছ হেলাল,
ধন্যবাদ। দুঃখী-জনই দুঃখ বুঝে। আল্লাহ আপনার সহায় হউন। আমীন ..
মা মাটি দেশ
যার যা নাই বুঝে হারাবার ব্যাথা কি (y) ভাল লিখেছেন।
দাদু ভাই
@মা মাটি দেশ , ধন্যবাদ পড়ে মন্তব্য করার জন্য। ভাল থাকুন এই কামনা করি।
নীলকন্ঠ জয়
🙁 মা এর জন্য কষ্ট পাওয়াটা অনেক বেদনার। এই শুন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। প্রার্থনা মায়ের জন্য।
দাদু ভাই
@নীলকন্ঠ জয় , আমার কাছে এই কষ্ট এখন মধুময়। যতই অশ্রুবানে ভাসি ততই ভাল ভালে। যতদিন বেঁচে থাকি এই অশ্রুধারা যেন বন্ধ না হয় সে কামনা চাই। ভাল থাকবেন