বোধহয় নব্বই সালের দিকে হবে । ঢাকাতে মাওলানা সাহেবেরা একটা মিছিল বের করেছিলেন । ওটাকে খণ্ড মিছিল বলা যাবে না । ওলামায়ে কেরামেরা তো অংশ নিয়েছিলেনই । তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল আরও প্রায় হাজার দেড়েক মাদ্রাসার ছাত্র । সকলেই এক হিন্দু ভদ্র লোকের ফাঁসির দাবি করছিল । মিছিলটা দেখে আমার খুব কৌতূহল জন্ম নিয়েছিল । সেই বায়তুল মোকারমের কাছ থেকে পেছন পেছন অনুসরণ করে প্রেসক্লাব অবধি এসেছিলাম । কেন এসেছিলাম তার একটা কারণ আছে সাধারণত মাওলানা সাহেবানরা যখন কারো ফাঁসির দাবি করেন আপনি নির্ঘাত জেনে যাবেন ওই ব্যাক্তিটি হবে মুসলমান । আমার বয়স পঞ্চাশ হল ।ঢাকা শহরে আছি ত্রিশ বছর । এই ত্রিশ বছরে কম করে হলেও মাওলানা সাহেবদের এক শ'টি ফাঁসির দাবির মিছিল দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে । প্রতিটা মিছিলেই আমি লক্ষ করেছি মাওলানা সাহেবরা যে হারামজাদাটিকে ফাঁসিতে লটকাবার দাবি জানাচ্ছেন তিনি একজন মুসলিম সন্তান । ফজলুর রহমান , বজলুর রহমান , সালমান রুশদী আহমেদ শরীফ , কবির চৌধুরী কতো নাম করব । মাওলানা সাহেবেরা মাঝে মাঝে কিছু কিছু মুসলিম সন্তানকে ফাঁসিকাষ্ঠে চড়াবার দাবিতে মিছিল করেন এই ব্যাপারটির সঙ্গে আমি একরকম অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম ।
কিন্তু এই মিছিলটিকে খুবই অবাক হয়ে দেখলাম তাঁরা একজন হিন্দু ভদ্র লোককে ফাঁসিতে লটকাবার কথা বলছে । এই হিন্দু সন্তানের এতো কি সৌভাগ্য যে মাওলানা সাহেবেরা তাঁকে ফাঁসিতে দেয়ার দাবিতে মাঠে নামতে পারেন ? সেজন্য মিছিলটার পেছন পেছন আমি প্রেসক্লাব অবধি আসছিলাম ।
প্রেসক্লাব এসে আমি শ্মশ্রুহীন একজন মাদ্রাসার ছাত্রের সঙ্গে আলাপ করি । তার সঙ্গে আমার যে বাতচিৎ হয়েছিল সেটা এখানে বয়ান করি ।
আমি খুব বিনয় সহকারে জিজ্ঞাসা করেছিলাম , হজরত , আপনারা কোন হিন্দুর ফাঁসি চাইছেন ? এবং কেন? উনি খুব চেতে গিয়ে বললেন , আপনি এখনো খবর পান নি । আমি অপরাধ স্বীকার করে বললাম , না এখনো খবর টা পাইনি । তিনি জানালেন , এক হারামজাদা হিন্দু আমাদের নবীর নামে খারাপ কথা লিখেছে । তার জন্য ফাঁসি না চেয়ে কি জেল চাইব ? আমি বললাম , জেল চাওয়াটা ঠিক হবে না । ফাঁসি হল আসল জিনিশ । মেহেরবানী করে নামটা বলুন । তালেবে এলেমটি থেমে থেমে বললেন , নগেন্দনাথ , নগেন্দ্রনাথ হওয়াই উচিৎ । তালেবে এলেম রফলাটি উচ্চারণ করতে পারেননি বলেই নগেন্দনাথ হয়ে গেছে।
আমি 'নগেন্দনাথ' বলে কোন হিন্দু লেখকের নাম শুনিনি । সুতরাং যাকে চিনিনে-জানিনে এমন মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মাওলানা সাহেবরা যদি নবী করিমের ইজ্জত রক্ষা করতে চান আমার কি এসে যায় । আমি হাঁটতে হাঁটতে পাবলিক লাইব্রেরীতে চলে এসেছিলাম । লাইব্রেরিয়ান ছিলেন আমার বন্ধু । কথায় কথায় ফাঁসির প্রসঙ্গটি আমি উত্থাপন করি । লাইব্রেরিয়ান সাব আমাকে জানালেন , আপনি জানেন না নগেন্দ্রনাথ বসু অনেকদিন আগে এনসাইক্লপিডিয়া ইসলাম সম্পর্কে অথবা ইসলামের এনসাইক্লপিডিয়া এই শিরোনামে একটি কিতাব লিখেছিলেন । ঐ ভদ্রলোক ১৮৮৪ সালে ইন্তেকাল করেছেন । হালে ঐ কিতাবটি কোলকাতায় নতুন করে ছাপা হয়েছে এবং তা মাওলানা সাহেবদের কারো চোখে পরেছে । তাই এই মিছিল , তাই এতো আওয়াজ , তাই এই নিঃশর্ত ফাঁসির দাবি । মানুষটা বেঁচে আছে কিনা সেটা ভেবে দেখার কথাও কারো মনে এল না । একটি মৃত মানুষকে ফাঁসি দেওয়ার দাবিতে দেড় হাজার লোক জোগাড় করা , মাইক জোগাড় করা সে কি চাট্টিখানিক কথা বিষয়টি নিয়ে আমি সিরিয়াসলি চিন্তা করতে থাকি । আমাদের দেশের মুখ চেনা ভদ্র লোকেরা এগুলোকে মৌলবাদী ক্রিয়াকাণ্ড বলে চিহ্নিত করতে পারলে দায়িত্বমুক্ত মনে করেন । কিন্তু এরকম সাদা - কালো স্তরবিন্যাস করতে আমার মন চায় না । আমি ভেবে - চিন্তে যে সিদ্ধান্তে এসেছি সেই জিনিসটা নিবেদন করতে চাই ।
আমাদের ধর্মান্ধ মানুষেরা - তাঁদের মধ্যে কিছু পরিমাণ মোল্লা - মৌলানা আছেন , যে - কোন ছুতানাতায় , পান থেকে চুন খসে গেলে যে - কোন আদম সন্তানকে ফাঁসিতে লটকাতে চান তার কারণ একটিই । এই সমস্ত মানুষের মনে আত্নহননের চিন্তা সব সময় ক্রিয়াশীল থাকে । তাঁদের শিক্ষা - দীক্ষা জাগতিক চাওয়া পাওয়া জগত এবং জীবনের প্রতি দৃষ্টি ভঙ্গির মধ্যেই এই মৃত্যুকীটটি লালিত - পালিত হয় । মানুষ সংঘবদ্ধ ভাবে অপরের মৃত্যু যখন কামনা করে , মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে এটা এক ধরনের আত্নহননের চিন্তা । যেই মানব বর্গ শয়নে স্বপনে আত্নহনন চিন্তায় বেস্ত থাকে তাঁরা যে কোন হুজুগেই অপরের মৃত্যু কামনায় মেতে উঠতে পারে এবং এটাকে একটা পবিত্র ধর্মীও কর্তবের লেবাস পরাতেও কুণ্ঠিত হন না । প্রফেশনাল মনস্তাত্ত্বিকরা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন জানি না । আমি যখন এক দল লোককে যত্র তত্র ফাঁসির দাবিতে উম্মত্ত হয়ে উঠতে দেখি সেই জিনিশটাকে মানুষের আত্নধ্বংশি প্রবণতার একটা রকমফের হিসেব বলে মনে করি । আসলে তাঁদের নিজেদেরকেই ধ্বংস করার চিন্তা সতত প্রবাহমান । কিন্তু সাহসের অভাবে সেটি করতে পারছেন না তাই অপরের মৃত্যু কামনায় সবান্ধবে এমন মুখর হয়ে উঠতে পারে ।
দুদিন আগে কাগজে দেখলাম বাবা শাহজালালের পুণ্যভূমি সিলেট শহরের মাদ্রাসার ছাত্ররা মিছিল করে সরকারের কাছে ডেডলাইন বেঁধে দিয়েছে । সরকার যদি তসলিমা নাসরিনকে ফাটকে না ঢুকায় এবং ড,আহমদ শরীফ ,প্রোফেসর কবির চৌধুরী এবং পিচ্চি নাস্তিক দ,সাইদুর রহমানকে গ্রেফতার না করেন তাহলে আগামী ১০ কিংবা ১১ তারিখে সিলেট শহর তাঁরা অচল করে দেবেন । আমি সরকার চালাইনে। সুতরাং তসলিমার ভাগ্যে কি ঘটবে আমি জানি না । তসলিমা নাসরিন একটা বই লিখেছেন । আমি একমত হইনি । প্রতিবাদ করেছি এবং আরও প্রতিবাদ করব । তাঁকে জেলে ঢুকাতে হবে , শাস্তি দিতে হবে এরকমের কুৎসিত চিন্তা ঘুনাক্ষরেও মগজে উদয় হয়নি । মাওলানা সাহেবেরা লঘুগুরু সব ধরনের অপরাধে একই শাস্তি বিধান করে থাকেন আর সেটা হল মৃত্যুদণ্ড । এমন কি ইসলামী শরিয়াতেও ঘোরতর অপরাধীকেও বিচার করে শস্তি দিতে হয় । সুফিকুল শ্রেষ্ঠ হজরত মুনসুর হাল্লাজকেও (র,) বিচার করে কোতল করা হয়েছিল । যে বিচার হয়েছিল , সঠিক হয়েছিল কিনা সে ব্যাপারে কথা থাকতে পারে । কিন্তু বিচার একটা হয়েছিল । মাওলানা সাহেবেরা বিনা বিচারে যখন তখন যাকে তাঁকে শাস্তি দিতে চান , ফাঁসি দিতে চান , এর ভেতর কোন ইসলাম থাকতে পারে আমি এটা আমি বিশ্বাস করি না ।ইসলামী বিধান অনুসারে বিচার করা হলে ইসলামের ধ্বজাধারী অনেক তথাকথিত মোল্লার পাগড়ী এবং মুণ্ডু কনটা অক্ষত থাকার কথা না । আমি সেসব দিকে যাবো না । আমার ধারনা জনগনের একটা অংশের ওপর মাওলানা সাহেবদের যেহেতু প্রভাব আছে সে জন্যই তাঁরা কোন রকম চিন্তা না করেই এই ডণ্ডের কথা উচ্চারণ করেন । যেহেতু তাঁরা জানেন , যা-ই বলবেন একদল মানুষ তাঁদের পেছনে সব সময় জান করবান করার জন্য পাবেন । এটা ইসলামের বিধান নয় । এই ধরনের চিন্তা চেতনার মধ্যে ইসলামী শরিয়াতের চাইতে বেক্তিগত আস্মিতার ভাব প্রবল । এগুলো আসলে আত্নহনন চিন্তারই নামান্তর । এই সমস্ত কর্ম যারা করে তাদেরকে গাল দিয়ে কিংবা নিন্দা করে তাঁদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে একথা ঠিক নয় । খুন করলেও এটা বন্ধ করা যাবে না । যে মনের থেকে এই জাতীয় চিন্তা - চেতনার জন্ম হচ্ছে যে মনটির
শুশ্রূষা করে যদি আরোগ্য করা না যায় আমরা কেউ তার হাত থেকে রেহাই পাব না ।

উৎস বইঃ প্রবন্ধ সমগ্র , তৃতীয় খণ্ড (৭৬-৭৮ পৃষ্ঠা )

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ