আকিজ বিড়ি

অভি ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪, রবিবার, ০৫:৩৭:০৮অপরাহ্ন অন্যান্য, গল্প, সাহিত্য ২১ মন্তব্য

(১)

অন্ধকার এতো অন্ধকার হতে পারে শিলা কোনদিন জানত না। ঘুট ঘুটে অন্ধকার। হাত পা কেন যেন অবশ হয়ে আছে। অবর্ণনীয় ব্যথা সারা দেহে, মনে হচ্ছে যেন কেউ হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে যাচ্ছে। মাথায় প্রচন্ড ব্যথা। কয়েক বছর বা যুগ আগের কথা ছাড়া কিছুই মনে পরছে না! যতই ভাবছে মাথা থেকে একটা ভোতা যন্ত্রণা যেন সারা শরীরে ছড়িয়ে পরছে। চোখ খুলে দেখবার চেষ্টা করেও কিছুই দেখতে পারছে না! চোখ আদৌ খুলেছে কিনা সেটাও বুঝছে না শিলা। দমও যেন বন্ধ হয়ে আসছে। ভাবতে ভাবতেই জ্ঞান হারালো শিলা।

জানালার পাশে বসে, আকাশের কোনে আস্তে আস্তে জমে ওঠা মেঘগুলোর মত..। কোনো একদিন আমি বা আমার ভাই অথবা বাবা বা মা। আসলে মুহূর্তটা এমনই। জীবনটাও হয়ত রং বদলায় কিন্তু আসলে এমনই। অনেকটা ছোট্ট চিনা জোকের মত।"মাথাটা সরু করে আস্তে আস্তে অবলম্বন খোজা"। ভীষণ বৃষ্টি হবে। ধীরে ধীরে জমা মেঘ কালচে হয়ে আসছে। অনেকটা সাদা জামাগুলোতে দেবার জন্য অল্প একটু নীল মিশাতে গিয়ে অনেকটা ঢিপ করে পানিতে পরে যাওয়া...ঘন নীলে পনি একাকার! জল গাড় নীল। নীল আকাশ হারিয়ে যাচ্ছে কালো আধারে! কোনো কোনো পরিবর্তন ক্ষনস্থায়ী, আর কিছু আটকে থাকে জীবনের প্রতিটা বাকে বাকে। "অবলম্বন পেয়ে জোকের মাথাটা আস্তে আস্তে মোটা হওয়া।" ভীষণ বৃষ্টি!

কয়েক যুগ পরে যেন জেগে উঠলো শিলা, ফোটা ফোটা পানি গড়িয়ে পরছে শিলার মুখে। প্রচন্ড তৃষ্ণা, শিলা জিহ্বা দিয়ে ওই পানিটুকু ধরবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। পানিতে কাদার গন্ধ। হাত পা এখনো আরস্ঠ হয়ে আছে! অন্ধকার এখনো কাটে নি, ভোর হবে কখন? কাদাপানি খেয়ে যেন কিছু শক্তি পেল শিলা। পা দুটো শক্ত করে আটকে আছে কোথাও। শিলা মনে করবার চেষ্টা করলো কোথায় সে? অল্প বাতাসে সে খুব বেশি ভাবতে পারল না!

একটি বল নিয়ে চারটি ছেলের হুটোপুটি। বল রেখে কাদায় লাথি; ঝপাত ..হাঃ হাঃ হাঃ। আবার দৌড়| আবার লাথি। আবার ঝপাত... গো. ও . ও . ও . ল!! আর একটা কিশোর জানালার সমান্তরালে। বৃষ্টির উদ্ভ্রান্ত ফোটাগুলো ভিজিয়ে দিচ্ছে কিশোরকে! কিছুই যেন যায় আসে না। মিলেমিশে যাচ্ছে চোখে, প্রশ্রয় হাসিতে, আবার কখনো অক্ষমতায়। কখনো এই সময়ে, কখনো আগের প্রজন্মে! মুহুর্তগুলো এমনই..। "জোকটা অবলম্বন পেলো আরেকটা ডালে..আবার সরু দেহ!" ভীষণ বৃষ্টি। ওদের চিত্কার আর বৃষ্টির শব্দ মিলেমিশে একাকার। গোল!! আর এক কিশোরের পেন্সিল ঘুরে ঘুরে মানুষ হচ্ছে। কিশোরের মন বৃত্তিক হয়ে গেছে! পেন্সিলের আচরে আর নতুন কিছু হচ্ছে না। খাতাটা ওদের মত কাদায় জড়াজড়ি!

হাতদুটো আটকে ছিল একদলা মাটির মধ্যে, অনেক কষ্টে হাত দুটো মুক্ত করতে পারল শিলা। হাত দিয়ে চারপাশটা ছুয়ে দেখে মনে হচ্ছে অর চারপাশে মাটি, ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল মেরুদন্ড বেয়ে। সে কোথায়? এ কেমন দুঃস্বপ্ন! হাতড়ে হাতড়ে মাথার দিকে একটা ছোট ফাটল খুঁজে পেল।

বৃষ্টি কমে আসছে, একটানা ঝির ঝির। ছেলেগুলো চলে গেছে। আর একটা সময়... এক কিশোরী কাঠের গ্রিল ধরে বড় বড় চোখে আটকে থাকা এক সময়ে! টিনের চাল বেয়ে একটা একটা পানির ফোটা, মাটিতে নতুন একটা গর্ত, গর্তটা আরো গভীর..অনেকটা কিশোরীর গালের হাসির টোল। যত হাসছে ততই গভীর। মধ্যমাটায় একটা লাল ফিতা মোটা হচ্ছে, আবার খুলে যাচ্ছে! কাদামাখা একদল ফুটবলার বল নিয়ে পুকুরে যাচ্ছে! তার মধ্যে ভিসন দুরন্ত তার মেঝোভাই, কাদাভুত। সেই খাতাটার স্কেচের মত নাকে মুখে! "লাল ফিতাটা খুলে গেল!" মেয়টি দেখছে খাতাটার মত নক্সা ওদের গায়ে! একে একে ঝাপিয়ে পুকুরে, এক নতুন খেলা। আর টলমলে জল হয়ে যাচ্ছে ভীষণ ঘোলা! কাদাভুত, আর মেঘে কালচে আকাশ!

জোরে জোরে দুটো লম্বা নিশ্বাস নিয়ে পা দুটোতে যতটুকু শক্তি অবশিষ্ঠ ছিল তা দিয়ে ধাক্কা দিল, ঝুর ঝুর করে মাটি ঝরে পরা শুরু করলো শিলার পেটে বুকে। প্রচন্ড ভয় আর বেচে থাকবার তীব্র ইচ্ছা, শিলা টের পেল পা দুটো যেন মুক্ত হয়ে এসেছে। খুব সাবধানে উপুড় হয়ে গেল, সামনে আগানই একমাত্র উপায়।

(২)

মেঘ কেটে যাচ্ছে, কাদা ফুটবলের বিজয়ী প্যাচপ্যাচে কাদা পেরিয়ে ইটের রাস্তায়! নতুন ইট বসানো রাস্তায়, ইটের ফাক দিয়ে উঠে আসা কালচে পানি কালো নক্সা করে দিচ্ছে তার পা! কাদাভুত ভাবছে... উল্টো দিকে মুখ করা ইটের দিকে পা দেয়া যাবে না! ছোট ছোট লাফ দিয়ে এগিয়ে চলছে। তার বাবা দেখে ফেলেছে তাকে ভীষণ আক্রমনাত্মক এক গোল দিতে! চিন্তিত কাদাভুত বল নিয়ে ঝোপের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলছে। "জোকটা অবলম্বন খুঁজে পেলো, খুব সন্তর্পনে চুষতে লাগলো"।

মাটি পরা বন্ধ হতেই দ্রুত হাতে মাটিগুলো সরিয়ে ফেলছে, মাটি যেন এক অভিশাপ। হামাগুড়ি দিয়ে ফাটলের দিকে এগিয়ে গেল সে, যদি কিছু দেখা যায়, ঠান্ডা বাতাসের একটা ঝাপটা যেন পেল! পাগলের মত পুরো বাতাসটুকু গিলে ফেলতে চাইল শিলা। ফাটলে দুই হাত রেখে আসতে আসতে মাটি সরানোর চেষ্টা করল সে। ছোট ছোট টুকরো আর নরম মাটি বের করে এনে ঢিলার মত গোল করে পায়ের দিকে ছুড়ে মারত লাগলো। হামাগুড়ি দিয়ে পিছনে ছুড়ে মারা অনেক কঠিন, তার উপরে শরীরে খুব বেশি শক্তি অবশিষ্ট আছে বলে মনে হচ্ছে না! কয়েক ঘন্টা বা কয়েক যুগ চলে গেল যেন, ফাটলটা একটু বড় হয়েছে, শিলা একটু এগিয়ে গেল হামাগুড়ি দিয়ে। তার শরীরের নিচ দিয়ে পানির একটা ধারা সামনের দিকে যাচ্ছে। যেন পথ দেখাচ্ছে।

এক ফালি রোদ উঠেছে! পেন্সিলের আচরে এক অপ্সরী কিশোরের খাতায়! ফুলে ফুলে ওঠা গাল লজ্জায় লাল! সে জানে না এই অপ্সরী কে, সে জানে তাকে সে ভীষণ ভালবাসে! "জোকটা চুষছে..!!" মেঘগুলো ঝিম মেরে বসে আছে| বৃষ্টিটা আবার সুরু না হয়!

হাতের আঙ্গুলগুলো অবশ হয়ে আসছে, শিলা জানে তার থামা চলবে না। সে এগিয়ে যেতে চায় যত দ্রুত সম্ভব, নখে প্রচন্ড ব্যথা, হয়ত নক ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। ভিজা কাদা আর রক্ত মিলে মিশে একাকার! অন্ধকার, স্যাতস্যাতে গর্ত আর অপ্রতুল বাতাস সহজেই ক্লান্ত করে ফেলছে তাকে, শিলার মনে হচ্ছে যেন সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে। তারপরও হাতদুটো শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছে। হঠাত হাতে যেন শক্ত কিছু পড়ল, দ্রুত হাতে আর একটু মাটি সরাতেই গাছের শিকড়ের মত কিছু একটু সামনে পড়ল। শক্ত হাতে ধরে সামনে আগানোর একটু চেষ্টা করতেই শিকড়ের নিচের মাটি সরে যেতে লাগলো। ধসে পরা মাটির সাথে শিলা গড়িয়ে পরে যেতে লাগলো অতল নরকে। শিকড়ের নিচে অদ্ভুতভাবে একটা সুরঙ্গর মত গর্ত তৈরী হয়ছে অনেক দিন ধরে, একমাথা থেকে শিলা মাত্র ধসে গড়িয়ে পরেছে, অন্য পাশটা নদীর দিকে খোলা, বাইরে থেকে ঠিক দেখা যায় না। ঠান্ডা বাতাসে দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে জ্ঞান হারালো শিলা।

ছেলেটা দৌড়চ্ছে দৌড়চ্ছে| ছপ ছপ ছপ ছপ| দুটো বড় লাফ দিলেই উঠোন! উঠোনের শেওলা জমা ইটে এক পা, থেতলে যাওয়া শেওলা! লাল ছোপ ছোপ নক্সা তার হাতে পায়ে!

সকালের সূর্য উঠে গেছে, শিলা ক্লান্ত শরীর টেনে বের হয়ে আসলো নদীর ঠান্ডা পানিতে। চিত্কার করে কাদতে গিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। দূর থেকে কাদের যেন চিত্কার শুনলো, আবার জ্ঞান হারাবার আগেই তাকে তুলে নিল কিছু শক্ত হাত!

(৩)

শিলা বেচে আছে অলৌকিক ভাবে। গত পরশু বিকেল থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না! জানালা থেকে বাইরে তাকিয়ে মনে করবার চেষ্টা করছিল কি হয়েছিল তার। প্রতিদিন সন্ধায় সে কাজ শেষ করে নদীর পার ধরে হেটে বাড়ি ফেরে, সেদিন একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল, বেশ অন্ধকার। বড় বটগাছটা পের হবার সময় দুটো মানুষ অন্ধকার থেকে হঠাত বের হয়ে এসে তার হাত মুখ চেপে ধরে ঝোপের আড়ালে নিয়ে যায়, পাশবিক খেলায় মেতে ওঠে দুই যুবক। গভীর রাতে শিলার অচেতন দেহ নিয়ে কি করা যায় তা নিয়ে তর্ক করে দুই যুবক।

একজন পাহাড়ায় থাকে, অন্য জন শাবল নিয়ে আসে, গভীর রাতে নদীর পারে কবর খোরে দুই যুবক। কবরে শিলা কে শুইয়ে দিয়ে বিড়ি ধরায় দুই বন্ধু।

খাতায় আর একটা নক্সা! ছেলেটার লাল নক্সা, কাদাভুতের কালচে নক্সা, আর কাদাভুতের বোনেরও! একই নক্সা...কিন্তু ব্যবধানটা সীমান্তের বা সময়ের!

হঠাত শিলা খুব পরিচিত আকিজ বিড়ির গন্ধ পায়!

- অভি
এলোমেলো ভাবনার বসতি

0 Shares

২১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ