২০১৪ সনের জুন মাসে প্রকাশিত একটি লেখা এখানে শেয়ার করছি।আমরা অনেক কিছুই জানি না,অথচ বাংলাদেশের সব জনগনের এসব জানা উচিত।কেবল মাত্র যারা আওয়ামী লীগ করেন তারাই শুধু এসব জানবেন তা নয়। দেশকে জানতে হলে ইতিহাসকেও জানতে হবে নির্মোহ ভাবে।

১৯৪৯-এর ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে মুসলিম লীগ ভেঙে প্রথমে ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’, চার বছর পর ‘মুসলিম’ বাদ দিয়ে যে ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক পাকিস্তানে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সূচনা করেছিল সেটি বর্তমানে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’।
বিশ্বের মানচিত্রে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধপূর্ব বাংলাদেশের ২৩ বছরের গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার অর্থ রামকে বাদ দিয়ে রামায়ণ রচনার মতো। শুধু বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়া নয়, সমগ্র এশিয়ার ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রামের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় সৃষ্টি করেছে। একটি নিয়মতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল প্রয়োজন হলে দেশ ও জাতিকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পারে- এশিয়ার রাজনৈতিক দর্শনের ইতিহাসে এর দ্বিতীয় নজির নেই।
এশিয়ায় আওয়ামী লীগের মতো ব্যাপক গণভিত্তিসম্পন্ন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল আরও আছে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, তুরস্কের রিপাবলিকান পিপলস পার্টি, আরব বিশ্বের বাথ পার্টি এবং ইন্দোনেশিয়ার ডেমোক্রেটিক পার্টি স্বাধীনতার সংগ্রামে এবং ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং নেতা হিসেবে স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে একটি স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন এবং একটি জাতির মানস নির্মাণের ক্ষেত্রে যে অবদান রেখেছেন এ বিষয়ে সমকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে কমই লেখা হয়েছে। এর বড় কারণ হচ্ছে- ৬৫ বছরের একটি প্রাচীন দল, ভাষা আন্দোলনের সূচনা থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য অনন্যসাধারণ সংবিধান রচনার মতো বিশাল সব অর্জন থাকা সত্ত্বেও এই দলটির বস্তুনিষ্ঠ পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এখনও লেখা হয়নি। যার ফলে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম শুধু নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অবদান সম্পর্কে খুব কমই জানে।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে গত ৪৩ বছরে আওয়ামী লীগ চারবার ক্ষমতায় এসেছে। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু এবং চার জাতীয় নেতার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর অধিকাংশ সময় বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শাসিত হয়েছে পাকিস্তানপন্থী স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও সামরিক বাহিনীর দ্বারা। তারপরও চৌদ্দ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার পরও আওয়ামী লীগ দলের ইতিহাস লেখার কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অথচ ভারতের জাতীয় কংগ্রেস, তুরস্কের রিপাবলিকান পার্টি অথবা আরব বিশ্বের বাথ পার্টির শতাধিক ইতিহাস লেখা হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়।
আওয়ামী লীগের সচেতন কর্মী, এমনকি অনেক নেতাও বলতে পারবেন না বর্তমান বাংলাদেশের ভৌগোলিক মানচিত্রের বাইরে রাজনৈতিক দল হিসেবে অন্য কোথাও আওয়ামী লীগের কোনও কার্যক্রম ছিল কি না। ২০০১ সালের এপ্রিলে প্রথম বারের মতো পাকিস্তান সফরে গিয়ে আমি জেনেছি মুক্তিযুদ্ধপূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থান এবং অন্যান্য কর্মতৎপরতা সম্পর্কে। মুক্তিযুদ্ধের আগে বাংলা ভাষায় আওয়ামী লীগের দলীয় মুখপত্র প্রকাশিত হয়েছে ১৯৬৯ সালে ঢাকা থেকে ‘বাংলার বাণী’ নামে, যার সম্পাদক ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। অথচ উর্দু ভাষায় আওয়ামী লীগের মুখপত্র প্রকাশিত হয়েছে ‘বাংলার বাণী’ প্রকাশের ১২ বছর আগে পেশোয়ার থেকে ‘বাঙ্গে হারাম’ নামে, যার সম্পাদক ছিলেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মাস্টার খান গুল।
আমি যখন এই পত্রিকার খোঁজে পেশোয়ার যাই তখন মাস্টার খান গুল বেঁচে নেই। আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মোস্তফা কামালের, যিনি পিতার মৃত্যুর পর তাঁর প্রকাশনা সংস্থার হাল ধরেছেন। আমার প্রথম পাকিস্তান সফরের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছি ‘পাকিস্তান থেকে ফিরে’ নামক গ্রন্থে। এই গ্রন্থের একটি অধ্যায়ের শিরোনাম ‘পাকিস্তানে ছয় দফা, বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ।’ মোস্তফা কামালের সঙ্গে আমার কথোপকথনের কিছু অংশ এই অধ্যায় থেকে উদ্ধৃত করছি-
‘অত্যন্ত স্বাদু কাহবার কাপে চুমুক দিয়ে প্রথমেই জানতে চাইলাম, মাস্টার খান গুল সত্তরের নির্বাচন কিভাবে জিতলেন।’
মোস্তফা কামাল বললেন, ‘না, নির্বাচনে তিনি জিততে পারেননি। তবে সত্তরে পশ্চিম পাকিস্তানে যারা নৌকা নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, মাস্টার খান গুল তাঁদের ভেতর সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন। খুবই সামান্য ভোটের ব্যবধানে হেরেছিলেন তিনি।’
‘ইসলামাবাদে আমাকে পেশোয়ারের এক যুবক বলেছে মাস্টার সাহেব নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন।’
‘পেশোয়ারের অনেকে এখনও মনে করে সত্তরের নির্বাচনে তিনিই জয়ী হয়েছিলেন।’
‘তাঁর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে আপনি কী জানেন বলুন।’
‘প্রথম জীবনে অর্থাৎ তিরিশের দশকে তিনি খান আবদুল গাফফার খানের খোদাই খিদমতগার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই সময় এই অঞ্চলের প্রগতিশীল তরুণদের সকলেই এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ব্রিটিশবিরোধী, সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক সংগঠন ছিল সেটি। পাকিস্তান হওয়ার পর মাস্টার সাহেব আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন। সাতান্ন সালে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে মওলানা ভাসানী, ওয়ালি খান, মিয়া ইফতেখাররা যখন ন্যাপ করেন তখন মাস্টার সাহেব আওয়ামী লীগে থেকে যান। তখন থেকে তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। সাতান্ন সাল থেকেই ‘বাঙ্গে হারাম’ প্রকাশ করতে থাকেন। উর্দু এই দৈনিকটি ছিল প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের মুখপত্র। বিশেষ করে ছেষট্টি সালে শেখ মুজিব যখন লাহোরে তাঁর বিখ্যাত ছয় দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন মাস্টার সাহেব ছয় দফার সমর্থন করে প্রচুর লিখেছেন তাঁর পত্রিকায়। তিনি একা নন, ছয় দফার পক্ষে তখন অনেকেই এই পত্রিকায় লিখেছেন।
10857915_814515451972186_7846401473497139850_n‘ছয় দফাকে বলা হতো বাঙালির মুক্তিসনদ। আপনারা কোন যুক্তিতে ছয় দফা সমর্থন করেছিলেন?’
‘আমরা ছয় দফাকে বিবেচনা করেছি পাঞ্জাবী শাসকচক্রের বিরুদ্ধে আন্দেলনরত বাঙালী, পশতুন, বালুচি ও সিন্ধী জাতির মুক্তিসনদ হিসেবে। পাকিস্তানে তখন থেকেই ফেডারেল রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। ছয় দফা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান একটি জাতিরাষ্ট্র নয়। পাকিস্তানে অনেক জাতিসত্তা রয়েছে, যাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস সব ভিন্ন। এসব জাতিসত্তাকে এক রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় ধরে রাখতে হলে ফেডারেল সরকার ব্যবস্থার কোন বিকল্প নেই।’
‘সত্তরের নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করা তো খুব কঠিন ছিল। মাস্টার সাহেবের নির্বাচনী বক্তব্য কী ধরনের ছিল?’
‘তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকা খড়ক-এ খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি বলতেন এই নির্বাচনে জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ জিতবে, শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। মুজিবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে আমি সীমান্ত প্রদেশের গবর্নর হব। এবার ঠিক করুন আপনারা একজন গবর্নর চান না একজন এমএনএ চান। মাস্টার সাহেবের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পিপিপির আসলাম খটক। বিশাল বড়লোক, সামন্ত ভূস্বামী। এদিকে মাস্টার সাহেবের প্রকাশনা ব্যবসা ছাড়া আয়ের আর কোন উৎস ছিল না। তবু তিনিই জিততেন। শেষ মুহূর্তে ওয়ালি ন্যাপ বিশ্বাসঘাতকতা করে পিপিপিকে সমর্থন করায় তিনি জিততে পারেননি।’
‘ওয়ালি ন্যাপকে তো আমরা প্রগতিশীল দল হিসেবে জানি। তারা এ কাজ কেন করল?’
‘তারা তখন ভুট্টোকে মনে করত সমাজতন্ত্রী হিসেবে। যেখানে তাদের প্রার্থী ছিল না সেখানে তারা পিপিপিকে সমর্থন করেছে।’
‘একাত্তরে আপনার বাবা কোথায় ছিলেন?’
‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এবং অন্য সব নেতারা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিলেন।’ (পাকিস্তান থেকে ফিরে, অনন্যা, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি, ২০০২)
‘দৈনিক বাঙ্গে হারাম’-এর দশ বছরের বাঁধানো কপি আছে লাহোরে বাংলাদেশের অকৃত্রিম সুহৃদ কবি ও সাংবাদিক আহমদ সেলিমের ব্যক্তিগত আর্কাইভ-এ। সেলিমের আর্কাইভে দেখেছি ১৯৬৬ সালে লাহোরের যে সভা থেকে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেছিলেন তার আমন্ত্রণপত্র। সেলিম এখন দুরারোগ্য ক্যান্সারে ভুগছেন। তাঁর অন্তিম ইচ্ছা উর্দু ভাষায় তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের ইতিহাস লিখবেন। ইতোমধ্যে তিনি বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নিয়ে উর্দুতে দুটো বই লিখেছেন।
দশ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে কারা বাংলাদেশের সুহৃদ ছিলেন তাদের খুঁজে বের করবার জন্য দ্বিতীয়বার পাকিস্তান যাই। তখন জানতে পারি মুক্তিযুদ্ধের সময় অল্প কিছুসংখ্যক পাকিস্তানী রাজনীতিবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকার কর্মী বাংলাদেশে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার গণহত্যার প্রতিবাদ করে বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হয়েছেন, গ্রেফতার হয়েছেন, জরিমানা দিয়েছেন, সামরিক আদালতে বেত্রাঘাত প্রাপ্ত হয়েছেন।
করাচীতে পরিচয় হয়েছিল এ্যাডভোকেট জাভেদ কাজীর সঙ্গে, যার পিতা ফয়েজ কাজী নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশ- সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (বর্তমান খাইবার পাখতুনখোয়া)-এ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামো সম্প্রসারণ এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির পক্ষে জনমত সংগঠনের ক্ষেত্রে ফয়েজ কাজী, মাস্টার খান গুল, খলিল তিরমিজি প্রমুখ সিন্ধী, বেলুচ ও পশতুন নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
১৯৭০-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশে জেলা পর্যায়ে, কোথাও মহকুমাতেও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম বিস্তৃত ছিল। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতা পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম তদারক করতেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশে দিতেন।
10433157_814514605305604_2114954906206625482_nবাঙালীদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক পাঞ্জাবী শাসকগোষ্ঠীর জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছিল অত্যন্ত প্রবল। মুনতাসীর মামুন ও জয়ন্ত কুমার রায়ের ‘প্রশাসনের অন্দরমহল’ গ্রন্থে এই ঘৃণা ও বিদ্বেষের প্রচুর ঘটনা ও বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে। এই সব ঘৃণা ও বিদ্বেষ সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বত্র আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামো বিস্তারের প্রধান কারণ হচ্ছে সংগঠক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বিস্ময়কর দক্ষতা। তিনি জানতেন পাঞ্জাবী শাসক চক্রের দাম্ভিকতা, বৈষম্যনীতি এবং স্বেচ্ছাচারী মনোভাব সম্পর্কে সিন্ধী, বালুচ ও পশতুন ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠী কম ক্ষুব্ধ নয়। তাদের এই ক্ষোভ সংগঠিত করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু এসব জাতিগোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।
সিন্ধের জিএম সৈয়দের জাতীয়তাবাদী চেতনা বঙ্গবন্ধুকেও উৎসাহিত করেছিল। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় আওয়ামী লীগের স্লোগান ‘জয় বাংলা’ মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনিতে পরিণত হয়েছিল। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের প্রেরণা এসেছে জিএম সৈয়দের ‘জিয়ে সিন্ধ’ আন্দোলন থেকে। বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদী চেতনা জিএম সৈয়দকেও প্রবলভাবে উজ্জীবিত করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি সিন্ধের নাম পরিবর্তন করে ‘সিন্ধুদেশ’ রাখার প্রস্তাব করেছিলেন এবং এ নামে একটি গ্রন্থও রচনা করেছেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সিন্ধী চিত্রনির্মাতা সাবিহা সুমার ‘হোয়ার পিকক ডান্সেস’ নামক প্রামাণ্যচিত্রে সিন্ধের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কীভাবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে তার উল্লেখ করে বলেছেন, কেন বঙ্গবন্ধু সফল হয়েছেন এবং কেন জিএম সৈয়দ সফল হতে পারেননি। এ বিষয়ে পশতুন আওয়ামী লীগ নেতা মাস্টার খান গুলের পর্যবেক্ষণের কথা আমার ‘পাকিস্তান থেকে ফিরে’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছি। আওয়ামী লীগের ৬ দফা শুধু বাঙালী জাতির মুক্তিসনদ ছিল না। পাকিস্তানের অপরাপর নির্যাতিত ও বঞ্চিত জাতিসমূহেরও মুক্তিসনদ ছিল ৬ দফা।
11130138_814515538638844_2065248918606280526_n১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিস্তার যেমন সিন্ধ, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল, একইভাবে নির্বাচনে নৌকার নিরঙ্কুশ বিজয়ের সম্ভাবনায় দলে দলে সাধারণ মানুষ শুধু নয়, উচ্চ মধ্যবিত্ত, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরাও আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন। তারপরও পশ্চিম পাকিস্তানের কোথাও আওয়ামী লীগের না জেতার প্রধান কারণ ছিল নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে ভুট্টোর পিপিপি এবং ওয়ালি খানের ন্যাপের অলিখিত সমঝোতা। পশ্চিম পাকিস্তানের যে সব নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল সেখানে এই প্রবল দুই পক্ষ একত্রিত হয়ে আওয়ামী লীগকে হারিয়েছে। পিপিপির নির্বাচনের প্রধান ইস্যু ছিল আওয়ামী লীগ বিরোধিতা। পশ্চিম পাকিস্তানের ভোটারদের পিপিপি এটা বোঝাতে পেরেছিল- আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে পাকিস্তান ভেঙে যাবে। অপর দিকে ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসে যারা ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ (ন্যাপ) গঠন করেছিলেন তাদের সাধারণ মূল্যায়ন ছিল ৬ দফা সিআইএ-র নির্দেশে প্রণীত হয়েছে, আওয়ামী লীগ আমেরিকার দালাল। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন নিশ্চিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রতি ‘ন্যাপ’-এর এই মূল্যায়ন অপরিবর্তিত ছিল। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ন্যাপপ্রধান ওয়ালি খান এবং মীর গাউস বক্স বিজেঞ্জো বঙ্গবন্ধুকে এটি বোঝাবার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন- পাকিস্তান না ভেঙে কোনও রাজনৈতিক সমাধানে আসা যায় কি না। তবে ’৭১-এর ২৫ মার্চ বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর পাকিস্তানী সামরিক জান্তার ক্র্যাকডাউন, নজিরবিহীন গণহত্যা এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে প্রহসনের বিচারের উদোগের প্রতিবাদ করেছে ওয়ালি-বিজেঞ্জোর ন্যাপ। এই প্রতিবাদের মাশুল দিতে গিয়ে বহু ন্যাপ নেতাকে জেলে যেতে হয়েছে এবং ’৭১-এর আগস্টে ন্যাপ’ নিষিদ্ধ হয়েছে। ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার এবং আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
11156407_814515891972142_7351249196136322025_nপাকিস্তানের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন আওয়ামী লীগের ৬ দফা এবং ’৭০-এর নির্বাচনের রায় মেনে নিয়ে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের দায়িত্ব দেয়া হত তাহলে পাকিস্তান ভাঙত না এবং পাকিস্তানের এত দুরবস্থা হতো না। এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণেরও যথেষ্ট অবকাশ আছে। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থগোষ্ঠী আওয়ামী লীগকে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে দিত না। বঙ্গবন্ধুও জানতেন আজ হোক কাল হোক বাংলাদেশকে পাকিস্তানের নাগপাশ থেকে বের করে আনতে না পারলে বাঙালীর মুক্তি নেই। যে কারণে প্রকাশ্যে ৬ দফা ঘোষণা করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিকাশ ঘটিয়ে যেভাবে তিনি স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে গেছেন, এর পাশাপাশি ১৯৬১ সাল থেকে দলের ভেতর নিউক্লিয়াস গঠন করে গোপনে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন, যার অন্যতম অভিব্যক্তি হচ্ছে ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের যে কজন রাজনীতিবিদ, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকার কর্মীকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান করেছে তাদের ভেতর আওয়ামী লীগ নেতা ফয়েজ কাজী ও মাস্টার খান গুলের নাম আছে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ফয়েজ কাজীর। আমার করাচী সফরকালে কাজী সাহেবের কনিষ্ঠ পুত্র পাকিস্তানের বিশিষ্ট মানবাধিকার নেতা জাভেদ কাজী তার পিতাকে লেখা বঙ্গবন্ধু, কামারুজ্জামান, মালেক উকিল ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাদের কয়েকটি চিঠির কপি দিয়েছেন। বেশির ভাগ চিঠি বঙ্গবন্ধুর। এসব চিঠিতে পশ্চিম পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামো কীভাবে বিস্তৃত করতে হবে, বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে আওয়ামী লীগের কী অবস্থান সে সব তুলে ধরা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় এসব চিঠিতেও রয়েছে।
আওয়ামী লীগের তরুণ নেতৃত্বকে জানতে হবে কীভাবে বঙ্গবন্ধু স্বায়ত্তশাসনের ৬ দফা দাবিকে স্বাধীনতার ১ দফা দাবিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। কীভাবে আওয়ামী লীগকে তিনি এবং তাঁর সহযোদ্ধারা একটি জাতির মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানের যোগ্য দল হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। জানতে হবে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে বঙ্গবন্ধুর দুঃসাহসী নেতৃত্ব, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার ইতিবৃত্ত। জানতে হবে একটি সাম্প্রদায়িক ও সামন্তদের দল মুসলিম লীগ থেকে কীভাবে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আওয়ামী লীগের উত্থান ও বিজয় ঘটেছে। আওয়ামী লীগের আরেকটি অসামান্য অবদান হচ্ছে ১৯৭২-এ প্রণীত বাংলাদেশের অতুলনীয় সংবিধান। ভবিষ্যতে আরও বিজয় অর্জনের জন্য আওয়ামী লীগের অতীতের অর্জন, সাফল্য ও ব্যর্থতার বস্তুনিষ্ঠ নির্মোহ ইতিহাস প্রণয়ন জরুরী হয়ে উঠেছে।

আওয়ামী লীগের ইতিহাসের অগ্রন্থিত অধ্যায়:এটি লিখেছেন শাহরিয়ার কবির।লেখার লিংক

দুর্লভ ফটো গুলো গুগল থেকে নেয়া।

0 Shares

১১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ