পর্বতকন্যের ইতিকথা

প্রদীপ চক্রবর্তী ২৪ জুলাই ২০১৯, বুধবার, ০৮:১১:১২অপরাহ্ন উপন্যাস ১৭ মন্তব্য

পর্ব_১

রায়বাহাদুর খেতাব টা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বেশ কদিন ধরে ঝগড়াঝাঁটি চলছে। বলরাম দাদা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সাংসদ। তাঁর মাথায় পাহাড়সম চিন্তার ভাঁজ। অতীতে যিনি রায়বাহাদুরের পদবীতে ছিলেন তিনি কয়েকবছর আগে দেহত্যাগ করেছেন।
যদিও উনার পরবর্তী বংশের প্রদীপ কেউ নেই।
যে কিনা আলো হাতে রায়বাহাদুরের পদটা বজায় রাখবে। গ্রামেগন্জে,পাড়ায়,মহল্লায় দিনবর মিছিল মিটিং। বিশেষ করে বলরাম দাদা রায়বাহাদুর পদের আমেজটা বেশি। যদিও বলরাম দাদা এই পদের প্রতি তেমন একটা ভাবাপন্ন নয়।
বলরাম দাদা আমার জ‍্যাঠতুতো ভাইয়ের বন্ধু হন। সেই হিসেবে বলরাম দাদা আমার বড় তাই বলরাম দাদা বলে ডাকি।
উনি প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন। ছোটবেলায় উনার সাথে পাশের বাড়ির নিকুঞ্জ বাবুর পুকুরে সাঁতার শিখেছি। ওনার কথাগুলো আমার কাছে বেশ রসাত্মক ছিলো। যা রস দিয়ে বর্ণনা করতেন। এককথায় উনার সাথে আমার শৈশবের অনেক স্মৃতি জড়িত।
বলরাম দাদা আমাদের বাড়ি থেকে যাওয়ার পূর্বে আমাদেরকে নিমন্ত্রণ করে গিয়েছিলেন উনার বাড়িতে যাওয়ার জন্য।
হঠাৎ করে একদিন আমি আর আমার মামাতো ভাই বিনোদভূষণ ঠিক করলাম যে আমরা দুজন মিলে বলরাম দাদার বাড়ি যাব।

তাই দুজনি কাপড়চোপড় সবকিছু ঠিক করে নিলাম।
সকাল থেকে ঘনঘন বৃষ্টি তারমধ্য আকাশপানে হঠাৎ করে ব্রজপাত। শীতের দিনে এসব বৃষ্টি আর ব্রজপাত তা প্রায় যুক্তিহীন।
যাই হোক অনেক দিন পর একটা নিমন্ত্রণ পেলাম।
আর আমি এই নিমন্ত্রিত অতিথি হতে পেরে বেশ আনন্দিত।
অতিথি হিসেবে কেউ খারাপ কিছু খাওয়াবে না রাজভোগ খাবার থাকবে। এ নিয়ে আমার আর আমার
মামাতো ভাই বিনদভূষণ কোন চিন্তা নেই। ঠিক মত খাবার পেলে হয়েছে। দুজন অতিথি হিসেবে বেশ ভালো খাবার খেতে পারব।
তাই আমি আর বিনোদ চললাম বলরাম দাদার বাড়ি।
প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে কলকাতায়।

#পর্ব_২

কলকাতার পার্ক মিউজিয়াম অতিক্রম করে বলরাম দাদার বাড়ি। নৈশভোজের আমন্ত্রিত অতীতের মধ্য আমি আর আমার মামাতো ভাই বিনদ।
আমাদের সাথে ছিলো বলরাম দাদার জন্য শ্রীহট্রের ঐতিহ্যবাহী চোঙা পোড়া আর পদ্মার ইলিশ।
সারাদিন ট্রেনে মাথা হেলিয়ে দুলিয়ে ঘুমানো আর শীতের দিনের শিশিরজলে মগ্ন বিলাসে কেটে দিলাম এক প্রহর। ধীরে ধীরে বলরাম দাদার বাড়িতে পদার্পণ। যাওয়ার পর আমাদের দেখে বলরাম দাদা আনন্দে আত্মহারা। বলা যেতে পারে সোনায় সোহাগা।
রাত্রি তখন প্রায় বারোটা খেয়েদেয়ে আমি আর মামাতো ভাই বিনদ ক্লান্ত।
তাই দুজনের ঘুমানো প্রযোজ্য।
হঠাৎ করে নতুন কোন এক জায়গায় যাওয়ার পর রাত্রিবেলা ঘুম আসবে না তা স্বাভাবিক।
কিন্তু আমাদের প্রতি বলরাম দাদা সেবাশুশ্রূষার কমতি নেই। আমরা বেশ ভাগ‍্যবান।
বিনদ ঘুমিয়ে পড়লো প্রায় কুম্ভকর্ণের মত। তার মতে যেখানে রাত সেখান খাত। আর আমি অতন্দ্র প্রহরী। বিছানায় শুয়েশুয়ে এ যেন আমি বলরাম দাদার বাড়ি পাহারা দিচ্ছি।
বলরাম দাদার বাড়ির পাশে কালি মন্দির ভোরবেলা বেঁজে উঠেছে কাসর ঘন্টা আর শঙ্খধ্বনি। কাসর ঘন্টা আর শঙ্খধ্বনিতে এই পল্লীর সকলের ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমাদেরও তাই।
আমি আর বিনদ দু'জনে ঘুম থেকে উঠে পড়লাম।
যদিও আমাদের দেশে প্রাতক্রিয়ার তেমন একটা প্রচলিত নেই। তবুও তা বাঙ্গালির ঐতিহ্য।
তাই আমি আর বিনোদ বলরাম দাদার সাথে বাড়ির কয়েকজন মিলে চললাম প্রাতঃক্রিয়ার উদ্দেশ্য। প্রাতক্রিয়া প্রায়ই শেষ বলরাম দাদার ধানক্ষেতের আইলের মধ্য। শীতকাল এমনিতেই প্রচুর টান্ডা তারমধ্য জলের অভাব। বলরাম দাদার বাড়ি থেকে দুঘটি জল নিয়ে এসেছিলাম তা দিয়ে কি আর এতসব লোকের শৌচ কাজ হয়? তাই এদিকওদিক শৌচ কাজের জন্য জল খুঁজছিলাম। আর যাই হোক ভাগ্যক্রমে শিশিরজল দ্বারা শৌচ কাজটা সেরে নিলাম।
জল যে প্রচুর টান্ডা তা বলার মত না। শৌচ কাজ করতে গিয়ে বিনোদ একটু পরপর চিৎকার বলে উঠে উফঃউফ এত ঠান্ডা! বলরাম দাদা বিনোদ কে বলছেন এই যে বিনোদ শুনো শৌচকাজে এমন করে চিৎকার দিতে নেই।
যাই হোক ধীরে ধীরে চললাম বলরাম দাদা বাড়িতে। সেখানে গিয়ে খেজুরের রস আর ছানার আমৃত্তি ইত্যাদি ইত্যাদি সকালবেলার খাবারটা বেশ জমলো।
বলা যেতে পারে রাজ আসনে রাজভোগ বলরাম দাদার বাড়িতে। আমার থেকে বিনোদ খাওয়াদাওয়া সবসময় সকলকিছুতে এগিয়ে।

#পর্ব_৩

পরেরদিন প্রাতক্রিয়া শেষ করে। প্রাতকালীন খাবার খেয়েদেয়ে চলে গেলাম বলরাম দাদার সাথে কলকাতার হাবড়ার পুল দেখতে।
সেখানে গিয়ে দেখা হলো বলরাম দাদার বাল্যবন্ধু শ্রীধামের সাথে। উনার কথাবার্তা শুনে আমার বেশ ভালো লাগলো। আর ভাবলাম উনিও যে বলরাম দাদার মত বেশ হাস্যরসাত্নক লোক হবেন। সহজেই যাকে তাকে হাসিয়ে তুলেন।
চারদিকে তখন শীতের আমেজ আর মাস কয়েক পর রায়বাহাদুর পদের নির্বাচন। ভোটের মাটে নেতার আর জনতার ভিড়। হলি গলিতে বইছে চায়ের কাপের চমুতে নেতা জনতার যোগদান আর শ্লোগানে মুখরিত পাড়া আর শহর। বেশ রোমাঞ্চকর লাগছে।
ভোটের মাঠে আমরাও হাজির। ভোটের মাঠে এসে বলরাম দাদা বললেন দেখি আজ কে কত কাপ চা খেতে পারে। এ কথা শুনে বিনোদ হুট করে বলে উঠলো দাদা আমি পনেরো থেকে কুড়ি কতক চা খেতে পারব!
এই কথাশুনে আমি আর বলরাম দাদার বাল্যবন্ধু শ্রীধাম অবাক!! এ কেমন কথা পনেরো থেকে কুড়ি কতক কাপ চা খাওয়া যেই সেই কথা। আমি বিনোদ কে বললাম এই এসব বলছিস কি? সে আমায় বলে উঠলো দাদা ভয় পেয়ো না। একে একে ফ্রিতে শুরু হলো চায়ের কাপে চুমু।
এক মঞ্চ থেকে অন্যমঞ্চে চা খেতে খেতে বিনোদ বলরাম দাদাকে বললো দাদা আমার তো প্রায় ১৪ কাপ চা খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে। আর কোথাও নেতা জনতার মঞ্চ নেই যে আর ফ্রিতে চাওয়া খাওয়ানো হবে। চোখ ফিরিয়ে বলরাম দাদা দেখলেন সত্যিই তাই আর কোথাও মঞ্চ নেই। বলরাম দাদা বিনোদ কে বললেন থাক ভাই অনেক হয়েছে জানতাম না তুই যে এত করে চা খেতে পারিস।
দুপুর টা বিনোদের চা খাওয়া দেখে দেখে কাটিয়ে দিলাম। তারপর চলে এলাম বিনোদ দাদার বাড়িতে।
স্নান আহ্নিক করে মধ্যাহ্ন ভোজন শেষকরে বিছানায় একটু আরাম আয়েশ নিচ্ছি। শুয়ে শুয়ে শরৎচন্দ্রের শ্রেষ্ট উপন্যাস দেবদাস পড়ছি। ধীর গতিতে যৌবনের দিকে পদার্পন করছি। কোন মেয়ে যদি স্বয়ংবরা হয় তাহলে প্রথমে আমার দিকে নজর পড়িবে তাহাতে সন্দেহ মাত্র নেই।

#পর্ব_৪

বিনোদ দাদার বাড়িতে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে মেয়ে একজন। আমন্ত্রিত অতিথিদের কে বরণ করে নেওয়ার জন্য বাড়ির মার্জার পন্ডিত এগিয়ে।
তখন আমি দেবদাস উপন্যাসের অষ্টম অধ্যায়ের কিছু অংশ পড়ে উক্ত উপন্যাসের শ্রেষ্ট নায়িকা পার্বতীকে নিয়ে ভাবছি। যদি তার প্রেমিক হতাম। আমার ভাগ্যের ললাট যে গঙ্গা ভাগীরথীর মত স্রোতস্বিনী।
তাই পার্বতীর সাথে আমার ভাগ্যদেবতা প্রজাপতি কৃপা বর্ষণ হবে বলে মনে হয় না।
যাই হোক দেবদাসের পার্বতীকে নিয়ে আমার ভাবনার কিছুই নেই। একদিকে শীতের আমেজতায় উত্তপ্ত দুপুরবেলা ভানু দাদা অগ্নিশর্মা হয়ে আছেন।
একটু উষ্ণ লাগছিল তাই হস্তে তালের পাখা নিয়ে নির্যাস বাতাস করছি।
পাশের ঘরে ভিন্ন ধরনের আলপোনা আঁকা বাড়িতে আসা আমন্ত্রিত মেয়েটি এইসব আলপনা দেখার জন্য ব্যস্ত। কিন্তুু মেয়েটির চোখ দুটি আঁকাবাঁকা।
আমাকে দেখার জন্য সে খুবি ব্যস্ত! বাড়িতে আসা মেয়েটি যাতে আমায় না দেখতে পারে তাই আমার মুখখানা উপন্যাস দিয়ে ডেকে রাখলাম।
যাতে করে বাড়িতে আসা মেয়েটির দৃষ্টি না পড়ে আমার উপর।
পূর্বে বসন্তের গুটিকতকে আমার মুখখানা বিশ্রী। তাই মুখ দেখানো আমার প্রতি বাধ্যবাধকতা ছিলো না।
হঠাৎ করে মেয়েটির চোখ পড়লো আমার দিকে।
মেয়েটি বার বার আমার দিকে থাকায় কিন্তুু চেয়ারা দেখাতে পারি না। সে যখন আমার সামনে আসে তখন আমি পিছপা দেই। মেয়েটি আমার মুখ না দেখতে পেরে আমায় বলে উঠলো তোমার মুখ আমি দেখব দেখবই।
মেয়েটি এই কথা বলে চলে গেলো পাশের কামরায়।
আমি প্রায় হতবাক মেয়েটি হয় তো দৃড় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সে একদিন না একদিন আমার মুখ দেখবেই।

#পর্ব_৫

আজ রাতেই বলরাম দাদা উদয়পুরে যাত্রাপালায় অভিনেতার পাঠ রাখবেন। বলরাম দাদা আমাকে আর বিনোদ কে বললেন উনার সাথে যেতে।
তখন বাড়িতে আসা মেয়েটি বলরাম দাদা কে বলে উঠলো আমিও যাব দাদা আপনার সাথে। বলরাম দাদা মাথা নাড়িয়ে বললে হ্যাঁ প্রকাশ করলেন। আর আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। মেয়েটি নিশ্চয় আমাকে দেখার জন্য ইংরেজদের মত করে ফন্দি চালাচ্ছে।
রাত্রি তখন প্রায় ১১:৪৫ মিনিট। আমরা চললাম সবাই বলরাম দাদার সাথে। আমাদের সাথে করে মেয়েটির বাবা মা। মঞ্চে দেশ বিদেশ থেকে অনেক আমন্ত্রিত অতিথি। তাদের মধ্য বিশেষ করে আমি,বিনোদ এবং বলরাম দাদার বাড়িতে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে মেয়েটির বাবা মা।
শুরু হয়েছে যাত্রাপালা। বলরাম দাদা অভিনেতার পাঠ করছেন। তাকে দেখার জন্য উৎসুক জনতা। আর হৈ হুল্লাড়ে ভরপুর কনকনে শীতের রাত।
শীতের রাতে চাদর দিয়ে মুখ মুড়িয়ে বসে আছি আমি। আমার পাশে মেয়েটির বাবা মা তার ঠিক পেছনে মেয়েটি। মেয়েটির চোখ কিন্তু আমার দিকে একটু বেশি। কেননা সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আমার মুখ দেখবেই।
মেয়েটির বাবা মামা আমার পরিচয় নিলেন।
কি করি কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব পরিচয় দিতে গিয়ে মনে মনে ভাবলাম প্রজাপতির কি চিহ্নচাপ আমার ললাট পড়েছে।
যাত্রাপালা প্রায় শেষাংশে। বিনোদ উৎসক জনতার মধ্যে। তারমধ্য চলছে আমন্ত্রিত অতিথিদের আদর অভ্যর্থনা আমাদের প্রতি তা যেন কমতি নেই।

.

ক্রমশ..

0 Shares

১৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ