অদ্ভুত আঁধার এক – ২

রিমি রুম্মান ৩০ মার্চ ২০২০, সোমবার, ০৯:২০:৩৭পূর্বাহ্ন সমসাময়িক ১৪ মন্তব্য

বাড়ির সামনে উঠোনের গাছে প্রতিবারের ন্যায় এবারও ম্যাগনোলিয়া ফুল ফুটেছে। গাছটি বেলকণির একেবারে লাগোয়া হওয়ায় ডালগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেলিং এর ফাঁক ফোকর গলিয়ে ভেতরে এসে গেছে। পুরো গাছ ফুলে ফুলে গোলাপিময়। অন্যবারের চেয়ে এবার শীত কিংবা তুষারপাত কম হওয়ায় গাছে গাছে একটু আগেভাগেই ফুল ফুটতে শুরু করেছে। ম্যাগনোলিয়া ঝরে যাবার পর পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা চেরি গাছে ফুল ফুটবে ঝাঁকিয়ে। ফুলের ভারে প্রতিবার গাছটি নিচের দিকে নুয়ে আসবে। একেবারে ঠিক আমাদের নাগালের মধ্যে নেমে আসবে গোলাপি কৃষ্ণচূড়া। চেরি ফুলকে আমি ‘ গোলাপি কৃষ্ণচূড়া’বলি। উঠোনের একপাশে কংকালসার ডালে হলুদ পাতা গজাতে শুরু করেছে এরই মধ্যে। প্রতিদিন হলুদ পাতার পরিমান একটু একটু করে ঘন হচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে হলদে কোন ফুল বুঝি ফুটে আছে। বছরের এই সময়টায় নিউইয়র্ক শহরের মানুষজন প্রকৃতির প্রেমে বিভোর থাকে। সকলেই কাজের ফাঁকে, ব্যস্ততাকে পিছনে ঠেলে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে দলেবলে সেন্ট্রাল পার্ক, কিংবা বোটানিক্যাল গার্ডেনে ছুটে যায় মুগ্ধ করা প্রকৃতি অপার সৌন্দর্যের টানে। চলার পথে রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ গুলোয়ও রং বেরং এর ফুল ফুটতে শুরু করেছে। দীর্ঘ শীতের আমেজ শেষে নিউইয়র্কের মানুষজন বসন্তবরনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল মনে মনে। এমন প্রাকৃতিক পরিবেশে সকলের মন প্রফুল্ল হয়ে উঠার কথা। হালকা শীতের এই সময়টাতে আমাদের ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসার কথা। সূর্যের উজ্জ্বল কিরণ যেদিন চারপাশ আলোকিত করে তোলে, সেদিন আমরা বন্ধুরা একে অপরকে ফোন করে বাইরে ঘুরে বেড়ানোর জন্যে হাঁসফাঁস করার কথা। আমাদের শিশুরা পার্কে ছুটোছুটি খেলার কথা।

কিন্তু এরই মাঝে আচমকা কী হয়ে গেলো ! মানুষের মনে খুশি নেই। আতঙ্ক, ভয় আর শংকা ভর করে আছে মনের গহিনে। কী হতে চলেছে পৃথিবীতে ! হ্যাঁ আমি চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাসের কথা বলছি। বলছি সংকটকালীন সময়ের কথা। শুরুতে খাবার কিনে রাখাকে তেমন গুরুত্ব দেয়ার কথা ভাবিনি। কিন্তু পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তার ভয়াবহতা উপলব্ধি করা কঠিন হয়ে উঠেছে। কবে তা স্বাভাবিক হবে সে নিশ্চয়তা নেই। এমনতর নানাবিধ অজানা আশংকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার একটু বেশি করে কিনে রাখার জন্যে মনস্থির করলাম, যেনো রোজ বাইরে বেরুতে না হয়। গভীর উদ্বেগ নিয়ে হন্যে হয়ে ছুটলাম গ্রোসারি আর সুপারমার্কেটের উদ্দেশ্যে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের অপ্রতুলতা সর্বত্র। একটা আইটেম পাই তো অন্যটি পাই না। ইন্ডিয়ান গ্রোসারি স্টোরে মানুষের ভিড় ঠেলে ভেতরে চালের আইলে গিয়ে থ বনে গেলাম। চাল নেই। ডাল নেই, ময়দা নেই। অথচ যারা লাইনে দাঁড়িয়েছে ক্যাশ কাউন্টারে বিল পরিশোধের জন্যে, তাদের ট্রলির দিকে তাকিয়ে দেখি উপচে পড়া খাদ্যসামগ্রী। কারো ট্রলিতে ১০/১২ টা চালের ব্যাগ, ৮/১০ টা ডালের প্যাকেট সহ আরও অনেক সামগ্রী। যেনো এক একটি ছোটখাটো দোকান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক একজন আতংকগ্রস্ত মানুষ। তবুও ২/৩ দিন এ দোকান ও দোকান ছুটোছুটি করে যতটুকু সম্ভব খাবার মজুদ করেছি। হোলসেল স্টোর কসকোতে শপিং করতে গিয়ে দেখি দোকানের শাটার বন্ধ। সেই বন্ধ শাটারের বাইরেই শত শত মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। ভেতর থেকে কিছু সংখ্যক কাস্টমার বেরিয়ে এলেই তবে আবার কিছু সংখ্যক অপেক্ষমাণ মানুষকে ভেতরে যাবার অনুমতি দেয়া হবে। শুধু তাই নয়, বন্ধ শাটারের বাইরে সাইনবোর্ড লাগানো। যেখানে লিখে রাখা হয়েছে একজন কার্ডহোল্ডার একটি মাত্র দুধ, এক প্যাকেট ডিম ... ইত্যাদি নিতে পারবে। অর্থাৎ পরিবার প্রতি একটির বেশি নেয়া যাবে না নিত্য প্রয়োজনীয় আইটেমগুলো। সকলকে সম বণ্টনের কথা ভেবে এই ব্যবস্থা। নিউইয়র্ক নগরীতে এমন সংকটকালীন সময় আসবে কস্মিনকালেও ভাবিনি। ভাবিনি আরো অনেককিছুই। বাড়ির কর্তা, যাকে কখনো খাবারের সাথে লেবু খাবার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারিনি বিগত পঁচিশ বছরেও, সেই তিনিই কিনা গ্রোসারি কিনতে গিয়ে একগাদা লেবু নিলেন ট্রলিতে। খাবারের সময় পরিবারের সকলকে মনে করিয়ে দেন ভিটামিন সি এর উপকারিতা। সমস্যা হলো পরিবারের প্রতিটি সদস্য যখন দিনের পর দিন বাড়িতে অবস্থান করেন তখন যেনো আমাদের ক্ষুদা বেড়ে যায়। বাচ্চারা একটু পরপর এসে বলে, ‘ আমরা এখন কি খাবো ?’ ওদের বলেছি, খাবারে সংযমী হতে হবে এই ঘোরতর দুর্দিনে। ওরা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিয়েছে। খাবার দিলে বলে, এখন খাবো না, পরে খাবো। এমন কথা শুনে দু’চোখ জলে ভরে যায়। ভাবি, এমনটিও দেখার বাকি ছিল !
বিচ্ছিন্নভাবে নিউইয়র্কের এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চেনা স্বজন এবং বন্ধুদের সাথে কথা বলে জেনেছি এই দুর্যোগকালীন সময়ে কে কেমন করে সময় কাটাচ্ছো। জ্যামাইকায় বসবাসরত এক স্বজন জানালেন, ছোট বাচ্চাকে নিয়ে ছোট্ট একটি রুমে কতক্ষণ আটকে থাকা যায় ? তিন বছরের বাচ্চাটি বাইরে যাবার জন্যে মাকে অস্থির করে তুলেছে। রোজ বিকেলে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া কিংবা আবহাওয়া ভালো থাকলে পার্কে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না আগের মত। পার্কগুলোও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কুইন্সে বসবাসরত এক বন্ধু জানায়, স্বেচ্ছায় গৃহবন্দির এই সময়টায় আগের তুলনায় তার ব্যস্ততা বেড়েছে কয়েকগুণ। দুইবেলা নাস্তা আর দুইবেলা লাঞ্চ, ডিনার তৈরি করতে হচ্ছে তাকে নিয়মিত। রান্নাঘরের কাজ বেড়েছে। প্যানসিলভেনিয়ায় বসবাসরত এক বন্ধু জানায়, ঘরের দীর্ঘদিনের জমে থাকা কাজ যা সময়ের অভাবে করা হচ্ছিল না, সেইসব কাজ করছেন। অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ফেলে দিয়ে বাড়িটাকে জীবাণুমুক্ত, পরিচ্ছন্ন করছেন। কেউ কেউ জানিয়েছে, দিনের অধিকাংশ সময় নামাজ, কোরআন পড়ে কাটছে। এই সুযোগে ভিনদেশে জন্ম এবং বেড়ে উঠা সন্তানদের ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্যে, সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করা এবংপরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্যে প্রার্থনা করতে উৎসাহিত করছেন। একজন বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে বলেন, ‘ এ ছাড়া আর কি-ই বা করার আছে আমাদের ? মৃত্যুর এত কাছাকাছি আমাদের অবস্থান, তা আগে কখনো উপলব্ধি করিনি।’
আমরা বন্ধুরা একে অপরের খোঁজ নিচ্ছি। কেউ কারো বাড়িতে যাচ্ছি না। আবার কাউকে বেড়াতে আসতেও নিরুৎসাহিত করছি। তখনো নভেল করোনাভাইরাস এই শহরে ছড়িয়ে পড়েনি, শুধু আশংকা করা হচ্ছিল মাত্র, সেই সময়েই ছেলের মসজিদ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল কেউ যেনো সেখানে ধর্ম শিক্ষা কিংবা নামাজ আদায়ের জন্যে না যায়। সংক্রমণ রোধে মসজিদ কমিটির এই ব্যবস্থা বলে জানিয়েছে। যদিও এখন নিউইয়র্ক সিটির পরিস্থিতি আশংকাজনক হারে দিন দিন অবনতি হচ্ছে। বাড়ছে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা। তবুও রাজ্যের দুশ্চিন্তা দেশে থাকা স্বজনদের জন্যে, দেশের মানুষের জন্যে। দেশে বড়বোনের স্বামীর সাথে কথা হলো ফোনে। জানালেন ঘরের কাজে সাহায্যকারীকে আসতে মানা করে দিবেন। শুধু মাস শেষে এসে যেনো মাইনে বুঝে নিয়ে যায়। এই মানবতাটুকু ভালো লাগলো। মনে হলো, কোভিড ১৯ এমন এক সংক্রামক রোগ যা মানুষকে শারীরিকভাবে মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করে, কিন্তু মানসিকভাবে আমরা মুলত কেউ কারো দূরের নই।
আক্রান্তদের যারা হাসপাতালগুলোতে ভর্তি আছেন, কেমন আছেন তারা ? শিউরে উঠা এক অভিজ্ঞতার কথা খুব মনে পড়ছে। সময়টা ছিল ২০০৯ সালের শেষের দিক। চারিদিকে সোয়াইন ফ্লু মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। মানুষ মারা যাচ্ছিল। তখন আমি সন্তানসম্ভবা। একদিন গা পুড়ে যাওয়া জ্বর নিয়ে গিয়েছিলাম হাসপাতালে। পরীক্ষা নিরীক্ষা চলল। রিপোর্ট এলো। জানলাম, আমি আক্রান্ত। অতঃপর বলা নেই কওয়া নেই ভর্তি করে নিলো হাসপাতাল। ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা! যমে মানুষে লড়াই চলেছিল তখন। যম নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমি বেঁচে থাকতে চাইলাম। ডাক্তাররা চিন্তিত হয়ে উঠেছিল। আমাকে পাঠানো হয়েছিল ইন্‌টেনসিভ কেয়ারে। মুখে অক্সিজেন,হাতে পা'য়ে, আঙুলে, সমস্ত শরীরে নানান রকম যন্ত্রপাতির তার আর নলে জড়িয়ে পেঁচিয়ে রাখা হয়েছিল আমায়। এক একটি মেশিন শরীরের এক একটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা জানান দিচ্ছিল। স্যালাইন দেয়া, ব্লাড নেয়া সহ প্রতিদিন অগনিতবার সুঁই এর আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলাম। ডাক্তার, নার্স, সবাই হাতে গ্লভস আর মাস্ক মুখে দিয়ে রুমে আসতো। আমি কারো মুখের অভিব্যক্তি দেখতে পেতাম না। শুধু দুই ভ্রুর মাঝের কুচ্‌কে থাকা অংশটুকু দেখে আন্দাজ করে নিয়েছিলাম, আমি সম্ভবত মারা যাচ্ছি। আমার স্বজন-প্রিয়জন কারোরই সেই রুমে ঢুকার অনুমতি ছিল না। বাবা-মা'কে খুব মনে পড়তো। ভাইবোন দুটোর মুখ ভেসে উঠতো। সন্তানকে খুব দেখতে, বুকের সাথে জড়িয়ে ধরতে মন চাইতো। প্রিয়জনদের স্পর্শহীন বেদনাবিধুর এক প্রস্থানকালীন সময়ের কথা ভাবতেই শিউরে উঠি আরেকবার। জানি, নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষজন এরচেয়েও কঠিন সময় পার করছেন। পার করছেন অদ্ভুত এক আঁধার সময় !
আমরা পৃথিবীর মানুষেরা চরম ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিপর্যস্ত জীবন যাপন করছি। পার করছি অস্থির সময়। আমাদের সচেতনতার বিকল্প নেই। এ থেকে উত্তরণে বিশেষজ্ঞদের দেয়া পরামর্গুশলো মেনে চলতে হবে। মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করতে হবে। সব আঁধার একদিন ফুরাবে। আলো আসবে। আমরা আবার আমাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরবো। আমাদের সন্তানরা হাসবে, ছুটোছুটি খেলবে খোলা প্রান্তরে, সেই প্রার্থনা করি।
0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ