অস্কার আমাদের নিয়ে যখন হোটেলে পোঁছায় তখন স্থানীয় সময় রাত এগারটার কাছাকাছি, আমাদের সাথে সেও নেমে পড়লো গাড়ী থেকে, আমাকে জড়িয়ে ধরে কানের দুই পাশে উম্মা উম্মা শব্দ করে বিদায় সম্ভাষণ করলো, সাথে হাতে একটা এনভেলপ ধরিয়ে দিয়ে বললো, বন্ধু আমার, আমার একটা অনুরোধ রাখো, যখন তোমার ফ্লাইট টেইকঅফ করবে, এরপর খুলবে এইটাকে, তার আগে নয়।
ধন্যবাদ বন্ধু আমার, আমি বললাম।
অস্কার আমাকে ছেড়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললো, আগামীতে আবার এসো।
আমরা অস্কারকে চাও (বিদায়ের সময় চাও, ইটালিয়ান শব্দ ) বলে বিদায় নিলাম।
আমাদের জন্য অসংখ্য বাঙ্গালীরা হোটেলের দরজার সামনে অপেক্ষারত, তাদের কাছে যাওয়ার পর সবাই কোলাকুলি করে আমাদের থেকে বিদায় নিতে লাগলো, অনেকের চোখ ছলছল করছে দেখে, নিজেদের চোখও ভিজে এলো।
সকাল নয়টাই আমাদের ফ্লাইট, সবার কাছে বিদায় নিয়ে হোটেল রিসেপশনে এসে ভোর চারটার জন্য টেক্সিক্যাব বুকিং দিতে বললাম, ওরা ফোন দিয়ে কনফার্ম করে জানালে আমরা নিজ রুমে চলে গেলাম।
ভোর রাত তিনটায় দুই ভাই ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে রেডি হয়ে নিলাম, ভোর চারটার সময় টেক্সি এলে হোটেলে বিল চুকিয়ে চেপে বসলাম।
এয়ারপোর্ট পোঁছেই দুজনে প্রথমে চেকইন সারলাম, নিজেদের হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে নির্ধারিত গেইটে গিয়ে চেকিং সেরে ভিতরের দিকে এগুলাম।
ফ্লাইট গেইটের কাছাকাছি এসে স্টারবাক কফি শপ পেয়ে ভিতরে ঢু মারলাম, দুজনে দুইটা নাট কফি আর সেন্ডউইচ নিয়ে টেবিলে বসে পড়লাম।
এরমধ্যে দ্বিতীয় বার কফি খাওয়া হয়ে গেছে, শুনলাম ফাইনাল চেকইনের কল, দুই ভাই মিলে গেইটের দিকে এগুলাম, একসময় এরোপ্লেনের সিটে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম এরোপ্লেন টেইকঅফের।
যথাসময়ে এরোপ্লেন আকাশে উঠে পড়লো, গন্তব্য দিল্লি, একটু পর কেএলএম ফ্লাইটের এয়ারহোস্ট এসে সব প্যাসেঞ্জারকে গরম ভেজা ফেস টাওয়াল দিয়ে গেল, ফেস টাওয়াল খুলে নিয়ে মুখ হাতে ভুলিয়ে নিয়ে রেখে দিলাম।
দিল্লি এয়ারপোর্টে যখন পোঁছালাম তখন রাত দশটার কাছাকাছি।
এরোপ্লেন থামার পর আমাদের নামার পালা, একে একে সবাই বেড়িয়ে আসছি, দূর থেকে খেয়াল করলাম এক ব্যক্তি কেএলএমের পক্ষ থেকে সবাইকে জিজ্ঞেস করছে, কার কার হোটেল এরেঞ্জ করা আছে তাদের পক্ষ থেকে?
কাছাকাছি এসে নাম বললাম দুজনের, ওরা লিষ্ট চেক করে বলে, সরি লিস্টে আপনাদের নাম নেই।
বললাম, আবার চেক করুন প্লিজ।
চেক করে আবার না, বললো আপনারা আমাদের অমুক কাউন্টারে যান, ওখানে কমপ্লেইন করুন।
মেজাজ সপ্তমে আমার, দৌড়ে গেলাম কাউন্টারে, কাউন্টারের ভারতীয় মহিলা কম্পিউটারে চেক করে বললো, সরি আপনাদের জন্য হোটেলের কোনো রিকোয়েস্ট নেই।
বললাম, মিস. কোথাও ভুল হচ্ছে, দেখুন প্লিজ।
জবাবে বললো, ওকে আপনি আপনার ট্রাভেল এজেন্টের সাথে কন্টাক করে দেখুন।
এতো রাতে ট্রাভেল এজেন্টকে আমি কই পাবো?
তাহলে সরি।
ওকে ওকে এক কাজ করুন, আমি হোটেলের জন্য পে করবো, আমাদের হোটেল দিন।
সে পাসপোর্ট চাইলো, চেক করে বললো, সরি আপনাদের ভারতের ভিসা নেই, আপনারা ট্রানজিট গেইটের কাছে থাকতে হবে, বেরুতে পারবেন না।
শুনেই নিজের মাথায় বাঁজ পড়লো যেন, আমাদের ঢাকার ফ্লাইট পরবর্তী চৌদ্দ ঘন্টা পর, এই চৌদ্দ ঘন্টা আমরা কই যাবো, নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।
রাগে দুঃখে কি করবো ভাবতেই পারছিলাম না, ভাই আমাকে জোড় করে সরিয়ে নিয়ে আসলো, কতক্ষণ মাথা চেপে ধরে কাছে এক স্টিলের চেয়ারে বসে পড়লাম।
দিল্লির নতুন বিমানবন্দর তখনো স্টার্ট হয়নি, পুরাতন বিমানবন্দরেই আমরা আছি, এক সময় উঠে হাটতে শুরু করলাম ট্রানজিটের উদ্দেশ্যে, কাছাকাছি এসে বাইরে স্টিলের চেয়ারে বসে পড়লাম, জানিনা এই চৌদ্দটা ঘন্টা কিভাবে কাটাবো, বাইরে যাওয়ার উপায় নেই, আগের রাত ঘুম হয়নি, এইখানে সোফাতে ঘুমাবো তারও উপায় নেই, সোফায় মাঝে মাঝে হাতল দেওয়া, যাও দুই একটা আছে হাতল বিহীন, তাতে বেশ কিছু মানুষ শুয়ে নাক ডাকছে।
এইদিকে ক্লান্তি বলে ক্ষমা করো প্রভু, কিন্তু আমাদের দ্বারা সম্ভব নয় মাটিতে শুয়ে পড়ি, দুইভাই সোফাতে বসে বসে ঝিমুচ্ছি।
ঘন্টা দুয়েক পর খেয়াল করলাম দোতলার সিঁড়ি, লেখা আছে রেস্টুরেন্ট, ভাইকে ডেকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগুলাম, উপরে উঠে দেখলাম রেস্টুরেন্ট খোলা, ভিতরে একটা টেবিল ধরে বসে পড়লাম।
প্রথমে খাবার খেলাম, এরপর চলতে লাগলো চা আর কফি কিছুক্ষণ পর পর।
এইভাবে করে কি আর টাইমপাস করা যায়, দুইজনের চেহেরা এমন হয়েছিলো যে, যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সিপাহি আমরা, এমন বিধস্থ লাগছিলো।
এই রেস্টুরেন্ট থেকে মাঝে মাঝে নিচে নামছিলাম, আবার উঠে আসছিলাম আর আমি সিগারেটের পর সিগারেট জ্বালাচ্ছিলাম।
সকাল দশটা কোনরকমে বাজতেই ফোন বুথে গিয়ে দিলাম ট্রাভেল এজেন্টকে ফোন, পারিনা দিল্লি থেকেই তাকে পিঠাতে, সে বুঝাতে চাইলো এয়ারলাইন্সের গণ্ডগোল, ওকে বললাম, তুই থাক আমি এসে তোর চৌদ্দগুষ্টি সহ আমি উদ্ধার করবো, বলেই ফোন কেটে দিলাম।
কোমর, পা, ঘাড় সব ব্যাথায় আক্রান্ত, ওরা বলছে শুয়ে পড়, আমি বলছি কেমনে কি?
এমন কষ্টকর জার্নি আমার জীবনে আর নেই, সকাল হওয়াতে মানুষজন ঘুম থেকে উঠে গেছে দেখে, দুইভাই দুইটা সোফা দখল করে দিলাম ঘুম, আধা ঘন্টাও ঘুম হয়নি, এয়ারপোর্ট পুলিশ এসে চোখ লাল করে ভয় দেখিয়ে দিলো উঠিয়ে, দুজনে টলতে টলতে ট্রানজিট গেইটে গিয়ে দেখলাম দরজা খুলেছে, দুজনেই টিকেট আর বোর্ডিং পাস দেখিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম, ফ্লাইট ছাড়তে দুই ঘন্টা দেরি আছে।
ভাইকে হ্যান্ডব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে আমি টয়লেটে প্রবেশ করলাম, কিছুক্ষণ পর ফ্রেস হয়ে এসে ভাইকে পাঠালাম।
দুই ঘন্টা পর আমাদের ডাক পড়লো ফ্লাইটে উঠার জন্য, লাইন ধরে এগুলাম প্লেনের গেইটের উদ্দেশ্যে, একসময় প্লেনে উঠে সিটে বসে পড়লাম, তখন রাজ্যের ঘুম চোখে এসে ভিড় করলো, সিটে বসেই দিলাম ঘুম।
দুই ঘন্টা পর মনে হয়, এয়ারহোস্টের ডাকে ঘুম ভাঙলো, সে বলছে সিট সোজা করে নিতে, দুজনে চোখ কচলে নিয়ে সোজা হয়ে বসলাম, একটু পর লাঞ্চ দিলো, দুইভাই ক্ষুদায় কাতর ছিলাম বলে দ্রুত খাবারে মন দিলাম, খাবার শেষে দুজনে কফি নিয়ে চুমুক দিতে লাগলাম।
খাওয়াদাওয়ার পালা শেষ হলেই এয়ারহোস্টরা সব ক্লিয়ার করে নিয়ে গেল, একটুপর টুংটাং শব্দের পরে পাইলটের গলা ভেসে এলো, সিটবেল্ট বাঁধার নির্দেশ দিয়ে, যাক তাহলে ঢাকায় নামবো তাহলে, হোটেলে গিয়ে দেবো এক ঘুম, কমছে কম দুইদিন ঘুমাবো।
সমাপ্ত।
১৭টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
ট্রানজিট আপনাকে ভালই কাবু করে ফেলেছে দেখছি।
তবে এরপরে আপনার এজেন্টের সাথে কেমনে রফা করেছেন তা একটু বলে দিয়েন,
ঢাকায় পৌঁছে হোটেল কেন!!
এরপর কী হবে তার ঘোষণা চাই।
ইঞ্জা
এমন হ্যাপার পরে ট্রাভেল এজেন্ট ব্যাটাকে একজনের টিকেট বাকি রাখা ছিলো, তা থেকেইই ৫০% কেটে বিল দিয়েছিলাম।
তখন চট্টগ্রামেই থাকতাম বলেই ঢাকার হোটেলে থাকার প্ল্যান ছিলো কিন্তু ছোট ভাই এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই নিয়ে নিলো ট্যাক্সি ক্যাব, মানে ডাইরেক্ট চট্টগ্রাম।
মোঃ মজিবর রহমান
হ্যাঁ শেষ নয় ত্রাফেল এজেন্টের সংগের দফারফা মানে ঐ যে ১৪ গুস্টী কি হল আর কি।
ভাল থাকুন।
ইঞ্জা
আর কি, বিলের ৫০% কেটেই বিল দিয়েছি :p
নীহারিকা
দুর্ভোগ পড়ে মন খারাপের কমেন্ট কি দেবো, হেসেই মরে যাচ্ছি। সবথেকে মজার অংশ পুলিশের রক্তচক্ষু। বেচারারা। :D)
শেষ পর্বটিই বেশ চমৎকার হয়েছে।
ইঞ্জা
দাদী, আমাদের জায়গায় আপনারা হলে বুঝতেন ঠ্যালা। ;(
জিসান শা ইকরাম
আগামি কাল পড়ব। আজ ক্রিকেটে মন খারাপ 🙁
ইঞ্জা
ওকে ভাইজান
আগুন রঙের শিমুল
অস্কারের এনভেলাপের ভিত্রে কি ছিলো ভাউ?
ইঞ্জা
ধন্যবাদ পত্র, সাথে আমার কন্সাইনমেন্ট বাকিতে শীপমেন্টের ডকুমেন্টস, যা ওরা কখনোই করেনা।
নীলাঞ্জনা নীলা
আহারে, ১৪ ঘন্টা ট্রানজিট! তাও হোটেল নেই? আমি একবার ১০ ঘন্টার ট্রানজিটে হোটেল পেয়েছিলাম। তীর্থর তখন মাত্র ৫ বছর বয়স। এতো ক্লান্ত ছিলাম হোটেলে গিয়েই মা-ছেলে দুজনেই ঘুম। সময়ের হেরফেরে কতো যে ক্লান্তি জাগে!
পুলিশের রক্তচক্ষু! 😀 না ঘুমিয়ে আপনার চোখ কি লাল হয়নি? তাহলে দেখালেন না কেন?
ইঞ্জা
আপু দুর্ভোগ যখন আসে, তখন এ থেকে রক্ষা কেউ করতে পারেনা, এই ঘটনার পর থেকে আমি অনেক ভ্রমণ করেছি, লং জার্নি তো ছিলোই বেশি, কিন্তু কখনোই এই ধরণের সমস্যা হয়নি, হোটেল সব সময় পেয়েছি, এ শুধু আমার ফাজিল এজেন্টের টাকা মেরে খাওয়ার চেষ্টা মাত্র।
পুলিশের রক্তচক্ষু দেখে আমার লাল চোখের করুণ অবস্থা একবার চিন্তা করুণ, এই অবস্থায় ছবু তোলা যায়?
ইঞ্জা
ছবি★
নীলাঞ্জনা নীলা
আর বলবেন না। এবার আমার দেশে যাওয়াটাতেও বারোটা বাজিয়েছিলো ট্রাভেল এজেন্সি। ডিজাবলদের টিকেট কখনও প্যাকেজ দেয়া হয়না। কারণ কখন কী হয়ে যায়! আমাকে সেটাই দিয়েছিলো। টিকেট এক্সটেন করতে গিয়ে দেখি প্যাকেজ। মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিলো। :@
যাক ভালো লেগেছে সম্পূর্ণ ভ্রমণ কাহিনী।
ইঞ্জা
এদের থাবড়ানো উচিত আপু, মেজাজ ধরে এইসব ফাজলামি দেখে।
মিষ্টি জিন
আমার এই দীর্ঘ পঁচিশ বছরের জার্নিতে এমন কখনই ঘটে নাই তবে গত ডিসেম্বরে ফগের জন্য ১০ ঘন্টার জার্নি তিরিশ ঘন্টায় করেঁছি । সে কঁথা পরে একদিন শোনাবোক্ষন।
যে কোন এয়ারপোটেই যাত্রীরা সোফায় , ফ্লোরে ঘুমায় সেখানে পুলিশরা কিছু বলে না। দিল্লির পুলিশরা কেন ওমন করলো বুঝলাম না।
ইঞ্জা
এই সমস্যা ট্রাভেল এজেন্টের অবহেলার কারণে হয়ে পার্টনার আর দুপুর বারোটাই দুইটা মানুষ সোফা দখলে রেখে ঘুমালে তো পুলিশ ট্যাঙাবেই। :p