এই সময় আব্বা বাড়ি থেকে ফিরে এসেছেন। দারোগা সাহেবও তাঁর পিছে পিছে বাড়িতে ঢুকে পড়েছেন। আব্বার কাছে বসে আস্তে আস্তে সকল কথা বললেন। আমার গ্রেফতারি পরোয়ানা দেখালেন। আব্বা বললেন, ”নিয়ে যান।” দারোগা বাবু বললেন, “ও খেয়েদেয়ে আসুক, আমি একজন সিপাহি রেখে যেতেছি, এগারটার মধ্যে যেন থানায় পৌঁছে যায়। কারণ, দেরি হলে জামিন পেতে অসুবিধা হবে।” আব্বা জিজ্ঞাসা করলেন, ”মারামারি করেছ?” আমি চুপ করে থাকলাম, যার অর্থ ”করেছি”।
আমি খাওয়া-দাওয়া করে থানায় চলে এলাম। দেখি আমার মামা, মানিক, সৈয়দ আরও সাত-আটজন হবে, তাদেরকে পূর্বেই গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে এসেছে। আমার পৌঁছার সাথে সাথে কোর্টে পাঠিয়ে দিল। হাতকড়া দেয় নাই, তবে সামনেও পুলিশ পিছনেও পুলিশ। কোর্ট দারোগা হিন্দু ছিলেন। কোর্টে পৌঁছার সাথে সাথে কোর্ট হাজতের ছোট কামরার মধ্যে বন্ধ করে রাখলেন। কোর্ট দারোগার রুমের পাশেই কোর্ট হাজত। আমাকে দেখে বলেন, “মজিবর খুব ভয়ানক ছেলে। ছোরা মেরেছিল রমাপদকে। কিছুতেই জামিন দেওয়া যেতে পারে না।” আমি বললাম, “বাজে কথা বলবেন না, ভাল হবে না।” যারা দারোগা সাহেবের সামনে বসেছিলেন, তাদের বললেন, “দেখ ছেলের সাহস!” আমাকে অন্য সকলে কথা বলতে নিষেধ করল। পরে শুনলাম আমার নামে এজাহার দিয়েছে এই কথা বলে যে, আমি ছোরা দিয়ে রমাপদকে হত্যা করার জন্য আঘাত করেছি। তার অবস্থা ভয়ানক খারাপ, হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছে। প্রকৃতপক্ষে রমাপদের সাথে আমার মারামারি হয় একটা লাঠি দিয়ে, ও আমাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করলে আমিও লাঠি দিয়ে প্রত্যাঘাত করার চেষ্টা করি। যার জন্য ওর মাথা ফেটে যায়। মুসলমান উকিল মোক্তার সাহেবরা কোর্টে আমাদের জামিনের আবেদন পেশ করল। একমাত্র মোক্তার সাহেবকে টাউন জামিন দেয়া হল। আমাদের জেল হাজতে পাঠানোর হুকুম হল। এসডিও হিন্দু ছিল, জামিন দিল না। কোর্ট দারোগা আমাদের হাতকড়া পরাতে হুকুম দিল। আমি রুখে দাঁড়ালাম, সকলে আমাকে বাধা দিল, জেলে এলাম। সাবজেল, একটা মাত্র ঘর। একপাশে মেয়েদের থাকার জায়গা, কোনো মেয়ে আসামী না থাকার জন্য মেয়েদের ওয়ার্ডে রাখল। বাড়ি থেকে বিছানা, কাপড় এবং খাবার দেবার অনুমতি দেয়া হল। শেষ পর্যন্ত সাত দিন পরে আমি প্রথম জামিন পেলাম। দশ দিনের মধ্যে আর সকলেই জামিন পেয়ে গেল।
হক সাহেব ও সোহরাওযার্দী সাহেবের কাছে টেলিগ্রাম করা হল। লোকও চলে গেল কলকাতায়। গোপালগঞ্জে ভীষণ উত্তেজনা চলছিল। হিন্দু উকিলের সাথে আমার আব্বার বন্ধুত্ব ছিল। সকলেই আমার আব্বাকে সম্মান করতেন। দুই পক্ষের মধ্যে অনেক আলোচনা হয়ে ঠিক হল মামলা তারা চালাবে না। আমাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে পনের শত টাকা। সকলে মিলে সেই টাকা দিয়ে দেওয়া হল। আমার আব্বাকেই বেশি দিতে হয়েছিল। এই আমার জীবনের প্রথম জেল।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং-১২ ও ১৩)
Thumbnails managed by ThumbPress
১৪টি মন্তব্য
অনিকেত নন্দিনী
রুদ্ধশ্বাসে শেখ মুজিবের প্রথম জেলজীবনের গল্প পড়লাম।
লিখতে থাকুন আপু। সাথেই আছি। 🙂
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ। আমি খুব বুঝতে পারছি, অল্প অল্প করে পোস্ট করার এই উদ্যোগটা আমার উদ্দেশ্যকে দারুনভাবে সফল করছে। বইটা মানুষ শুধু পড়ছে না, ধারণও করছে। আপনাদের মন্তব্যগুলো পড়ে আমার তাই মনে হয়।
ছাইরাছ হেলাল
আবারো পড়লাম তাঁর জেলে থাকার বর্ণনা।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
🙂
জিসান শা ইকরাম
নিয়মিত লিখছেন বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী,
জেল জীবনের শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর
হক সাহেব ও সোহরাওযার্দী সাহেবের সাথে নৈকট্যও বৃদ্ধি পেতে থাকলো।
অপেক্ষা পরের পর্বের।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
এক এক করে তাঁর জীবনের বিভিন্ন প্রকাশ আমরা জানতে এবং উপলব্ধি করতে পারছি।
ধন্যবাদ।
খসড়া
বইটি আমি পড়েছি। এটা ভাল উদ্যোগ, যারা পড়েনি তারা পড়ছে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ। এ প্রকাশের মাধ্যমে কেউ যদি দশ ভাগের এক ভাগও পড়ে তাহলেই আমার উদ্যোগ এবং উদ্দেশ্যটা সার্থক হবে।
অনেক ধন্যবাদ।
শুন্য শুন্যালয়
আবার তোরা মানুষ হ সিনেমাতে দেখেছিলাম, রাজনৈতিক জীবনে জেলখানা হচ্ছে, প্রথম প্রতিবাদের রূপক।
পড়ছি, জানতে পারছি অনেককিছু। ধন্যবাদ আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হ্যাঁ, রাজনীতি মানেই জেলখানা, রাজপথে সংগ্রাম, প্রতিকুল পরিস্থিতির মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়া।
আরাম কেদারায় শুয়ে তো মানুষের নেতা হওয়া যায় না।
নীলাঞ্জনা নীলা
ধারাবাহিকটির সাথে আছি। লিখুন আপু। অনেক “অজানারে জানাইলে তুমি।”
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ অনেক। চেষ্টা করে যাচ্ছি।
মোঃ মজিবর রহমান
আব্বার কাছে বসে আস্তে আস্তে সকল কথা বললেন। আমার গ্রেফতারি পরোয়ানা দেখালেন। আব্বা বললেন, ”নিয়ে যান।
কি ধির স্থির ভাবনা।
ভাল লাগলো আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হ্যাঁ, অনেক কিছু জানতে পারছি।