ডায়রী’৭১
————
সেই শকুন, সেই কালো শকুন
আবারো ধারালো নখ নিয়ে
লোভী চোখের নজর দিয়েছে
লাল সবুজের পতাকায়।
সেই কালো কুকুরটা
যে ছোট শিশুর কঁচি শরীরের
কাঁচা মাংস খেয়েছিল একদিন
উদরপুর্তি করে,
সে আবারো ঘুরছে
পুরনো দিনের ছবি
নতুন করে দেখছে বলে।
সেই মুক্তিসেনা
যে বস্তা ভরা
বাঙ্গালীর চোঁখ পেয়েছিল
কনসেন্ট্রেশন ক্যম্পে,
যাদের হত্যা করা হয়েছিল
সেই কালো দিনগুলোতে ।
সেই যে অচেনা যুবক
যার পরনের লুঙ্গি খুলে
যাচাই করা হয়েছিল
তার ধর্ম,
তাকে হতে হয়েছিল
সভ্যতার প্রতীক।
সেই গাদ্দার
যে দেশ মাতৃকার টানে
শত্রুকূপ থেকে আকাশ যান নিয়ে
আসতে চেয়েছিল
এবং এসেছিল
মৃত্যুর পয়ত্রিশ বছর পর
আকাশ যানে চড়েই।
সেই যে ভাই
যে বলেছিল বোনকে নিয়ে
ঘুরতে যাবে গ্রামে,
বোনটি তার পুরোটা গ্রাম
ঘুরেছিল ভাইয়ের
মরদেহ খুজঁতে।
সেই যে প্রেমিক
যে তার প্রেয়সীকে বলেছিল
লাল শাড়িতে তোমায় সাজিয়ে
নিয়ে যাবো আমার করে,
মেয়েটি তার প্রেমিকের
রক্তমাখা শরীরটি জড়িয়ে ধরেছিল
তার শাড়িটি হয়েছিল রক্ত লাল।
সেই যে সবুজের বুকে লাল
কেড়ে নিতে চেয়েছিল
জল্লাদের দল,
আজো মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে
আমার বুকের জমিনে।
অডিও: https://soundcloud.com/tirthok-ahsan-rubel/dairy-71
টর্চার সেল
————-
দেয়ালে এখনো ছোপ ছোপ রক্তের দাগ
নির্বাক দেয়াল থেকে
এখনো করুণ আর্ত্বনাদ ভেসে আসছে।
বাতাস যখন হুমরে পড়ছে দেয়ালে
শো শো শব্দ নেই তাতে
কানে বাজছে
মা, পানি পানি পানি
কিছুক্ষণ পিন পতন নিস্তব্ধতা।
তারপর আবার
শালা শুয়র কা বাচ্চা
বোল মুক্তি কাহা
ধুপ ধুপ কয়েকটি লাথির শব্দ।
মিশ্র একটা শব্দ আসছে
বোধহয় কাঁচা মাংস
লাল অগ্নি দন্ডের ছোঁয়া পেয়েছে
কাবাবের গন্ধে পুরো ঘর মৌঁ মৌঁ করছে
লোভী কতগুলো জিহবা বেয়ে লালা পড়ছে
ওগুলো মানুষের নয়,
কুকুর, হায়না এবং শকুনের।
আযরাইল ঘুরছে ঘরের এপাশ থেকে ওপাশে
কিছুটা বিরক্ত জল্লাদগুলোর উপর
কেন মারতে চাইছেনা এখনো।
কক্ষটি ইতিমধ্যে নাপাক হয়ে গেছে
কারণ যখন পানি পানি বলে
জ্ঞান হারিয়েছিল সে
তখন তার মুখে প্রস্রাব করা হয়েছিল।
তার জ্ঞান ফিরে আসে
গভীর রাতে
জানালা দিয়ে তার মুখে পড়েছে
একফালি পূর্ণিমার চাঁদ।
অবাক হয়ে চেয়ে থাকে সে।
মনে পড়ে যায়
এমনি এক পূর্ণিমার রাতে
সে ধরেছিল প্রিয়তমার মুখ
চাঁদের চেয়েও অনেক বেশী
উজ্জ্বল ছিল সে মুখ।
চাঁদের দিকে চেয়ে একবার সে
প্রিয়তমার মুখ আঁকতে চাইল,
পারল না, আবার চাইল
এবারও না, এবার অন্য কিছু চাইল
কিছু সময় চোঁখ বন্ধ রেখে খুলল
সাথে সাথে মুখে তীব্র লাথি
নাক ফেঁটে রক্ত গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে
গুলি ফোটার মত শব্দ হলো
আযরাইল সাহেব হাসিমুখে দাঁড়াল
মাত্র কয়েক মুহুর্ত্ব সময় পেল সে
এরই মধ্যে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে
শেষ ইচ্ছেটা দেখতে চাইল
এবং দেখল
রাতের পুরোটা অন্ধকার গাঢ় সবুজ হয়ে গেছে
আর চাঁদটা টকটকে লাল এক সূর্য।
অডিও: https://soundcloud.com/tirthok-ahsan-rubel/torture-cell
প্রেক্ষাপট:
‘ডায়রী’৭১’
অনেকগুলো সত্য ঘটনা ছোট ছোট গল্পে রচিত। যার মূল থিম ছিল একেকজন হয়ত তাদের ডায়রীতে সে সময়ের গল্পগুলো লিখতো। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রায় প্রতিটি ঘটনারই ছবি ইন্টারনেটে এভেইলেবল। শেষ দুটো কবির কল্পনা। আর হ্যা, মিলি রহমান (বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রী) এই কবিতাটি শোনার পর মিনিট কয়েক থ মেরে বসেছিলেন। তারপর আমাকে বলেন, তুমি এই কথাটা কিভাবে আবিস্কার করলে! সত্যিই তো মতিউর বিমান নিয়ে পালিয়ে আসতে চেয়েছিল। সে শহীদ হবার ৩৫ বছর পর বিমানেই তার কবরটা তুলে নিয়ে আসা হয়।
‘টর্চার সেল’
এই কবিতাটা মূলত একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রেমিকের সর্বশেষ দিনের গল্প। সেদিন ছিল ১৫ ডিসেম্বর রাত। রাত থেকে সকাল হতে হতে তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটাই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে আরেকটা কথা জানিয়ে রাখি, এই কবিতা থেকে ২০০৮ সালে আমি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করি। যা চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ সমালোচক পুরস্কার অর্জন করে। যেখানে বিচারক ছিলেন দুজন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার এবং দুজনই বর্তমানে না ফেরার দেশে চলে গেছেন: বাদল রহমান এবং খালিদ মাহমুদ মিঠু।
স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র:
১১টি মন্তব্য
তির্থক আহসান রুবেল
কবিতা দুটো পোস্ট করা্র পর পর্যাবেক্ষণে থাকার সময়ে দেখলাম নাম পড়ে গেছে। এডিট করে আবার নাম বসালাম। এখন আবার নাম দুটো দেখাচ্ছে না। এটা কি সাইটের কোন সমস্যার জন্য হচ্ছে?
ব্লগ সঞ্চালক
শিরোনামের শুরুতেই কমা, সেমিকোলন ইত্যাদি দেয়ায় এমন হয়েছে।
বর্তমান শিরোনাম ঠিক আছে।
আপনার পোস্ট আর পর্যবেক্ষনে থাকবে না।
শুভ ব্লগিং
তির্থক আহসান রুবেল
ধন্যবাদ।
রোকসানা খন্দকার রুকু
এগুলো দেখলে গায়ে কাটা দেয়। কি নির্মম ছিল। শুভকামনা অশেষ 🌹
তির্থক আহসান রুবেল
ধন্যবাদ। ছোটবেলার কাজ ছিল আর কি!
হালিমা আক্তার
ভয়ঙ্কর দিনগুলোর কথা যখন পড়ি, তখন মনে হয় কতো আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। শুভ কামনা রইলো।
তির্থক আহসান রুবেল
অনেক বছর এগুলো নিয়ে কাজ করেছি। করতে করতে আসলে আমি নিজেও ক্রেক হয়ে গেছি এক প্রকার।
সাবিনা ইয়াসমিন
এই বছর বইমেলায় গিয়ে ফেরার পথে হঠাৎ মনে হলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নবনির্মিত স্বাধীনতা যাদুঘরটা দেখে আসি। গেলাম, দেখলাম। কিন্তু যা কিছু দেখেছি! যা কিছু অনুভব করেছি সেটা এখানে প্রকাশ করা অসম্ভব। ৭১এ সাধারণ মানুষের উপর ঘটে যাওয়া নৃশংসতা, বিভিন্ন ছবি, ছবির পেছনের বীভৎস ইতিহাস যা কখনো মিথ্যা বলে চালিয়ে দেবার উপায় নেই। দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাওয়া সম্ভব না। আপনার এই লেখা আর শর্টফিল্মটা দেখে আমার ঐ সময়ের মানসিক অবস্থার কথা মনে পড়ে গেলো।
আমি এটুকুই বলবো, এই স্বাধীন দেশে একজন ব্যক্তির পক্ষে সত্যিকারের স্বাধীনতা অনুধাবন করা কখনোই সম্ভব হবে না যদি না সে তার ভেতরে মুক্তিযুদ্ধকে,যুদ্ধের ইতিহাসকে ধারণ না করতে পারে। কতটা ত্যাগ সইতে হয়েছে তখনকার মানুষদের!
এগুলো আসলে ফিল করতে হয়।
তির্থক আহসান রুবেল
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে সে সময় যাদের বয়স তখন ০-১০, তাদের সিংহভাগ সে সময় মারা গেছে। অর্থাৎ একটা প্রজন্ম দেশকে সেবা দিতে পারে নি। তাই মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে যারা আজ দেশ চালাচ্ছে তাদের সিংহভাগ বড় হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুকে একদমই না জেনে বা বিকৃত জেনে।
অন্যদিকে সাড়ে ৭ কোটি মানুষের মধ্যে নানান দল-মত-লবিং যুক্ত করেও মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাটা কখনো সাড়ে আড়াই-তিন লাখেও পৌঁছায় নি। এবার হিসেব কষেন বেশীরভাগ মানুষ কতটা সুবিধাবাদী ছিল। আর এজন্যই মুক্তিযোদ্ধা কোটা মুক্ত আন্দোলন জমজমাট হয়।
রিতু জাহান
মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে আমার কিছু ডকুমেন্টারি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো।
আর কুড়িগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে লিঙ্কন ভাই দেখিয়েছিলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। ওনার সংগ্রহশালা অসাধারণ।
আমরা সেই মুক্তিযুদ্ধকে যেনো কলঙ্কিত করে ফেলেছি।
ধন্যবাদ আপনাকে।
তির্থক আহসান রুবেল
ধন্যবাদ এই দফায় লম্বা সময় দেয়ার জন্য। কারণ সিনেমা সহ পোস্ট সবকিছুই বড়