কবি হবো

নাসির সারওয়ার ১৫ অক্টোবর ২০১৫, বৃহস্পতিবার, ১০:৫৪:৩৫পূর্বাহ্ন বিবিধ ৭৪ মন্তব্য

সপ্তাহের বিশেষ একটা দিনে আমাদের সংসারের অনেকেই অপেক্ষায় থাকতাম হকারের জন্য, একটা বিশেষ সাপ্তাহিক কখন পড়বো। মোটামুটি কাঁড়াকাঁড়ি অবস্থা। তারপর যা হবার তাই হত। বড়োরা আগে এবং লিলিপুটেরা কাটাত সেই কঠিন অপেক্ষার প্রহর। তখন ক্লাস সেভেন এ পড়ি, মা স্বাভাবিক এর চাইতে একটু জোরেই বললেন, “ওহ, এই জন্যই তোর কয়েক দিস্তা কাগজ বেশি লাগে”। মা এর মুখে আমি কী যেন দেখেছি, ঠিক বুঝিনি। তবে মনে হলো সুখ সুখ ভাব। “এটা কি তোর লেখা?” হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। তারপর ছোট্ট একটা “হ্যাঁ”। “তা যে স্যারকে নিয়ে লিখেছিস, উনি এটা পড়লে তো তোরও তেরোটা বাজিয়ে দেবেন।“ তারপর মা ঢোল পিটিয়ে এলান করলেন, “আজ থেকে তুই সবার আগে পড়বি”। আমিতো বেশ কয়েকটা দিন ঘুমাতে পারলাম না। এতটুকু জীবনের সামান্য প্রাপ্তিতে যে আমার অনেক বড় তৃপ্তি। স্কুলের একটা নির্মম ঘটনা লিখে পাঠিয়েছিলাম সেই সাপ্তাহিকে (বিচিত্রা)। দেশের একজন স্বনাম ধন্য শ্রদ্ধেও সম্পাদক (প্রায়ত) শাহাদাত হোসেন ছেপে দিলেন কী মনে করে যেন। হয়তোবা একটা কিশোরকে উৎসাহ দেবার জন্য। ইংরেজি স্যারকে দেখালাম যেহেতু ওনার সাথে আমার সখ্যতা ছিল। লেখাপড়ার বাইরেও কথা হোতো। কয়েকদিন পরে সেই নির্মম ঘটনার নায়ক শিক্ষক সাহেবকে আর স্কুলে দেখিনি। তারপর টুকটাক লেখা চলছে, ছাপছে। মাঝে মাঝে কবিতার দু একটা লাইনও থাকে। একদিন সাহস করে আস্ত একটা কবিতা পাঠিয়ে দিলাম। তারপর সেই কষ্টকর অপেক্ষা। হয়তো পরের সপ্তাহে ছাপবে। মনে হয় ভুলে গেছে। নতুন একটা পাঠালাম, তারপর আরেকটা, আরো কয়েকটা। মনটা ভেঙ্গে মুচড়ে থেঁতলে চূড়ান্ত হলো একসময় কিন্তু হাল ছাড়িনি আমি। ইংরেজি স্যারকে আমার কবিতার খাতাটা দিলাম। উনিতো মাঝে মাঝে ইংরেজি কবিতা শোনাতেন। সেই স্যার দুদিন পরে যা বললেন, কষ্ট কী? তার মানে হারিয়ে ফেললাম। থেমে গেলো মায়াস্বপ্নের পংতি আঁকা।

স্কুল ছেড়ে কলেজে পা রাখলাম। ভিন্ন শহর ভিন্ন মানুষ ভিন্ন অধ্যায় জীবনের। ক্লাসের মানুষদের দেখে মনের চাহিদা জাগল শুধু ভালো রুমমেটের জন্য। একজন যেন কী করে রাতভর। কাছে গিয়ে দেখতে চাইলাম কি আঁকিবুকি করছে। লাজুক মানুষটা লজ্জায় যেন মেয়ে বনে গেল। খাতাটা দেখে প্রথমেই চোখ চরক গাছে। মুক্তাখরে লেখা গোছানো অনেকগুলো লাইন। অনেক দিন এতো সুন্দর হাতের লেখা দেখিনি। রাতটা পার করলাম ওর কবিতা পরে। তারপর কত রাত কাটিয়েছি ওর লেখা পরে মনে নেই। এই কবিয়াল বন্ধুটির বাড়ি ছিলো খুব কাছাকাছি। ওখানে ওর একটা লেখার সংসারও ছিল। কোন কোন পর্বনে ওরা লেখা-লিখির কাগজ বের করতো। একদিন সপ্তাহের ছুটি শেষে বাড়ি থেকে এসে একটা ম্যাগাজিন হাতে দিয়ে বলল, “তোর একটা কবিতা ছেপেছে আমার এলাকার একটা পেপারে।“ শুনে আহত হয়েছিলাম অনেক। কবি হবার স্বপ্নভাঙা মানুষটার যন্ত্রণার তুই কী বুজবি! বন্ধুটিকে তো আর আঘাত দেয়া যায়না। লাল মলাটটায় চোখ আকটে থাকলো অনেক্ষণ। প্রথম কবিতাটায় সব শব্দগুলো থেমে গেলো। একি, ও আমার মনের কথা চুরি করলো কী করে! ঝুঁকে পরা মাথাটা তুলতে পারিনি বন্ধুটির সামনে। এক সময় নিউজপ্রিন্টটা ঝাপসা হতে শুরু হলো। সরে গেলাম ওর সামনে থেকে। কখনো বলা হয়নি সেই কষ্টের ভালোলাগার কথা। সেই প্রথম সেই শেষ। সাথে আছে ইংরেজি স্যারের কথা। “সবার জন্য সব কিছু নয়”।

মায়াগুলো ওঠা নামা করে স্বপ্নের গাড়িতে। আমার ষ্টেশনে কেউ নামেনা। আজ উঠিয়ে দিলাম কবি হবো মাদুলিটা।

উৎসর্গঃ কবিয়াল বন্ধুটা, তোর কাব্যিক নামটা এখনো হাঁটছে আমার সাথে।

0 Shares

৭৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ