স্বাধীনতার ঘোষণার অজানা তথ্য। সংগ্রহীত।

মোঃ মজিবর রহমান ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬, মঙ্গলবার, ১০:৪৮:২৯পূর্বাহ্ন বিবিধ ১৯ মন্তব্য

আমি অনেক লেখা পড়েছি কন্তু এই রকম তথ্য পাইনি। আমার মনে হয় এটা পড়লে অনেক অজানা তথ্য জানা যাবে।

স্বাধীনতা ঘোষণার অবিস্মরণীয় চার সাক্ষী

মুসা সাদিক

 

বাঙালি জাতির বিচক্ষণ কাণ্ডারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান বাহিনীর (১৯৭১ সালের মার্চে) আসন্ন সামরিক অভিযানের বিষয়টি আঁচ করে তা প্রতিরোধের জন্য অতি সঙ্গোপনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির সমন্বয়ে একটি সামরিক মহাপরিকল্পনা গড়ে তুলেছিলেন। এই তথ্য আমায় দেন বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ততম সহচর, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি রুহুল কুদ্দুস সিএসপি। রুহুল কুদ্দুস ছিলেন আমার মামা। কীভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়েছিল তার বিশদ বর্ণনা তিনি আমায় দিয়ে বলেছিলেন, তার মৃত্যুর আগে যেন কোথাও প্রকাশ না করি। মুক্তিযুদ্ধের অনুপুঙ্খ ইতিহাস সংগ্রহের ব্যাপারে আমার অদম্য আগ্রহ নির্মাণের পেছনে কাজ করেছে ১৯৭১ সালে আমার ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস আমি ছিলাম রণাঙ্গনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সমর সংবাদদাতা (ওয়ার করেসপন্ডেন্ট)। ওই দায়িত্ব আমি চরম ঝুঁকি নিয়ে পালন করেছি। আমার পাঠানো বহু সংবাদ আন্তর্জাতিক শিরোনাম হয়েছিল। সংবাদদাতার কাজ তো করেছিই, সেই সঙ্গে করেছি গোপন সামরিক সংকেত বাহকের কাজ। দেশের ভেতরে দখলদার পাকিস্তানি সেনারা কীভাবে অবস্থান, তাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ কেমন, আমার পাঠানো সেসব গোপন তথ্য রণাঙ্গনে সেনা নায়কদের রণকৌশল প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতারে ‘রণাঙ্গন ঘুরে এলাম’ ও ‘মুক্তাঞ্চল ঘুরে এলাম’ শীর্ষক দুটি কথিকা মুসা সাদিক নামে স্বকণ্ঠে নিয়মিত প্রচার করেছি। স্বাধীন বাংলা বেতারের ‘চরমপত্র’র পর আমার ‘রণাঙ্গন ঘুরে এলাম’ কোটি কোটি মুক্তি পাগল বাঙালির হৃদয়ে সেদিন আশার আলো জ্বলেছিল। রুহুল কুদ্দুস সিএসপি ও আওয়ামী লীগের দীর্ঘকালের কোষাধ্যক্ষ নুরউদ্দিন আহমদকে (১৯৫৪ সালে গণপরিষদ সদস্য) সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্ত দিয়ে বিনা পাসপোর্টে ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ দিল্লি পাঠিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। কথা ছিল, তারা কলকাতা গিয়ে লন্ডনে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি শশাঙ্ক শংকর ব্যানার্জিকে টেলিফোনে জানাবেন, ‘বঙ্গবন্ধু’ তাদের পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করার জন্য। তারা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ জানাবেন, ‘বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশের দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মিত্রবাহিনীর মতোই বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিতে হবে।রুহুল কুদ্দুস ও নুরুদ্দীন প্রথমে যান কলকাতায়। শশাঙ্ক ব্যানার্জির সঙ্গে তাদের কথা হয়। এরপর তারা যান দিল্লিতে। সেখানে ১৫ মার্চ বেলা ১১টায় ভারতের পরিকল্পনামন্ত্রী দুর্গা প্রসাদ ধরের একান্ত সচিবের সঙ্গে রুহুল কুদ্দুসের কথা হয়। শ্রী ধর তাদের সেদিনই তার বাসভবনে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানান। ভারতের রাজধানীতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সামরিক-অসামরিক কর্মকর্তাদের তাত্পর্যপূর্ণ আলোচনা হয় কুদ্দুস-নুরুদ্দীনের। এরপর তারা ফের কলকাতা ও খুলনা হয়ে ১৭ মার্চ রাত ১২টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধু তাদের বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এই দুজনের মুখে সব শোনার পর বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’। এরপর বাড়ির ছাদে গিয়ে তিনজনই নফল নামাজ আদায় করলেন। বঙ্গবন্ধু ওয়াদা করালেন, মৃত্যু পর্যন্ত তারা যেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক সহায়তার অঙ্গীকারপ্রাপ্তির বিষয়টি গোপন রাখেন’। আমার মামা রুহুল কুদ্দুস তার দূতিয়ালির কাহিনীটি আমার কাছে বলেছিলেন একটি শর্তে, তা হচ্ছে তার মৃত্যুর পরে আমি এটা প্রকাশ করব। নুরুদ্দীন ও রুহুল কুদ্দুস দুজনের কেউই আজ বেঁচে নেই। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তার সাক্ষী বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘকালের পরীক্ষিত সহচর আলহাজ গোলাম মোরশেদ এবং পিএসসির সাবেক পরিচালক তবিবুর রহমান। হাজী মোরশেদ ১৯৬২ সালে সক্রিয় রাজনীতি পরিত্যাগ করলেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে হাজী মোরশেদকে তার অবৈতনিক সহকারী নিয়োগ করেছিলেন। ১৯৯০ সালে দৈনিক দেশ (অধুনালুপ্ত) পত্রিকার স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় হাজী গোলাম মোরশেদ স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের সময় ৩২ নম্বরের বাসভবনে বেগম মুজিব, রাসেল, গৃহপরিচারিকা বুড়ি, কাজের ছেলে রহমান ও আমি ছিলাম। শেখ হাসিনা, জামাল ও রেহানাকে অন্য কোনো বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রাত সাড়ে ১০টায় আমি ৩২ নম্বরে পৌঁছার পর অনেকে টেলিফোনে আমাকে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে পালিয়ে যেতে বলার জন্য। কেউ কেউ বাসায় এসেও তাকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কোথাও যেতে রাজি হননি। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু রাজারবাগ ও যশোর পুলিশ লাইনের অস্ত্রশস্ত্র বিলিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। ২৫ মার্চ রাতে বলধা গার্ডেন থেকে রেডিও প্রকৌশলী শহীদ নুরুল হক ওয়ারলেস মেসেজে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা বিভিন্নস্থানে জানিয়ে দেন বলেও হাজী মোরশেদ উল্লেখ করেন। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সারা দিন খুব ব্যস্ত ছিলেন। সন্ধ্যার আগে তার নির্দেশে আনসার বিভাগের ডিরেক্টর আওয়াল ও আমি পুলিশের এসপি ই. এ. চৌধুরীর বাসায় গিয়ে তাকে জানালাম, ‘রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের অস্ত্রশস্ত্র বণ্টন করে দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু বলেছেন।’ রাত ১১টার দিকে বলধা গার্ডেন থেকে একটা টেলিফোন এলো। হাজী মোরশেদ বলেন, ‘আমি ফোন রিসিভ করলাম। অপরপ্রান্ত থেকে বলা হলো, মেসেজ প্রচার করা হয়ে গেছে। এখন মেশিন নিয়ে কি করব?’ আমি দৌড়ে গিয়ে বার্তাটি বঙ্গবন্ধুকে জানালাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, মেশিন ফেলে রেখে ওকে পালিয়ে যেতে বলো। সেসব কথা ভেবে আজ বলতে ইচ্ছে হয়, বাঙালি জাতির অমর প্রাণ, সূর্যের নামে নাম, শেখ মুজিবুর রহমান। আকাশে যতদিন সূর্য উদ্ভাসিত হবে এবং পৃথিবীর বুকে সূর্য কিরণ ছড়িয়ে পড়বে, ততদিন সূর্যের পাশে বীর বাঙালি জাতি উদ্ভাসিত হবে এবং সূর্যের ন্যায় পৃথিবীর বুকে বাঙালি জাতি পূর্ণ কিরণ ছড়িয়ে দেবে। সেই কিরণে উদ্ভাসিত হবে মানবজাতি। উদ্ভাসিত হবে পুণ্যালোকে, শুভকর্মে। বিশ্ব ভুবনজুড়ে বাঙালি জাতির জয়গান উঠবে : জয় হোক বাঙালির। জয়তু বাঙালি।

লেখক : স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপন্ডেন্ট; সরকারের সাবেক সচিব।

 

0 Shares

১৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ