বরিজহাটিতে ধোনাই মোনাই নামে দুই ভাই বাস করত। একদা ধোনাই বাদাবনে সাত-ডিঙ্গা নিয়ে মোম-মধু এনে ব্যবসা করার জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু তার ডিঙ্গার জন্য একটি লোকের অভাব পড়ে। তখন সেই পুঁথিটিঃ
"ধোনাই খুঁজিতে লোক, রওনা হইল।।
সেই গ্রামে দুখে নামে এক গরিব ছিল।
ধোনা মৌলে তাহার বাড়িও পৌছাল।।
দুখে বলে ডাকে তারে দরজাতে খাড়া হইল"।
কিন্তু দুখে তার মায়ের একমাত্র সন্তান। তার দুখেকে সে বাদাবনে বাঘের মুখে যেতে দিতে রাজি নয়। দুখের মা তখন বলিলঃ
" মা বলিতে দুনিয়াতে আর কেহ নাই।।
বাঘের মুলুকে তোরে কি রূপে পাঠাই।"
তখন ধোনাই দুখের মার কাছে প্রতিজ্ঞা করল (দুখেকে) সে তার নিজের ছেলের মতো দেখবে। নৌকাতে তাকে রাখবে। ডাঙ্গগা মানে বাদায় তাকে উঠতে দিবে না। তাই ধোনাই বললঃ
"ধোনাই কহিল ভাবি না ভাব অধিক।
দুখেকে দেখব আমি ব্যাটার মাফিক।"
তখন নিরুপায় হয়ে ধোনাইর হাতে ধরে অনেক অনুরোধ করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেলের চাপে তাকে যেতে দিতে রাজি হল, তবে যাবার সময় দুখের মা বলিল-
"আপদ বিপদে পড়িলে তোমার মনেতে রাখবা এই কথাটি আমার।।
জগত জননী বনবিবি বনে থাকে।।
বিপদে পড়িলে তুমি ডাকিও তাহাকে।।
বিপদে পড়িলে তাকে ডাক মা বলিয়া।।
দয়ালু মা বনবিবি নিবে উদ্ধারিয়া।"

মায়ের আশির্বাদ নিয়ে দুখে ধোনাই এর সংগে ডিঙ্গায় চলে গেল। ডিঙ্গা তাদের রায়মঙ্গল মাতলা নদী পার হয়ে মধুর খোঁজে গভীর জঙ্গলের মধ্যে খাঁড়িতে গড়খালির বাদাবনে গিয়ে এক বিকেলে নোঙ্গর করিল। উদ্দেশ্য রাতটা ওখানেই কাটাবে। পরেরদিন বাদাবনে গিয়ে সারাদিন হন্যে হয়ে খুঁজেও এক ফোঁটা মধু পেল না। আসলে দক্ষিণ রায় ছলনা করে সমস্ত মধু গোপন করে ফেলেছিল। ধনাই মনাই হতাশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

"চাকের ভিতর নাহি মধুর ভান্ডার।।
লীলা খেলা হবে বুঝি কোনো দেবতার।।
নজরেতে দেখি সহোদর ওর নাই।
কাছে গেলে চাক খালি দেখিবার পাই""।

কখন হতাশ মনে তারা ঘুমিয়ে গেল টেরই পেল না। এক সময় ঘুমেতে দক্ষিণ রায় ধোনাইকে দেখা দিয়ে জানাল
"ধোনাকে দক্ষিণ রায় কহিল তখন
বাদাবনে মোম মধু আমারো সৃজন।।
দন্ডবক্ষ দেড় ছিল পিতা সে আমার।।
দক্ষিণ রায় নাম আমি তনয় তাহার।।
রায় বলে ওরে ধনা কি বলিব আর।
নর রক্ত খেতে ওরে বাসনা আমার।।
এক লোক মোরে যদি দিতে পার তুমি।।
মোম মধু সাত ডিঙ্গা দি তোরে আমি।।

দুখেকে দক্ষিন রায়ের কাছে বলি দিতে বলে। এই কথা শুনে ধোসাইর মাথায় বিনা মেঘে বজ্রপাত পড়ে যেন। কিন্তু এতো অর্থ ব্যায় করে এবং দূরে সাত ডিঙ্গা নিয়ে এসে শূণ্য হাতে যাবে কেমন করে। নানা রকম ভেবে যখন কিছুই ঠিক করতে পারছে না, তখন দক্ষিণ রায় স্বপ্নে আবার বলিল যদি নর রক্তে আমাকে তুষ্ট না করো তবে,"তোর না সবব দিব ডুবাইয়া"। যতলোক আনিয়াছ খাওয়াব কুমিরে।। দেখি বেটা কেমনেতে যাও দেশে ফিরে"।।

এইকথা শুনে ধোনাই প্রান হইল ওষ্ঠাগত। ভয়ে কাঁপে থরথর। মনে পড়ল দুখের মাকে দেওয়া প্রতিজ্ঞার কথা। তাই দুখের বদলে সে অন্য কাউকে বলি দিতে চাইল। কিন্তু ধনাইর মনের কথা দক্ষিণ রায়র বুঝতে পেরে বলল,
"দুখের উপর মোর দৃষ্টি রায় বলে।
দুখে ছাড়া নাহি লিব অন্যকে সে দিলে।।

রায়ের এ বাতে ধোনা হইল পেরেশান।
দুখেকে দিতেই হবে রাজি হইল নিদান।

ততক্ষনে দক্ষিন রায় সন্তুষ্ট হইল। কোদাখালিতে দুখেকে ফেলে রেখে যেতে বলল। ধোনাই রায়ের ভয়ে দুখের মায়ের কাছে করা ওয়াদা ভুলে গেল। তারই ফলে এবার ধোনাই মোনাই প্রচুর মোম মধু পেতে লাগল। তারা প্রচুর মোম মধু নিয়ে সপ্ত ডিঙ্গা ভর্তি করে মনের আনন্দে কোদাখালাতে এসে নোঙ্গর করে রাত কাটাল। পরেরদান ছ'টা ডিঙ্গি আগে খুলে গেল। ধোনার আদেশে দুখেকে নিয়ে সকলে কাঠ কাটতে গেল। কিন্তু দুখে যেতে চায় না। তার মনে সন্দেহ হল, তাই কাকুতি মিনতি করিতে লাগল।
কিন্তু ধোনাই বলিল,
" বলে পাজি বেটা তসতাত বেটার।
একটা ফরমাস যদি মানিস আমার।।
ভালই চাওত জলদি কাট আন গিয়া।
না মানিল, নাও হইতে কান ধরে দেব নামাইয়া।"

তখন কী আর করা! বাধ্য হয়ে মনের দুঃখে দুখে বনে কাঠ কাটতে যায়। কিন্তু দক্ষিন রায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা মোতাবেক সবাই ধোনার ইশারায় দুখেকে ফেলে ডিঙ্গিতে উঠে ডিঙ্গি নিয়ে চলে আসে। কাঠ নিয়ে ফিরে এসে দুখে দেখে ডিঙ্গি নেই। ও সবার মতলব বুঝতে পারে। দুখে তখন চরে বসে কান্দে কাতর হইয়া"। কাঁদছিল দুখে। হঠাৎ এসময় দক্ষিন রায় আসে সামনে প্রকান্ড শরীরে বাঘের রূপ নিয়ে। হাওয়ায় ভর দিয়ে গাল মেলে খেতে আসে দুখেকে। তখন ভয়ে দুখের প্রান যায় যায়, হঠাৎ তার মায়ের শিখানো কথা মনে হল। সে বনবিবির নাম স্বরণ করে বলিল,
"বলে মাগো বনবিবি কোথায় আছ ছেড়ে।
জলদি করে এসে দেখ তোমার দুখে মারা যায়।।
কারার দিয়াছো মাগো যদি না পালিব,
ভাটির মধ্যে তোমার কলংক রয়ে যাবে।।
এতেক বলিয়া দুখে জ্ঞান হারাইল।
ভর কুন্ডে থাকি বিবি জানিতে পারিল।।
ভক্তের ডাকে হাওয়ার বেগে বনবিবি ছুটে আসল, সাথে জঙ্গাল শাহ্।এসে দেখে এক প্রকান্ড বাঘ দুখের ঘাড় মটকাইতে উদ্যত। তখন জঙ্গাল শাহ্ বিবির নির্দেশে খুব জোরে চড় মারে বাঘুর মাথায়।

"নাসাকুল চড় খেয়ে ফাফড় হইল।
জান লইয়া দক্ষিনা দেও দক্ষিনে চলিল।।

অমন বিরাশি সিক্কা এক চড় খেয়ে রাক্ষসরূপি দক্ষিণা রায় প্রাণ ভয়ে নদনদি পেরিয়ে পালাতে থাকে। কিন্তু জঙ্গাল শাহ্ ও ছাড়বার পাত্র নয়। সে তার পিছু পিছু তাড়া করে। এদিকে বনবিবি দুখেকে তুলে কোলে বাছা বাছা বলে ডাকে, কিন্তু দুখে না কহে কথা। চোখেমুখে জল দিয়ে, মাথায় হাত বুলায়ে তককে জ্ঞান ফিরিয়তে সব দুঃখের কথা শোনে। বনবিবি তাকে নিয়ে তার আস্তানায় ফিরে যায়। দুখে সেখানে সুখে দিনযাপন করতে থাকে।

চলবে,,,,

0 Shares

২৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ