iDxJmGLYdGEv

একটা ঘটনার দিন-তারিখ আমার মনে নাই, ১৯৪১ সালের মধ্যেই হবে, ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্স, শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। তাঁরা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রাহীম খাঁ সাহেব। সে সভা আমাদের করতে দিল না, ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল সাহেব গান শুনালেন। আমরা বললাম, এই কনফারেন্সে রাজনীতি আলোচনা হবে না। শিক্ষা ও ছাত্রদের কর্তব্য সম্বন্ধে বক্তৃতা হবে। ছাত্রদের মধ্যেও দুইটা দল হয়ে গেল। ১৯৪২ সালে আমি ফরিদপুর যেয়ে ছাত্রদের দলাদলি শেষ করে ফেলতে সক্ষম হলাম এবং পাকিস্তানের জন্যই যে আমাদের সংগ্রাম করা দরকার একথা তাঁরা স্বীকার করলেন। তখন মোহন মিয়া সাহেব ও সালাম খান সাহেব জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন।

১৯৪২ সালে মিস্টার জিন্নাহ আসবেন বাংলাদেশে, প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সম্মেলনে যোগদান করার জন্য। সম্মেলন হবে পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমায়। আমরা ফরিদপুর থেকে বিরাট এক কর্মীবাহিনী নিয়ে রওয়ানা করলাম। ছাত্রলীগ কর্মীই বেশি ছিল। সৈয়দ আকবর আলী সাহেবের বাড়িতে অভ্যর্থনা কমিটির অফিস করা হয়েছিল। আমি প্রায় সকল সময় শহীদ সাহেবের কাছে কাছে থাকতে চেষ্টা করতাম। আনোয়ার হোসেন তখন ছাত্রদের অন্যতম নেতা ছিলেন। তাঁর সাথে কলকাতায় আমার পরিচয় হয়। শহীদ সাহেব আনোয়ার সাহেবকে খুব ভালবাসতেন। ছাত্রদের মধ্যে দুইটা দল ছিল। চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরীও তখন ছাত্র আন্দোলনের একজন নেতা ছিলেন। ওয়াসেক সাহেব ও ফজলুল কাদের চৌধুরীর সাথে গোলমাল লেগেই ছিল। ওয়াসেক সাহেব ছাত্রদের রাজনৈতিক পিতা ছিলেন বললে অন্যায় হবে না। বহুদিন তিনি 'অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগে'র সভাপতি ছিলেন। ছাত্রজীবন শেষ করেছেন বোধহয় পনের বছর পূর্বে। তবুও তিনি পদ ছাড়বেন না। কেউ তাঁর মতের বিরুদ্ধে কথা বললেই বলতেন, "কে হে তুমি? তুমি তো ছাত্রলীগের সদস্য বা কাউন্সিলার নও; বের হয়ে যাও সভা থেকে।" প্রথমে কেউই কিছু বলত না তাঁকে সম্মান করে। প্রথম গোলমাল হয় বোধহয় ১৯৪১ বা ১৯৪২ সালে চুঁচুড়া সম্মেলনে। ফজলুল কাদের চৌধুরী ও আমরা ভীষণভাবে প্রতিবাদ করলাম, শেষ পর্যন্ত শহীদ সাহেবের হস্তক্ষেপে গোলমাল হল না। আমি ও আমার সহকর্মীরা ফজলুল কাদের চৌধুরীর দলকে সমর্থন করে বের হয়ে এলাম। তখন সাদেকুর রহমান (এখন সরকারের বড় চাকরি করেন) প্রাদেশিক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, পরে আনোয়ার হোসেন সম্পাদক হন। বগুড়া সম্মেলনে আমরা উপস্থিত হয়েও সভায় যোগদান করি না, কারণ অল ইন্ডিয়া মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মাহমুদাবাদের রাজা সাহেব ওয়াদা করলেন শীঘ্রই তিনি এডহক কমিটি করে নির্বাচন দেবেন। এডহক কমিটি করলেন সত্য, তবে কাগজপত্রেই রইল।

এই সময় ইসলামিয়া কলেজে আমি খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছি। অফিসিয়াল ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে তাদের পরাজিত করালাম। ইসলামিয়া কলেজই ছিল বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। পরের বছরও ১৯৪৩ সালে ইলেকশনে আনোয়ার সাহেবের অফিসিয়াল ছাত্রলীগ পরাজিত হল। তারপর আর তিন বৎসর কেউই আমার মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে ইলেকশন করে নাই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের ইলেকশন হত। আমি ছাত্রনেতাদের নিয়ে আলোচনা করে যাদের ঠিক করে দিতাম তারাই নমিনেশন দাখিল করত, আর কেউ করত না। কারণ জানত, আমার মতের বিরুদ্ধে কারও জিতবার সম্ভাবনা ছিল না। জহিরুদ্দিন আমাকে সাহায্য করত। সে কলকাতার বাসিন্দা, ছাত্রদের উপর তার যথেষ্ট পভাব ছিল। নিঃস্বার্থ কর্মী বলে সকলে তাকে শ্রদ্ধাও করত। চমৎকার ইংরেজি, বাংলা ও উর্দুতে বক্তৃতা করতে পারত। জহির পরে ইসলামিয়া কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, তবুও আমার সাথে বন্ধুত্ব ছিল। কিছুদিনের জন্য সে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় রেডিওতে চাকরি নিয়ে চলে আসায় আমার খুবই অসুবিধা হয়েছিল।

অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং-১৫ হতে ১৭)

'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' (পর্ব-১১)'

0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ