ছেলেটি

তৌহিদুল ইসলাম ২৫ মে ২০১৮, শুক্রবার, ০৮:৩৬:৩৭অপরাহ্ন গল্প ৬ মন্তব্য

ছেলেটা এক মনে কাজ করছিলো, লেবারের কাজ। অল্প বয়সী ছেলে, লম্বা গড়ন আর ফর্সা টকটকে চেহারা। কেমন যেন মায়া মায়া মুখখানি। জিজ্ঞেস করলাম বাড়ি কোথায়?
চেংমাড়ী।
বাবা মা?
মা আমার বয়স যখন দুই বছর তখন মারা গেছে।
ভাবলাম বাবা বেঁচে আছে। সে চুপ চাপ একমনে কোদাল চালিয়ে যাচ্ছিলো। কিছুক্ষন পর বললো বাবাও আমার সাত বছর বয়সে মারা গেছে।
আমি দাদির সাথে থাকি।
কথাগুলো শুনে মনে একটা ধাক্কা খেলাম। বাবা মা নেই, এতিম ছেলে রোজগারের জন্য এতটুকু বয়সে লেবারের কাজ করছে!!
তার কথায় মার্জিত ভাব, ধারনা করলাম পড়াশুনা করে হয়তো।
তুমি পড়াশুনা করো?
হুম।
কোথায়?
চেংমাড়ী হাই স্কুল।
কোন ক্লাসে?
নিউ টেন, সাইন্স।
রোল কত?
আমার?
হুম?
আমি ফাস্ট বয়, সেই ক্লাস সেভেন থেকে।
বাহ! খুব ভালো
ভাইবোন?
বোন নেই,শুধু এক ভাই আছে সে বড়। সেও পড়াশুনা করে, ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার।
কোন কলেজ?
গংগাচড়া ডিগ্রী কলেজ।
সেও লেবারের কাজ করে পড়াশুনার খরচ যোগায়।
সেকি?? কিন্তু তোমাদের ক্লাস মিস হয়ে যায় যে!!
কি করবো ভাইয়া, সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস করি আর বাকি ৪ দিন কাজ করি। না হলে পেটে খাবারো ঢুকবেনা, অন্যান্য খরচও যোগাড় হবেনা। কথাটা শুনে খুব কস্ট পেলাম। আহারে এতটুকে ছেলে কত কস্ট করে নিজেরা একটু খাবে পড়বে বলে!
পরিবারে আর বড় কেউ নেই?
চাচা আছে আলাদা খায়, আমার দাদাকে সে দেখভাল করে আর দাদি আমাদের দু' ভাইয়ের সাথে খায়। বুঝতে পারলাম বাবা মা বেঁচে নেই বলে চাচা তাদের দাদা দাদিকে দু ভাগ করে দিয়েছে, একভাগ নিজের কাছে আর একভাগ দিয়েছে এতিম ছেলেগুলোকে। পাষণ্ড কোথাকার।
বললাম ফুফু খালা নেই?
আর কেউ নেই বলে সে মাথা নীচু করে মাটির দিকে চেয়ে আছে। হয়তো পুরোনো কোন স্মৃতি তার বুকটাকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছিলো তখন। হতে পারে আমার সামনে আত্মসম্মানবোধের গ্লানিতে ভুগছিলো সে সময়।
আমি আর কথা বাড়ালামনা। ছেলেটি একমনে কাজ করে যাচ্ছিলো। আমার সাথে কথা বলার সময়ও এক মুহুর্তের জন্য কাজ থামায়নি। হয়তো ফাঁকি দেয়া তার স্বভাব বিরূদ্ধ।
তাকে কাজ থামাতে বলে হাতমুখ ধুতে বললাম।
কেন ভাইয়া?
চলো নাস্তা করে নাও। সে একটু লজ্জা পেলো মনে হয়। কি মনে করে আমার সাথে হোটেলে নাস্তা করতে আসলো। বললাম যা মনে চায় তাই খাও। কিন্তু সে শুধু দুটো ডাল পুরি খেয়েই আবার কাজে নেমে পড়লো।
আমি বসে বসে দেখছিলাম।
কাজ শেষে সে চলে যাওয়ার সময় তার মজুরীর চেয়ে কিছু বেশী দিতেই সে বললো-
ভাইয়া ভুল করে মনে হয় বেশি টাকা চলে আসছে, আবার গুনে দেন। আমি তার আদর্শবোধ আর নৈতিকতা দেখে আবারো অবাক হয়ে তাখে শুধু বললাম- রাখো। কিন্তু তার বিবেক তাকে বাধা দিচ্ছিলো পরিস্কার বুঝতে পারছিলাম।
আমি আর কিছু বলললাম না, শুধু কাল সকালে বাকী কাজ শেষ করে দেয়ার কথা বলে তাকে বিদায় জানালাম। সে আসবে এ কথা বলে সাইকেলে উঠে চলে গেলো।
সন্ধ্যায় একটু ফ্রী হয়ে তার কথা ভাবতে বসলাম। ছেলেটির জন্য কিছু করার তাগিদ আমি আমার ভিতর আজ সারাদিন ক্ষনে ক্ষনে অনুভব করেছি। শেষমেশ একটা উপায় খুঁজে পাবার জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ জানিয়ে কাজ শুরু করলাম।
তার বড় ভাই যে কলেজে পড়ে সে কলেজের প্রতিষ্টাতাদের একজন ছিলেন আমার বাবা। মামা এখন গভর্নিং বডির সদস্য। প্রিন্সিপাল স্যারকে ফোন করে ছেলেটির বড় ভাইয়ের জন্য বেতন মওকুফের কথা বলাতে তিনি সব শুনে রাজি হয়ে গেলেন। আমাকে তার দরখাস্ত সহ প্রয়োজনীয় কাগজ পাঠাতে বললেন। পরে একসময় মামাকে বলে তার পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের টাকা মওকুফ করে দেব।
এবার ফোন দিলাম ছেলেটি যে স্কুলে পড়ে তার হেড মিস্ট্রেস আমার দূরসম্পর্কের কিন্তু খুব আদরের খালাকে। তাকেও সব বলাতে তিনি ছেলেটির বেতন মওকুফ এবং স্কুল কমিটিকে বলে তার জন্য একটি বৃত্তির ব্যবস্থা করতে রাজী হলেন।
মনটা আজ বেজায় খুশি। কাল ছেলেটাকে বড় সারপ্রাইজ দেয়া যাবে। এসব শোনার পর তার মুখখানা কেমন হবে তাই ভাবছি।
হঠাত মনে হলো কি আশ্চর্য!! এতক্ষন যাকে নিয়ে এত কথা লিখলাম, সারাদিন যার কথা মন থেকে একটিবারের জন্য সরাতে পারিনি তার নামটাইতো জিজ্ঞেস করিনি?? কি লজ্জা!!
গোটা লিখনিতে শুধু তাকে ছেলেটা বলেই সম্বোধন করে গেলাম। আসলে তার সাথে কথা বলার পর থেকেই খুব আপন ভাবতে শুরু করেছি। আর আপনজনদেরতো কেউ নাম জিজ্ঞেস করেনা তাইনা??
যাক কাল সকালে আসুক, তার নামটাই প্রথমে জিজ্ঞেস করবো।

ছোটগল্প -
ছেলেটি

0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ